সোমবার, ৩১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

সেনাবাহিনীকে বিতর্কে টেনে আনা উচিত নয়

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

সেনাবাহিনীকে বিতর্কে টেনে আনা উচিত নয়

আগামী জাতীয় নির্বাচনের এখনো প্রায় দেড় বছর বাকি। নির্বাচন কমিশন নিজেদের প্রস্তুতিমূলক কাজের টাইমাবাউন্ড একটা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এটি তাদের রুটিন কাজ। আগের সব নির্বাচন কমিশনও জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ এভাবেই করেছে। কিন্তু একটি রাজনৈতিক বড় পক্ষ ও তাদের কিছু নেতার অরাজনৈতিকসুলভ কথাবার্তায় মনে হচ্ছে কমিশন প্রস্তুতিমূলক কাজ করার ঘোষণা দিয়ে মহা অন্যায় করে ফেলেছে। কেউ কেউ নোংরা ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক বক্তব্যও দিচ্ছেন, যা একটা সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মোটেই কাম্য নয়। যেখানে সবার উচিত নির্বাচন কমিশনকে কীভাবে আরও শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করা, সেখানে নির্বাচন কমিশনকে আরও দুর্বল করতে পারে এমন বক্তব্য থেকে সবারই বিরত থাকা উচিত। তারপর নির্বাচনের দেড় বছর আগে সেনাবাহিনীকে নির্বাচনের সময় মোতায়েন করা প্রসঙ্গে যেসব বক্তব্য কেউ কেউ দিচ্ছেন সেটি একেবারে অসময়োচিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। সুষ্ঠু নির্বাচনের বড় অন্তরায় প্রচারণায় ধর্মের ব্যবহার এবং ভোট বেচাকেনায় টাকার ব্যবহার। অথচ এটা রোধ করার উপায় নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। অন্যদিকে যা বলার সময় এখনো আসেনি, সেই সেনা মোতায়েন ও তাদের দায়িত্ব নিয়ে এখনই বিতর্কিত বক্তব্য দিচ্ছেন। এটি উদ্দেশ্যমূলক প্ররোচনার শামিল এবং পরিবেশ বিনষ্টকারী বিতর্ক সৃষ্টির প্রচেষ্টা। আগামী নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে কি হবে না, অথবা হলে তার পরিধি ও কাঠামো কেমন হবে, তা বলার সময় এখনো আসেনি। কারণ আমরা সবাই জানি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে অর্থাৎ শিডিউল ঘোষণার পর একটা বিশেষ নির্বাচনী পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সেই পরিবেশ-পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের আগেই সব ফোর্সের দায়িত্ব বণ্টন ও নির্ধারণ করবেন কী করে। এটা তো অবাস্তব। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে একদিকে যেমন উত্সাহ-উদ্দীপনা, উল্লাস, আনন্দ, উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে এলাকাভেদে কমবেশি শঙ্কারও কারণ থাকে। আগের নির্বাচনগুলোতে প্রাক ও নির্বাচন-উত্তর সময়ে নিরাপত্তাজনিত সমস্যার বড় শিকার হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং ক্ষুদ্র নৃ-জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ। সব বড় বড় দল নির্বাচনে অংশ নিলে এক রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, আবার কোনো বড় দল নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যদি আগের মতো প্রতিহতের ঘোষণা দেয়, তাহলে অন্যরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পরই কেবল পরিবেশ-পরিস্থিতির একটা সঠিক পূর্বাভাস পাওয়া যাবে। তখন বিরাজমান পরিস্থিতির একটা সঠিক ও বিস্তারিত মূল্যায়নই বলে দেবে সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন আছে কি নেই এবং থাকলে তার পরিধি কী হবে।

কেউ কেউ বলছেন, এখনই এটা নিয়ে আলোচনা করলে ক্ষতি কী। প্রথম ও মৌলিক কথা হলো, দেড় বছর আগে পরিস্থিতির সঠিক উপলব্ধি ব্যতিরেকে ফোর্সসমূহের দায়িত্বের পরিধি নিরূপণ করলে নির্ঘাত সেটি ভুল হবে এবং তা নিয়ে অবধারিতভাবে পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ভিতরে অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনীতি চলে আসবে। আর সেই রাজনীতির মাঝখানে পড়বে সেনাবাহিনী। তখন সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাজনীতি করার পূর্বাভ্যাস যাদের আছে তারা ইচ্ছামতো একতরফা বক্তব্যের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে পার্টিশন অবস্থানে ঠেলে দেওয়ার অপচেষ্টা করবে, যেমনটি আগে আমরা দেখেছি। তাতে সেনাবাহিনীর পেশাগত বিশেষত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাহিনীর মনোবল ও শৃঙ্খলার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং মানুষের মধ্যেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘ শান্তিমিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি রয়েছে তাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সব দেশের সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরে ও ঊর্ধ্বে দেখতে চায়। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, ১৯৭৫ সালের পরে পর পর দুজন সামরিক শাসক সেনাবাহিনীকে রাজনীতির মধ্যে টেনে এনে অশেষ ক্ষতি করেছেন। ওই খারাপ দৃষ্টান্ত থেকে বের হওয়ার চেষ্টা সবাইকে অব্যাহত রাখতে হবে। সময় পরিপক্ব হওয়ার আগে এখনই সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা দেওয়া-না দেওয়া প্রসঙ্গ নিয়ে অযাচিত বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। যার মাধ্যমে ওপরে বর্ণিত আমার আশঙ্কার সত্যতাই প্রমাণিত হয়, তারা সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে টেনে আনতে চায়। সময়মতো পরিস্থিতির বিবেচনায় এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এখনই কেন? একটি মৌলিক কথা আমাদের স্মরণে রাখা দরকার। আর তা হলো, যার যে কাজ সেটি তাকে দিয়ে না করিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে করাতে গেলে ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী। আর সে ত্রুটি-বিচ্যুতি যদি রাজনৈতিক জয়-পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তো কথাই নেই, সেনাবাহিনীকে পার্টিশন ব্লেইম গেমের মধ্যে ফেলা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সেনাবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সাধারণত থাকেন ক্যাপ্টেন ও লেফটেন্যান্ট পদবির অফিসার। এ অফিসারদের চাকরির মেয়াদ কম। মিলিটারি পেশায় নবীন আর বেসামরিক বা জনমানুষ সম্পর্কিত কাজের অভিজ্ঞতা একেবারে শূন্য। তারুণ্যের উদ্দীপনা ও আবেগে ভরপুর থাকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। জনসাধারণ এবং রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকায় কাজ করতে গেলে ছোট-বড় অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটতে পারে, সেটাই স্বাভাবিক। আর নির্বাচনের সময় বিধায় বড় কোনো ত্রুটি হলে তা একজন প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ হতে পারে। যতই সরল বিশ্বাসে কাজ করা হোক না কেন, পরাজিত প্রার্থী অবশ্যই পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও বেসামরিক প্রশাসনের বিভিন্ন অঙ্গনে বিরাজমান দূষিত বাতাস সেনাসদস্যদের গায়ে লাগলে সেনাবাহিনীর পেশার যে একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে তা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৃতীয়ত, জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে সেনাবাহিনীর মূল যে শক্তি, সেই চেইন অব কমান্ড দারুণভাবে দুর্বল হয়। তাই ব্রিটিশ আমল থেকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাজনিত কোনো কর্তব্যে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন হলে তাদের নিয়োজিত করা হয় বেসামরিক প্রশাসনের সহায়কশক্তি হিসেবে, স্বল্প সময়ের জন্য।

এ ক্ষেত্রেও কিছু করণীয় এবং অকরণীয় নীতিমালা অনুসরণ করা হয়। যেমন, কোনো সেনাদল কর্তব্য পালনের জন্য ক্যাম্পের বাইরে গেলে সে দলের সঙ্গে অবশ্যই একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং একটি পুলিশের দলও সঙ্গে থাকে। গুরুতর কোনো শৃঙ্খলা ভঙ্গের পরিস্থিতিতে তা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রথমে পুলিশ অ্যাকশনে যায়। পুলিশ ব্যর্থ হলেই সঙ্গে থাকা ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মতিতে সেনাবাহিনী অ্যাকশনে যায়। প্রচলিত অবরোধ ও তল্লাশি এবং গ্রেফতারি অভিযানে সেনাবাহিনীকে নিয়োজিত করা হয় না, সঙ্গত কারণে যা ইতিমধ্যে উপরে উল্লেখ করেছি। কিন্তু সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হলে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সন্নিবেশিত করা হলে সব কাজই তারা স্বতন্ত্রভাবে করতে পারে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়তা ছাড়াই। এ পরিস্থিতিতে বিরাজমান রাজনৈতিক ব্লেইম গেমের খেলায় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে জনশৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য যে অভিজ্ঞতা ও পূর্ব জনসম্পৃক্ততার দরকার হয়, সঙ্গত কারণেই তা সেনাবাহিনীর থাকে না। আর সেনাবাহিনী যদি রাজনৈতিক ব্লেইম গেম বা সরাসরি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে যায়, তাহলে সেটির পরিণতি কী হয় সে অভিজ্ঞতাও আমাদের রয়েছে। দুই সামরিক শাসক রাজনীতিতে জড়িত করায় সেনাবাহিনী ও জনগণ এক সময় বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেছিল এবং দুইয়ের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল যেটি দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য চরম ক্ষতিকর। সেনাবাহিনী সব দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস যতটা গৌরবোজ্জ্বল সে রকম উদাহরণ খুব কম দেশের সেনাবাহিনীর রয়েছে। আমাদের সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে। ফলে তার জন্ম বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি দিক হলো জনগণ এবং সেনাবাহিনী এক ও অভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জনগণ ও সেনাবাহিনীর রক্ত ঝরেছে বাংলাদেশের মাটিতে একই সঙ্গে। জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য এ বন্ধনের মূল্য অপরিসীম। তাই সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে এমন সংবেদনশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও কাজ বা রাজনৈতিক দলের শালিসি ও ঝগড়া মেটাতে সেনাবাহিনীকে নিয়োজিত করা ঠিক হবে না। তাতে সব পক্ষের মধ্যে পার্টিশন চিন্তা-চেতনা চলে আসতে পারে। পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসনের পেশাই হলো জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। তারা জানে কীভাবে সমদূরত্ব বজায় রাখতে হয়। সবাইকে এক করে ফেলা বা এক জায়গায় নিয়ে আসা দূরদর্শী কাজ হবে না। তাই নির্বাচন ঘনিয়ে এলে পরিস্থিতির বিবেচনায় সেনা মোতায়েন করতে হলে তা অবশ্যই হতে হবে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় এবং নিয়োজিত থাকবে স্ট্রাইকিং ও স্ট্যান্ডবাই ফোর্স হিসেবে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর