মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

বিবাহবহির্ভূত সন্তানও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

বিবাহবহির্ভূত সন্তানও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে

বিবাহবহির্ভূত সন্তান, তার ভবিষ্যৎ, স্বীকৃতি ও  উত্তরাধিকার নিয়ে সম্প্রতি একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। মামলার রায়ে বলা হয়েছে— ‘আইনগত বিবাহবহির্ভূত সন্তান বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হবে এবং পিতা-মাতার অর্জিত ও পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে।’ (রিভানাসিদ্ধাপা ও অন্যান্য বনাম মালিক অর্জুন ও অন্যান্য ২০১১)। মামলার বাদীপক্ষে ছিলেন মালিক অর্জুনের প্রথম স্ত্রী ও তার দুই সন্তান আর বিবাদীপক্ষে ছিলেন মালিক অর্জুন, তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও দুই সন্তান। বাদীপক্ষ পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত যৌথ অংশীদারি সম্পত্তিতে তাদের অংশ দখলের দাবিতে কর্ণাটকের বিচারিক আদালতে বাটোয়ারা মামলা করে। মামলায় বাদীপক্ষ দাবি করে, তিনি বিবাদীর বৈধ স্ত্রী এবং তার দুই সন্তানসহ বিবাদীর সঙ্গে অংশীদারি সম্পত্তির অংশীদার। সেই সঙ্গে তিনি আরও দাবি করেন যে, বিবাদীর দ্বিতীয় বিবাহ অবৈধ। কারণ তার প্রথম বিবাহ বর্তমান থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহ ও তাদের সন্তানের জন্ম হয়েছে, যার ফলে তারা অংশীদারি সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে না। কর্ণাটকের বিচারিক আদালত বাদীর দাবির পক্ষে রায় প্রদান করে বলেন, বিবাদীর দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানরা অবৈধ। কারণ প্রথম স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় বিবাদী দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হয়েছেন। ফলে বাদীপক্ষ দাবিকৃত সম্পত্তির অংশীদার এবং দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানরা ওই সম্পত্তির অংশীদার নন। বিবাদীপক্ষ অর্থাৎ মালিক অর্জুন ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও দুই সন্তান ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। উচ্চ আদালত বিচারিক আদালতের রায়ের বিপরীতে হিন্দু বিবাহ আইন ১৯৫৫-এর ১৬(৩) ধারা উল্লেখ করে বলেন, বিবাহবহির্ভূত সন্তান বৈধ সন্তান হিসেবে বাদীপক্ষের সঙ্গে যৌথ পারিবারিক সম্পত্তির অংশ দাবি করতে পারবেন। এ রায়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বাদীপক্ষ অর্থাৎ মালিক অর্জুনের প্রথম স্ত্রী ও তার সন্তানরা হাই কোর্ট বিভাগে প্রথম আপিল করেন। আপিলের রায়ে বলা হয়, যেহেতু দ্বিতীয় বিবাহ ও তার সন্তানরা অবৈধ, সেহেতু অবৈধ সন্তানরা ‘জন্মসূত্রে’ যৌথ অংশীদারি সম্পত্তির অধিকারী নন। সন্তানরা শুধু পিতা-মাতার অর্জিত সম্পত্তির অধিকারী হবেন। আদালত সেই সঙ্গে আরও বলেন, বিবাদীর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তানরা পিতার মৃত্যুর পর সম্পত্তির অংশীদার হবেন। ওই প্রেক্ষাপটে বিবাদীপক্ষ অর্থাৎ মালিক অর্জুনের দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানরা আপিল বিভাগে বর্তমান দ্বিতীয় আপিলটি করেন। রায়ে বিচারক জি এস সিংভি ও এ কে গাঙ্গুলি ঘোষণা করেন, ‘আইনগত বিবাহবহির্ভূত সন্তান বৈধ সন্তান হিসেবে গণ্য হবেন এবং পিতা-মাতার অর্জিত ও পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন।’

এদিকে লিভ টুগেদার করলেও পার্টনারের সম্পত্তির অধিকার পাওয়া যাবে বলে সেন্ট্রাল লন্ডনের কাউন্টি কোর্ট একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছে। রায়ে লিভ টুগেদার থাকা অবস্থায় কেনা বাড়ির অর্ধেকে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিয়ে বহির্ভূত পার্টনার মহিলার। ভদ্রলোকের আগের স্ত্রীর সঙ্গে কোনো প্রকার ছাড়াছাড়ি হয়নি। চলমান আইনে মি. মারটিনের মূল স্ত্রী মউরিন মারটিন (যার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকলেও ডিভোর্স হয়নি) অধিকারে চলে যায়। কিন্তু লিভিং পার্টনার জয় উইলিয়াম তার লিভ টুগেদারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে মামলা করেন। পরে রায়ও তার পক্ষে যায়।  এ রায়ের ফলে রেজিস্ট্রিকৃত বিয়ে ও লিভ টুগেদারের ক্ষেত্রে অধিকার প্রায় সমানভাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে।

আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)-এর ধারা ১৩-তে বলা হয়েছে যে, ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া শিশুটির তত্ত্বাবধান করবেন শিশুটির মা অথবা মা-পক্ষের আত্মীয়স্বজন। এ সময় শিশুটি মায়ের অথবা বাবার অথবা উভয়ের পরিচয়ে পরিচিত হবে। আরও বলা হয়েছে, শিশুটির ভরণপোষণ ব্যয় বহন করবে সরকার। এ ক্ষেত্রে শিশুটি ছেলে হলে ২১ বছর আর মেয়ে হলে বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত সরকার তার ভরণপোষণ ব্যয় বহন করবে। শিশুটি যদি প্রতিবন্ধী হয় তবে যতদিন পর্যন্ত সে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করতে না পারে ততদিন পর্যন্ত সরকার ভরণপোষণ দেবে। আদালত এ ক্ষেত্রে নির্ধারণ করে দেবেন যে শিশুটিকে প্রতি মাসে ভরণপোষণ বাবদ কত টাকা দেওয়া হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)-এর ধারা ২০-এ বলা হয়েছে যে, এ আইনে দায়ের করা প্রতিটি মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। ধারা ১৩(৩) এ বলা হয়েছে প্রাথমিক অবস্থায় শিশুটির ব্যয়ভার বহন করবে সরকার। কিন্তু পরে আদালতের নির্দেশে ধর্ষণকারীকে শিশুর ব্যয়ভার নির্বাহ করতে হবে। ধর্ষক ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে শিশুর ব্যয়ভার বহন করা হবে। ধারা-১৩ ও ১৫-তে বলা হয়েছে যে, ধর্ষকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহকৃত টাকা পর্যাপ্ত না হলে সে ভবিষ্যতে উত্তরাধিকারী হবে এমন সম্পত্তি থেকে ভরণপোষণ ব্যয় নির্বাহ হবে। এ ক্ষেত্রে ওই সম্পত্তির ওপর কোনো ব্যাংক লোন অথবা বন্ধকী থাকলেও শিশুটির অধিকার আগে প্রাধান্য পাবে। ধারা ১৬-তে বলা হয়েছে, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট জেলার কালেক্টর প্রথমে ধর্ষণকারীর সব প্রকার সম্পত্তির একটি তালিকা তৈরি করবেন এবং সরাসরি নিলামের মাধ্যমে সেই সম্পত্তি বিক্রি করে শিশুর ভরণপোষণ ব্যয় নির্বাহ করবেন।

ধারা ১৪-তে বলা হয়েছে, ধর্ষিতা ও সন্তানের ছবি, নাম, বাসা অথবা স্থায়ী ঠিকানা কোনোটাই পত্রিকা অথবা মিডিয়ায় প্রকাশ করা যাবে না। যদি কেউ জানা সত্ত্বেও ভিকটিমের পরিচয় বা ছবি মিডিয়ায় প্রকাশ করেন তবে তিনি এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডসহ জেল ভোগ করবেন। ধারা ২৪-এ বলা হয়েছে, যদি কোনো পক্ষ আদালতের রায়ের ফলে নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন তাহলে ওই রায় ঘোষণা হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও গবেষক।

Email:[email protected]

সর্বশেষ খবর