শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

হজযাত্রীদের দুর্ভোগ শেষ হবে কবে?

শাইখ সিরাজ

হজযাত্রীদের দুর্ভোগ শেষ হবে কবে?

অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৫ সালে হজের ফ্লাইটের অপেক্ষায় থেকে থেকে বিমানবন্দরে ইহরাম বাঁধা অবস্থায় একজন হজযাত্রী মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৫ সালেও এমন একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ও মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেছিল। ২০১৪ সালে ১৩৩ জন যাত্রী হজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেও শেষ পর্যন্ত ফ্লাইট না থাকায় যেতে পারেননি। গত বছরও একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। প্রায় ৪শ’র মতো যাত্রীর হজ যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। একেবারে শেষ মুহূর্তে দুটি বিমান ভাড়া করে বিকল্প ব্যবস্থায় তাদের পাঠানো হয়েছিল।  পরিস্থিতি এবারও সেদিকে যাচ্ছে। নানামুখী অনিয়ম-অদক্ষতা আর সেবার নামে বাণিজ্যিক তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এবার শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

হজযাত্রীদের কেন এই দুর্ভোগ স্বীকার করতে হবে? সময়মতো টাকা পরিশোধ করে সুদূর গ্রামাঞ্চল থেকে আত্মীয়-পরিজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হজের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এর অংশ হিসেবেই আসেন ঢাকায়। হজ ক্যাম্পে অসংখ্য মানুষের ভিড়, খাদ্য, পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যা থেকে শুরু করে নানাবিধ দুর্ভোগ পোহাতে হয়। আল্লাহর নামে হজে বেরিয়েছেন বলে, তারা অনেক কিছুই মন থেকে হজম করে চুপ থাকেন। এমনকি মৃত্যুর জন্যও মানুষগুলো প্রস্তুত। তাই বলে কি তাদের এই দুর্ভোগকে আমলে নেওয়া হবে না? হজযাত্রীসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি এবারও পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে উঠতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আমি নিজেও খুবই উদ্বিগ্ন। পবিত্র হজযাত্রায় মানুষের দুর্ভোগ-কষ্ট ও অনিশ্চয়তা এর আগেও দেখেছি। প্রতি বছরই কমবেশি এসব সংকট দেখা দেয়। পৃথিবীর সব দেশ যখন হজের প্রশ্নে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের দুর্ভোগ অনেকটাই নিরসন করেছে তখন আমাদের দেশে হজযাত্রীদের দুর্ভোগের কোনো শেষ নেই। 

পত্রিকায় দেখছি ৪৫ হাজার হজযাত্রীর ভিসা অনিশ্চিত। অন্যদিকে একের পর এক বাতিল হচ্ছে বিমানের ফ্লাইট। বলা হচ্ছে, ভিসাধারী হাজী নেই। একটি মহল বলছে, হাজীরা ভিসা পাচ্ছেন না। কারণটি কী? একটু খোঁজখবর করে জানলাম, এবারই প্রথম ই-ভিসার আয়োজন। ডিজিটাল এ পদ্ধতিটি একেবারেই নতুন। এর সঙ্গে স্থানীয় কর্মীরা খুব বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেননি। তারা একসঙ্গে অনেক ভিসা রিড করতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলছেন। এতে ভিসার জট তৈরি হচ্ছে। প্রতিনিয়ত সিস্টেম লস হতে হতে বড় একটি জট তৈরি হয়েছে। আবার একটি পরিবারের (যারা পরিবার ধরে অনেকেই একসঙ্গে হজে যাচ্ছেন) একজন যদি এই জটিলতায় পড়েন তাহলে পুরো পরিবারই এই অনিশ্চয়তার শিকার হন। এতে মাঝে মাঝেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ভিসার জন্য হজযাত্রীরা হাহাকার করছেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এবারও হজ নিয়ে এক অস্থিরতার দিকে পরিস্থিতি এগিয়ে যাচ্ছে।

বিষয়টির একটু গভীরে গিয়ে দেখলাম হজের সঙ্গে ধর্ম পালন, মানবসেবার জায়গায় জেঁকে বসেছে বহুমুখী বাণিজ্য। এই বাণিজ্যের তৃণমূল পর্যায়ে আছে এক শ্রেণির দালাল ও ফড়িয়া। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলের মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন থেকে শুরু করে অনেকেই শুধু বাণিজ্যের চিন্তা থেকে হজ এজেন্টের ফড়িয়া হিসেবে কাজে নেমেছেন। এজেন্ট পর্যায়ের হজের ব্যয় যদি চাওয়া হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, তাহলে ওই ফড়িয়া হজযাত্রীর কাছ থেকে আদায় করেন ৩ লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। বিনিময়ে তিনি সাড়ে তিন লাখ টাকার সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখাচ্ছেন। কিন্তু পরে এসে হজযাত্রী অনেক গরমিল দেখতে পেয়ে কিছুটা হতাশ হয়েও নিজেকে সামলে নেন। গ্রামের সরলপ্রাণ হজযাত্রীর কাছে হজে যাওয়া মানে কোনো কিছুর দিকে না তাকিয়ে বায়তুল্লাহ শরিফে যাওয়ার স্বপ্ন থাকে শুধু। আর কিছু নয়। তৃণমূল পর্যায়ের এই অনিয়মের মতোই হজের সবক্ষেত্রেই দিন দিন বাড়ছে অনিয়ম। যদিও যান্ত্রিক ও ডিজিটাল ব্যবস্থার মাধ্যমে কিছু অনিয়ম দূর করার কেন্দ্রীয়ভাবে চেষ্টা চলছে, কিন্তু তার সাফল্য কত দিনে আসবে তা চিন্তার বিষয়। এসব অনিয়ম তুচ্ছ করে যখন ভিসা আর ফ্লাইটের জন্য চাতক পাখির মতো উন্মুখ থাকতে হয়, তখন পড়তে হয় আরেক জটিলতায়। কোনো জায়গায়ই যে শৃঙ্খলা নেই।

এর মধ্যে নতুন করে সৌদি সরকার থেকে ঘোষণা এসেছে যারা ২০১৫ ও ২০১৬ সালে হজ করেছেন, তাদের ভিসার আবেদনের সঙ্গে দুই হাজার রিয়াল পরিশোধ করতে হবে। সৌদি সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক হজ চুক্তির সময় এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা ছিল না। সৌদি হজ কর্তৃপক্ষ হঠাৎ করে গত সপ্তাহে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আকস্মিক এ সিদ্ধান্তে প্রায় ২৭ হাজার ভিসা নিতে বিপাকে পড়েছে হজ এজেন্সিগুলো। হজ সিডিউল ভেঙে পড়েছে। হাব-এর হিসাব অনুযায়ী, এ বছর এ ধরনের হজযাত্রীর সংখ্যা ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার। তাছাড়া প্রতি বছর হজ পালন করেন এমন মোয়াল্লেম ও এজেন্সি মালিক আছেন প্রায় ২ হাজার। এর বাইরে কোনো পরিবার বা গ্রুপভিত্তিক হজযাত্রীদের একজন যদি এর আওতায় পড়েন তাহলে পুরো টিমের যাত্রা স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। এর সংখ্যাও ৫ হাজারের বেশি। 

গতকাল বিকালে এ লেখাটি যখন লিখছি তখন ধর্ম মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলাম। তাদের দেওয়া তথ্য মতে এ বছর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সর্বমোট হজযাত্রীর সংখ্যা ১ লাখ ২৭ হাজার ৯৯৮ জন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাচ্ছেন ৪ হাজার ২০০ জন। আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যাচ্ছেন ১ লাখ ২২ হাজার ৯৯৮ জন। এ পর্যন্ত সৌদি দূতাবাস থেকে ভিসা পাওয়া গেছে ৫২ হাজার ২৬০ জনের। এর মধ্যে ইতিমধ্যে হজে গেছেন ৩০ হাজার ৯১৮ জন। ভিসা পাওয়ার পরেও এখনো হজে যাননি বা যেতে পারেননি ২১ হাজার ৬৮২ জন। অথচ ইতিমধ্যে বিমানের ১২টি ও সৌদি এয়ারলাইনসের চারটি মোট ১৬টি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। ভিসা থাকার পরও হজযাত্রীদের হজে না যাওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেল অনেক এজেন্ট পরিকল্পিতভাবে হজযাত্রীদের বেশি দিন সৌদি আরবে রাখতে চান না। ব্যয় কমানোর জন্যই তারা ফ্লাইট বিলম্ব করে থাকেন। অথচ প্রত্যেক হজযাত্রীই চান বেশি দিন আল্লাহর ঘরে অবস্থান করতে। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরকারি ঊর্ধ্বতন মহল থেকে একেবারে নিচের মহল পর্যন্ত একটি যোগসাজশ ও অনিয়মের যোগসূত্র রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে বাণিজ্যিক স্বার্থও। এদিকে হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ নিয়েও যে বহুমুখী বাণিজ্য চলে তার অন্যতম একটি প্রমাণ হিসেবে একজন হজযাত্রী জানালেন, সারা বছর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে সৌদি আরবের ভাড়া যেখানে ৫০ থেকে ৫২ হাজার টাকা, সেখানে হজের সময় বিমানে ভাড়া হাঁকানো হয় ১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। বিমান বাংলাদেশ এই ভাড়া নির্ধারণ করে বিধায় এই একই হারে বাণিজ্য করার সুযোগ পায় সৌদিয়া এয়ারলাইনসও। দুই এয়ারলাইনস মিলিয়ে ৬৫ হাজার করে যাত্রী পরিবহনে অন্য সময়ের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বাণিজ্য করে। শুধু আকাশপথের এই ব্যয়টি স্বাভাবিক হলেই হজের খরচ হতে পারত ১ লাখ টাকার কাছাকাছি।

হজে যাওয়ার বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে গিয়ে সাধারণ হজযাত্রীরাও অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। একজন হজযাত্রীর ভাষ্য, পরিকল্পিতভাবে হজ ব্যবস্থাপনার মধ্যে এমন ফাঁকি ও দুর্বল নিয়ম রাখা আছে যার কারণে প্রতি বছরই হাজার হাজার হজযাত্রীকে পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ। পবিত্র হজব্রত পালন করতে গিয়ে এমন নাকাল হতে হবে তা তারা আগে কখনো কল্পনা করেননি।

হজ নিয়ে বাণিজ্যিক তৎপরতা, অনিয়ম ও দুর্ভোগ কেউ প্রত্যাশা করে না। কেউ চায় না পবিত্র নিয়তে হজ করতে গিয়ে কিছু মানুষের অসৎ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য পূরণের শিকারে পরিণত হতে। সব স্তর থেকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সংকটগুলো দূর করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।  হজের মতো পবিত্র ইবাদত নিয়ে সব দুর্নীতি, অনিয়ম ও বাণিজ্যিক তৎপরতা বন্ধ হোক, এই প্রত্যাশা প্রতিটি মুসলমানের।

 

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

 [email protected]

সর্বশেষ খবর