শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

ইউনূসে সামথিং : লাগাতার নাথিং

মোস্তফা কামাল

ইউনূসে সামথিং : লাগাতার নাথিং

ঘুরেফিরে কোনো না কোনোভাবে হালনাগাদেই থাকছে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যু। তা অন্যসব ইস্যুর মতো একেবারে তলানিতে পড়ছে না। বার বার ইস্যুটি জ্যান্ত করার উদ্যোক্তা সরকারই। তা আবার করেছে পুলিশি অনুমতি না দিয়ে ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক সামাজিক ব্যবসা সম্মেলন নিয়ে ক্যাচালের মাধ্যমে। পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় শেষমেশ রাজধানীর হোটেল লা মেরিডিয়ানে শুক্রবার শটকাটে এক দিনেই শেষ হয়েছে এই নোবেলজয়ীর সম্মেলন। এটি হওয়ার কথা ছিল ২৮-২৯ জুলাই সাভারের জিরাবোয়। ইউনূস সেন্টারের দাবি, প্রতিবারের বিভিন্ন সভা-সম্মেলনের আগের মতো এবারও তারা পুলিশসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়েছে। সম্মেলনের মাত্র এক দিন আগে পুলিশপ্রধান এ কে এম শহীদুল হক অনুমোদন না দেওয়ার কথা নিশ্চিত করেন। কারণ হিসেবে জানান সময়ের অভাবে ব্যাপক নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিতে না পারার কথা। এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ বা কথাশিল্পে না গিয়ে ওই রাতেই ইউনূস সেন্টার জানায় অনিবার্য কারণে সম্মেলন বাতিলের ঘোষণার খবর। ততক্ষণে এবং তার আগেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু প্রতিনিধি চলে আসেন ঢাকায়। তাদের নিয়েই হোটেলে ছোট পরিসরে করা হয় শান্তিতে নোবেলজয়ীর স্মল কনফারেন্স। শরিক হন ৫০টিরও বেশি দেশের ৪৪৩ প্রতিনিধি। উপস্থাপন হয় জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব ও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) সমন্বয়ক টমাস গাসের মূল বক্তব্য। বক্তব্য দেন বিশ্ব অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জোয়েল বোওজু, ইতালির এফএওর চিফ পার্টনারশিপ ইউনিটের রডরিগো ক্যাস্তানেদার মতো বিদেশি অতিথিরা। দেশ-বিদেশে বিশেষ বিশেষ মহলে চলছে ড. ইউনূসের এই সীমিত পরিসরে সম্মেলনের আলোচনা। বিশেষ করে সরকারের ভূমিকা। যেখানে সরকার নানা ছলে-কৌশলে যৌক্তিক নানা ইস্যু বরবাদ করে ছাড়ছে, সেখানে কেন চলমান করে ফেলছে ড. ইউনূস ইস্যুটি? তা অতিবুদ্ধি না নির্বুদ্ধিতার জের, এ নিয়ে রয়েছে নানা বািচত। উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রতিক ব্যাপক বন্যার মতো ইস্যুকে হালকা করতে পেরেছে সরকার। পানিসম্পদমন্ত্রী বলেছেন, এ বন্যা মিডিয়ার সৃষ্টি। গণমাধ্যমের অতি প্রচার। ঢাকা শহরে বৃষ্টির পানিতে মানুষের নাকানিচুবানিও সামথিং। ওয়াসার চেয়ারম্যান একে জলাবদ্ধতা বলতে মানা করেছেন। বলেছেন, এটি জলাবদ্ধতা নয়, জলজট। কারণ এ পানি জলাবদ্ধতার সূত্রে পড়ে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যতে বিনা বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতায় নাকাল হবে ঢাকা মহানগরী। সরতে না পারায় প্রতিদিন ব্যবহূত পানিই রাজধানীতে বন্যার দশা করে ছাড়বে। কিন্তু স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর মতে, এগুলো একদম বাজে কথা। আগামী বছর রাজধানীতে আর এমন বান ডাকবে না। বোঝালেন ঢাকার জলাবদ্ধতা মামুলি। এক বছরে তা বিনাশ করাও মামুলি। নাথিং কেস চলেছে চিকুনগুনিয়ার আজাব নিয়েও। রাজধানীতে চিকুনগুনিয়াকে মহামারী বলায় ভীষণ চটেছেন ঢাকার দুই নগরপিতা। তাগিদ দিয়েছেন মহামারী কাকে বলে সেই সংজ্ঞা ও সূত্র শিখতে। তাদের কথার তেজে চুপসে গেছেন ডাক্তারদের সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার রোগীশুদ্ধ স্বজনরাও। আর রহমতের পানির স্রোতে ঢাকার চিকুনগুনিয়াও পালিয়েছে। এর আগে, বন্যার ধকলে ক্ষতবিক্ষত নেত্রকোনা-সুনামগঞ্জের হাওরবাসীর দুর্গতি নিয়ে ছিল আইন শিক্ষার তাগিদ। দুর্গত বা দুর্যোগ কাকে বলে সেই সংজ্ঞা শোনানো হয়েছে। দুর্যোগ ও ত্রাণের মন্ত্রী এবং সচিব বলেছেন, দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি উত্থাপনকারীরা কাণ্ডজ্ঞানহীন। একটা ছাগলও মরেনি উল্লেখ করে দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের ২২ ধারার উদ্ধৃতি। এই ধারামতে, কোনো জনপদের অর্ধেকের উপরে আদম মারা না পড়লে ওই এলাকাকে দুর্গত বলা যায় না। আইনের চোটে খামোশ হয়ে গেছেন দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি উত্থাপনকারীরা। এত আদম মারা পড়ার অপেক্ষা করতে হবে? এ ছাড়া সবকের সঙ্গে বোনাস হিসেবে নাস্তানাবুদ হওয়া আর কত? চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ছাড়াও পার্বত্য তিন জেলায় পাহাড়ধসে দুই শরও কাছাকাছি নিহতের ইস্যুও নাথিংয়ের মতোই। দুই শর মৃত্যু সংখ্যা বিচারে দুর্যোগের সংজ্ঞায় পড়ে কিনা এ ভয়ে পাহাড়ি জনপদকে দুর্যোগ বা দুর্গত বলে ঘোষণার দাবিতে যায়নি কেউ। এর আগে, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১১০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি বা বেসিক ব্যাংকে সাড়ে ৫ হাজারেরও বেশি টাকা জালিয়াতিও নাথিং পর্যায়ে। বেসিকের অর্থ কেলেঙ্কারির হোতা আবদুল হাই বাচ্চু অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিতে বড় ভালো লোক। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হ্যাকিংয়ে ৮০০ কোটি টাকা চুরি সামথিং। সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের ৫ হাজার কোটি টাকা পাচারও নাথিং-সামথিংয়ের মতোই? অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এটি পাচার নয়, লেনদেন।

বাকপটুতায় অনেক কিছু তুড়ি মেরে ছুড়ে ফেলার এমন ইতিহাস গড়ার রেকর্ড তৈরি হয়েছে গত বছরকয়েকে। মুখপাণ্ডিত্যের বেশ কদরও তৈরি হয়েছে। এ ওষুধে সরকারের জটিল-কঠিন বহু ইস্যু সামলে নিয়ে নানান তরতাজা ইস্যুকে নিমেষে নাথিং করে দেওয়ার সক্ষমতা অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অসাধারণ বাচনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের মার খাওয়া হালে পানি পায় না। হাতের মারের আগে-পরে মুখের মার। ফখরুলের স্যান্ডো গেঞ্জি পরা কাতরানি ঢাকা পড়ে যায় আওয়ামী লীগ নেতার আবৃত্তি ও শিরোনাম উপযোগী মন্তব্যের তুড়িতে। ইস্যুর পর ইস্যু, এক ঘটনার আগে-পরে আরেক ঘটনা, কথার পিঠে কথায় জঘন্য অনেক ইস্যু গায়েব বা তামাদি করে দেওয়া যাচ্ছে সত্য। তনু, মিতু, এসপি বাবুল আকতারসহ কত ইস্যু তলানিতে চলে গেছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ঘটনা ৪৮ ঘণ্টার ঘুরপাকে মোটামুটি শেষ। ইউএনও সালমনের হাজত খাটার ঝামেলাও এখন মাটিচাপায়। ভারতে নিয়ে চিকিৎসার জেরে শাহবাগে কলেজছাত্র সিদ্দিকের দুই চোখ নষ্টের ইস্যুও তামাদির পথে। লুঙ্গি আর অর্চনার কচলানিতে ফরহাদ মজহার ইস্যু আরও আগেই খতম।

নানা বচন ও চাতুরীতে সক্ষমতার এ ধারা এভাবে বহমান থাকলে জের কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে? ধামাচাপা বা পাশ কাটানোতে সমস্যার সমাধানের ইতিহাস নেই। কথার খই ফুটিয়ে কোনো ইস্যুকে নাথিংকরণে বিকৃত বাহাদুরি বা ধূর্ততার তৃপ্তি থাকলেও সমাধান কি আসে? নাকি সমস্যার বিষফোঁড়ার সাইজটাই আরও বড় হয়? ড. ইউনূসকে নিয়ে কিছুটা সেই চর্চাই এগোচ্ছে। তার সম্মেলনে অনুমতি না দেওয়ার পক্ষে সময়স্বল্পতার সঙ্গে আইজিপি আরও কিছু যোগ করেছেন। বলেছেন, সাভারের যে এলাকায় সম্মেলন হওয়ার কথা সেখানে কয়েক দিন আগেও ‘সন্ত্রাসী’ ধরা পড়েছে। এতে ল্যাঠা কিন্তু আরও পোক্তই হয়েছে। এ রকম সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে বিদেশি অতিথিরা আসার আগেই কেন তৎপর হলো না পুলিশ? সাভারের ওই এলাকায় ‘সন্ত্রাসী’ পাওয়া গেছে, খোদ পুলিশপ্রধানের এমন তথ্যের অর্থ— ওখানে বিদেশিরা নিরাপদ নন। এ উদাহরণ টেনে বিদেশিরা যদি আবার বলতে শুরু করেন— বাংলাদেশ বিদেশিদের জন্য অনিরাপদ? আবার যদি শুরু হয় নিরাপত্তার অজুহাতে বিদেশি প্রতিনিধি দলের সফর বাতিলের ঘটনা?

সব মিলিয়ে অন্যান্য ইস্যুর মতো ইউনূস ইস্যু নাথিংয়ের লিস্টে না গিয়ে থেকে যাচ্ছে সামথিং হয়ে। সম্মেলনটি হতে দিলে সরকারের কী লস হতো, আর হতে না দেওয়ায় কী লাভ হয়েছে? আগের দিন পর্যন্ত অনুমতি ঝুলিয়ে রেখে ড. ইউনূসকে বিপাকে ফেলে কী লাভ হয়েছে সরকারের? বা দেশের? এসব প্রশ্নদৃষ্টে অন্তহীন বিশ্লেষণ বিভিন্ন মহলে। তুলনামূলক সাবলীল ব্যক্তিত্ব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ড. ইউনূস বিষয়ে কথাবাজিতে কম যাননি। তিনি বলেছেন, সরকার ড. ইউনূসের সম্মেলনে বাধা দেয়নি। নিষেধও করেনি। কথা তো ঠিকই। নিষেধ বা বাধা নয়ই, বরং সহযোগিতাও করেছে সরকার। ২০ জুলাই ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে পুলিশ কমিশনার, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আরও কিছু জায়গায় চিঠি দিয়ে সম্মেলনের কথা জানানোর পর সহায়তা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় র‌্যাব-পুলিশ ২৭ জুলাই মাঝরাত পর্যন্ত খেটেছে। সম্মেলন ভেন্যুতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আয়োজকদের সঙ্গে মিটিংও করেছে।

অনুমতি না দেওয়ার পক্ষে আরেক যুক্তিতে বলা হয়েছে, ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে এ সম্মেলনের বিষয়ে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কিছু জানানো হয়নি। এটি মারাত্মক অপরাধ। কিন্তু বাঙালি মুখপণ্ডিতি কি সব জায়গায় খাটে? মাসকয়েক ধরে প্রচার চালানো সম্মেলনটির কথা না জেনেই জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব থমাস গাসের সম্মানার্থে ডিনার থ্রো করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়? থমাস সেই ডিনারের আমন্ত্রণ কবুলও করেছেন। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো কারণ না জানিয়ে আচমকা বাতিল করা হয়েছে ডিনারটা। সম্মেলনটির উদ্দেশ্যে শত শত বিদেশি অতিথি বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ভিসা নিয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের সবাইকে ভিসা দিয়েছে। এর পরও বাংলাদেশ সরকার বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু জানত না প্রচারণা চালাকি না নির্বুদ্ধিতা? মহলবিশেষে ভিন্ন কথাও রয়েছে। তারা বলতে চান, হতে পারে ড. ইউনূসই বাংলাদেশকে বিপাকে ফেলতে শেষ মুহূর্তে অনুমতি চাওয়ার এ ফাঁদ পেতেছেন। উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয় বিষয়টি।  কিন্তু সরকার কেন পা ফেলবে সেই ফাঁদে? আমাদের এত শক্তিধর সরকারটি কি ইউনূস সেন্টারের চেয়ে কমজোরি? তেমন কিছু তো আরও ভয়ঙ্কর। ভীষণ শঙ্কার। সমূহ উদ্বেগের।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।

[email protected]

সর্বশেষ খবর