শনিবার, ৫ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

হজযাত্রীদের বিড়ম্বনা দেশে এবং বিদেশে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

হজযাত্রীদের বিড়ম্বনা দেশে এবং বিদেশে

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে প্রতি বছর লক্ষাধিক প্রেমিক হজের উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহর মুসাফির হন। হজের শুরুতে একজন প্রেমিকের চোখেমুখে যে আবেগ-উদ্দীপনার চিহ্ন ফুটে ওঠে, হজ শেষে কিন্তু তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না হজফেরত মানুষটির মাঝে। প্রশ্ন হলো, কেন এমন হয়? হজের শুরুর হাসি কোথায় হারিয়ে যায়? এর উত্তর খুবই সহজ। এসব হাজী প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ঠকবাজের পাল্লায় পড়েছেন। এজেন্সির কথামতো সব করেও সুন্দরভাবে হজ সম্পাদন করতে পারেননি তারা। এজেন্সি বলেছে, বায়তুল্লাহ এবং রওজাতুর রসুলুল্লাহর পাশেই বাসা দেবে, কিন্তু গিয়ে দেখে ঘর এত দূরে যে, এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ে বাসায় এলে আরেক ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পাওয়া সম্ভব নয়। এ তো গেল বাসার কথা। খাওয়া-দাওয়ারও একই হাল। মানহীন খাবার আর পানীয় দিয়ে শেষ হয় হজ সফর। গাড়ি-ঘোড়ার ঠিক থাকে না অনেক এজেন্সির। সব মিলিয়ে লেজেগোবরে হজ সম্পাদন করে দেশে ফেরেন বেশির ভাগ হাজী। কারও কারও ভাগ্য এতই মন্দ হয় যে, হজ ফ্লাইটের ডানায় চাপারও সৌভাগ্য হয় না। নানা জটিলতায়, এজেন্সির ভুলে ও অবহেলায় মিস হয়ে যায় হজযাত্রা। তখন তাকে আবার অপেক্ষা করতে হয় আগামী বছরের জন্য।

আল্লাহর ঘরের মেহমানদের প্রতি এই নিষ্ঠুর-নির্দয় আচরণ, প্রতারণা-ঠকবাজির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বললেই চলে। তাই এর প্রতিকারও হয় না বেশির ভাগ সময়। হাজীরা ভাবেন, কোনোরকম তো বেঁচে ফিরলাম— এই শুকরিয়া! আর কী অভিযোগ করব, ব্যবস্থা নেবই বা কী? আমার কি আর হজে যাওয়ার সৌভাগ্য হবে? হলেও এই এজেন্সিতে না গিয়ে অন্য এজেন্সিতে যাব। হাজী সাহেব তো জানেন না, অধিকাংশ এজেন্সির অবস্থা একই ধরনের। তাই হাজীদের সঙ্গে প্রতারণা রোধে হাজীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। আপনি আর হজ করেন বা না করেন, ভবিষ্যতে আপনার অন্য ভাইটির সঙ্গে যেন আর প্রতারণা না হয় তার একটা ব্যবস্থা আপনাকে করতেই হবে।

কয়েকজন হাজী তাদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে প্রায় কেঁদেই ফেলেন। বলেন, ‘বাবা! হাজীদের হয়রানি হয় ঘাটে ঘাটে। ঘর থেকে বের হয়ে আবার ঘরে ফেরা পর্যন্ত ধকল সামলাতে সামলাতে আধমরা হতে হয় একেকজনকে। এর সুষ্ঠু প্রতিকারের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তাহলে যদি কাবার মেহমানরা স্বস্তিতে হজ করতে পারেন।’ হজবঞ্চিত হাজীদের হয়রানির তো শেষ নেই। ভুল করে এজেন্সি, দোষ হয় ক্লায়েন্টের। চোখ-মুখ বুজে অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না ভুক্তভোগীদের।

শুধু যে এজেন্সির কারণে হাজীদের চোখে জল জমে তাই নয়, সরকারি কর্মকর্তাদের ভুলচুক আর অবহেলার কারণেও বড় ধরনের মাশুল দিতে হয় নিরীহ হাজীদের। ইন্টারনেটভিত্তিক হজ সিস্টেম হওয়ায় হাজীরা অনেক কিছু বোঝেন না, আবার তাদের সহজে বোঝাবে এমন কর্মকর্তারও অভাব— সব মিলিয়ে দুই পক্ষের ভুলের দায় এক পক্ষ, নিরীহ পক্ষটিকেই মেনে নিতে হয়। গত বছরের আগের বছর ভয়াবহ ফ্লাইট বিপর্যয় হয়েছে। শিডিউল অনুযায়ী খালি ফ্লাইট উড়াল দিয়েছে কিন্তু নির্ধারিত হাজীদের নেওয়া হয়নি। এটি হয়েছে কর্মকর্তাদের না বোঝার কারণেই। এ বছর প্রথম থেকেই এ অবস্থা চলছে। তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব। এ কারণে যদি হজে যাওয়ার নিয়ম-কানুনে পরিবর্তন আসে তবে আগে থেকেই হাজীদের জানিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু কপাল এতই খারাপ! এ দেশের হাজীদের তারা জানাবে কী, খোদ কর্মকর্তারাই বুঝে উঠতে পারেন না নতুন নিয়মগুলো। খাপ খাওয়ানো অনেক পরের ব্যাপার।

হাজীদের নিয়ে এ ধরনের আচরণ বোধহয় আমাদের দেশেই হয়ে থাকে। খোঁজখবর নিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি, অন্যান্য দেশে, এমনকি অমুসলিমপ্রধান দেশেও হাজীদের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। ঘর থেকে বেরোনোর পর থেকে শুরু করে আবার ঘরে ফিরে আসা পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয় বায়তুল্লাহর মুসাফিরদের জন্য। কোনো ধরনের প্রতারণা দূরের কথা, অনিয়মও কল্পনা করা যায় না কাবার মেহমানদের সঙ্গে।

হাজীদের নিয়ে সমস্যা আমাদের দেশে প্রতি বছরই হয়ে থাকে। তবে আমরা আশা করতেই পারি এ বছর থেকে এগুলো বন্ধ হবে। এজেন্সি থেকে শুরু করে সরকার পর্যন্ত হাজীদের সেবাদানে বিশ্বের বুকে এক অনন্য দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করবে— এ প্রত্যাশা রেখে এবং কাবার মেহমানদের সুন্দর-সুস্থ সফর কামনা করে আজকের লেখা এখানেই শেষ করছি।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

     www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর