বৃহস্পতিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

‘দেরে খাই’ বাহিনী কি সব খেয়ে ফেলবে

তুষার কণা খোন্দকার

‘দেরে খাই’ বাহিনী কি সব খেয়ে ফেলবে

ইংরেজ লেখক ডি এইচ লরেন্সের লেখা দি রকিং হর্স উইনার গল্পের কথা কি আপনাদের মনে আছে? গল্পের নায়ক একটি নিঃসঙ্গ ছোট ছেলে। নিঃসঙ্গ ছেলেটির বাবা-মা কাজে চলে যাওয়ার পরে সে নির্জন বাড়িতে একা একটা রকিং চেয়ারে বসে যখন দোল খেত তখন শূন্য বাড়ির চারদিকে আওয়াজ উঠত ‘দেয়ার মাস্ট বি মোর মানি-দেয়ার মাস্ট বি মোর মানি’। টাকা চাই-টাকা চাই, আরও চাই।  ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পরে মানুষের মনের সব কোমল আকাঙ্ক্ষার মরণ হয়েছিল। ডি এইচ লরেন্স সে সময়ে তার মহাদেশের মানুষের মনে দপদপ করতে থাকা টাকার ক্ষুধাকে নিঃসঙ্গ বালকের মুখে তুলে এনেছিলেন। গল্পের নিঃসঙ্গ ছেলেটির বাপ-মা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভোগবিলাসের ক্ষুধা মেটাতে তাদের ছেলেকে একা বাড়িতে রেখে গায়ে খেটে টাকা রোজগার করতে ঘরের বাইরে যেত। আমার দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। এখানে একশ্রেণির মানুষের মনে টাকার ক্ষুধা প্রবল কিন্তু তারা গায়ে খেটে টাকা রোজগার করতে রাজি নয়। আমি যে লোভী মানুষগুলোর কথা বলছি তাদের মনের দশা বর্ণনা করতে গিয়ে আমার লালনের কথা মনে পড়ছে। লালন বলেছেন, ‘রাত পোয়ালে পাখি বলে, দেরে খাই, দেরে খাই।’ লালন বাংলাদেশ নামের স্বাধীন দেশ কিংবা বাংলাদেশের বেশির ভাগ রাজনীতিবিদ কিংবা আমলা-কর্মচারীদের খাই খাই তাণ্ডব চোখে দেখার অনেক আগে মারা গেছেন। তবে মারা যাওয়ার আগে উনি ডি এইচ লরেন্সের সংলাপের মতো লাগসই একটি গান আমাদের জন্য রেখে গেছেন যার রব আমরা সবাই দিব্যি নিত্যদিনে নিজ কানে শুনতে পাচ্ছি। দেশের সর্বত্র ‘দেরে খাই, দেরে খাই’ ধ্বনিতে কান পাতা দায়। ‘দেরে খাই’ ধ্বনি বছরজুড়ে আমাদের চারপাশে নীরবে গুন গুন করে বাজতে থাকে বলে ওটি অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। মনের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধলেও মুখ ফুটে সেটি প্রকাশ করার সাহস পাই না কিংবা প্রকাশ করে কী হবে ভেবে আমরা সবাই চুপ করে থাকি। কিন্তু ‘দেরে খাই’ বাহিনী লুটে খাওয়া টাকার গরমে যখন বেধড়ক খুনখারাবিতে মেতে ওঠে কিংবা মানুষের ঘরের মেয়ে বৌয়ের ওপর চড়াও হয় তখন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত ভয়ঙ্কর ঘটনা জেনে আমরা নড়েচড়ে বসি। আমরা বিবেকের তাড়নায় নড়ে বসি তেমন ভেবে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। বরং বলা যায়, সংবাদ মাধ্যমে যখন কোনো ভয়াবহ ঘটনা প্রচার হয় তখন আমরা ভয়ে আর্তচিৎকার করতে থাকি যেটাকে সাদা চোখে প্রতিবাদের মতো মনে হয়। দৈনন্দিন জীবনে আমরা আমাদের চারপাশে হাজারটা অন্যায় কাজ ঘটতে দেখেও চুপ করে থাকি। ভাবী, পরের ওপর যা খুশি তাই হোক। আমি তো এখনো বেশ ভালো আছি। সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা অন্যায়ের প্রতিবাদ করাকে আমরা দায়িত্বের অংশ বলে পালন করি না বলে পাপ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। দিনে দিনে জমে ওঠা পাপের পাহাড় যখন আমাদের ঘাড়ে ধসে পড়তে চায় তখন  আমরা ভয়ে সমস্বরে আর্তচিৎকার করতে থাকি যেটাকে সংবাদ মাধ্যম প্রতিবাদ বলে প্রচার করে। আমরা যদি সত্যি প্রতিবাদ করতে জানতাম তাহলে আমাদের চোখের সামনে এত অনাচার বছরজুড়ে অবিরাম ঘটতে পারত না। বর্তমান সময়ে বগুড়ার শ্রমিক লীগ নেতা তুফান আলোচনার শীর্ষে আছে কারণ সে তার শহরের একটি মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে এবং ধর্ষিত মেয়ের মায়ের মাথার চুল কেটে ন্যাড়া করে দিয়েছে। তুফান শ্রমিক লীগের নেতা হওয়ার কল্যাণে অনেক দিন ধরে মানুষ খুন করা থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, ড্রাগ ব্যবসা, গুণ্ডামি অবাধে চালিয়ে গেছে বলে পত্রিকার পাতায় বিশদ বিবরণ প্রকাশ পাচ্ছে। শ্রমিক লীগের নেতা তুফান হাজারটা অপকর্ম করেও রাজনৈতিক পরিচয়ের জোরে অথবা আইন প্রয়োগকারীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার দক্ষতার গুণে এতকাল নির্ঝঞ্ঝাট পার পেয়ে গেছে। সে দিনের পর দিন ভয়ানক সব অপরাধ করে টাকার পাহাড় গড়েছে কিন্তু সে কখনো আইন ভাঙার দায়ে দায়ী হয়নি। এবার সে ধর্ষণের মতো অপরাধ করে সামাজিক প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। সমাজের মানুষ ভেবেছে, এমন ভয়ানক বেপরোয়া তুফান এবার না জানি কার ঘরের মেয়ে বৌয়ের দিকে হাত বাড়ায়। নিজেদের ঘরের মেয়ে বৌয়ের সম্মান হুমকির মুখে পড়ায় বগুড়ার মানুষের মনে আতঙ্ক দানা বেঁধেছে। তাই তারা দল বেঁধে গলা ফাটিয়ে আর্তচিৎকার করছে। মানুষের সমবেত চিৎকারকে প্রতিবাদ না বলে আর্তচিৎকার বলছি কারণ এলাকার মানুষের চোখের সামনে তুফান এতদিন অপরাধের বান ডাকলেও বগুড়া শহরের বাসিন্দারা কোনো দিন তার প্রতিবাদ করেনি। তুফানের ভয়াবহ আগ্রাসী আচরণে ভয় পেয়ে বগুড়াবাসী এখন যে কাজটি করছে সেটি স্রেফ আর্তচিৎকার। মানুষের আর্তচিৎকারে বিব্রত হয়ে তুফানের এতকালের প্রশ্রয়দাতা রাজনীতিবিদ কিংবা আশ্রয়দাতা পুলিশ নড়েচড়ে বসেছে। তারা এমন ভয়ানক বখাটেকে হজম করতে না পেরে আপাতত পেট থেকে উগড়ে দিয়েছে। শ্রমিক লীগ তুফানকে বহিষ্কার করেছে। তুফানকে বহিষ্কার করলে কি শ্রমিক লীগের দায়মুক্তি হয়ে যাবে? লীগ-দল-পার্টি, যখন যে ক্ষমতায় থাকে সেই দলই তুফানদের জন্ম দিয়ে পরম আদরে লালন করতে থাকে। কারণ তুফানরা লুটপাট করে যে টাকা কামাই করে সেটি তারা স্বার্থপরের মতো একা ভোগ করে না বরং লুটের টাকার বিশাল অংশ তারা তাদের জন্মদাতা-আশ্রয়দাতা-পালনকর্তাদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে অবাধে অপকর্ম চালিয়ে যাওয়ার লাইসেন্স বাগিয়ে নেয়। তুফানকে লীগ থেকে বহিষ্কার করার দায়সারা নাটক করে একজন তুফানের দায়িত্ব তাত্ক্ষণিক কাঁধ থেকে ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু তাতে রাজনৈতিক আশ্রয় এবং পুলিশি প্রশ্রয়ে তুফান পয়দা হওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছু মানুষ নামের প্রাণী তুফান হয়ে যাচ্ছে সেই সংস্কৃতি বদলাতে হবে। দেশে প্রকৃত রাজনীতিবিদ কেউ অবশিষ্ট থাকলে তাকে বুঝতে হবে রাজনৈতিক কর্মী তৈরির প্রক্রিয়া এবং সংস্কৃতি আদ্যপান্ত পচে গেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নীতিনির্ধারকরা কি মনে করেন, তুফানকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে তারা প্রমাণ করেছেন ‘পুলিশ জনগণের বন্ধুু? তুফানরা প্রথম যেদিন চাঁদাবাজি করে সেদিন তারা পুলিশের বন্ধু হয়ে যায় বলেই তারা এতখানি বাড় বাড়তে পারে। তুফানের ঘটনার মতো একটি বড় ঘটনা যখন ঘটে তখন পুলিশ তুফানদের রাজনৈতিক পরিচয়কে বড় করে তুলে ধরে জনগণকে বলতে চায় তারা কত অসহায়! অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয়ের দোহাই মেনে নিয়ে জনগণ কি মনে করে পুলিশের কিছু করার ছিল না। তুফান এতদিন এত কুকীর্তি করে যে টাকা কামাই করেছে সেটা কি সে একা ভোগ করেছে নাকি তার আশ্রয়দাতা রাজনীতিবিদ, প্রশ্রয়দাতা পুলিশের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে। আমরা জানি বগুড়ার শ্রমিক লীগের তুফান কিংবা তার ভাই যুবলীগের মতিন এতদিন যাদের সঙ্গে ড্রাগের টাকা চাঁদার টাকা ভাগ করে খেয়েছে সেসব ক্ষমতাবান সবাই অভিযোগের বাইরে রয়ে যাবে।

বাংলাদেশের রাজধানী কিংবা দেশের আনাচে-কানাচে চাঁদাবাজি করার মতো অপরাধ করার জন্য একজন অপরাধীকে এখন দেশে উপস্থিত থাকার দরকার হয় না। তারা কেউ প্যারিসে কেউ বা কলকাতায় বসে ঢাকা শহরে দিব্যি চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে বলে পত্রিকার খবরে পড়লাম। যেসব গুণ্ডা দূরে বসে চাঁদাবাজি করছে তারা সশরীরে দেশে উপস্থিত নেই বলে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না এমন গল্প কি জনগণ বিশ্বাস করে? মানুষ জানে দেশের ভিতর চাঁদাবাজির নেটওয়ার্কে যুক্ত গুণ্ডারা কেউ প্রবাসী নয়। তারা প্রশাসনের হাতের মুঠায় বসে কোনো  প্রবাসী গুণ্ডার নামে টাকা তুলছে এবং সেই টাকা দেশের ভিতরে যেমন ভাগবাটোয়ারা করছে আবার একইভাবে তার একটা অংশ তারা দেশের বাইরে পাচার করে নিশ্চয়ই সেখানেও সেটি ক্ষমতাবানদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করছে। দেশের বাইরে যে টাকা পাচার হচ্ছে সে টাকা কি প্রবাসী গুণ্ডারা একা ভোগ করছে? আশির দশকে পাকিস্তানে যখন সামরিক শাসক জিয়াউল হকের শাসন সে সময় পিপলস পার্টির অনেক নেতা ইউরোপ আমেরিকায় বাস করত। প্রবাসী নেতারা দূর দেশে বসেও কীভাবে গুণ্ডামির টাকার ভাগ পেত সেটি জানার জন্য আমি আপনাদের পাকিস্তানের লেখিকা তাহমিনা দূররানীর লেখা মাই ফিউডাল লর্ড বইটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করব। তাহমিনা দূররানী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা, এক সময় পাঞ্জাবের গভর্নর মোস্তফা খাঁর সাত নম্বর স্ত্রী। মোস্তফা খাঁর সঙ্গে তার দাম্পত্য জীবনের অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে রাজনীতিকদের আয়ের উৎস সম্পর্কে তিনি যে আভাস দিয়েছেন সেটি আমাদের জানা উচিত। পাকিস্তানে জিয়াউল হকের শাসনামলে মোস্তফা খাঁর যখন বার্মিংহামে বাস করতেন তখন তার বিলাসের টাকা কোথা থেকে আসত তাহমিনা দূররানী সেটি তার বইয়ে বর্ণনা করেছেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে এত কলুষ পুঞ্জীভূত হোক এটি আমরা চাই না। 

আমাদের দেশে খেটে খাওয়া মানুষের সুনাম আছে। আমাদের কৃষক স্ট্রবেরি, কফি কিংবা আঙ্গুর ফলানোর মতো কঠিন কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের ছোট ছোট কারখানাগুলো একটা লেদ মেশিন সম্বল করে জাপানি যন্ত্রাংশের বিকল্প যন্ত্রাংশ বানাতে পারে। এসব কাজ আমরা করি আমাদের বুদ্ধি, মেধা এবং পরিশ্রমের জোরে। খেটে খাওয়া মানুষের সাফল্যের কৃতিত্ব বলতে গেলে ফর্দ অনেক লম্বা হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের সাফল্যের লম্বা ফর্দ ‘দেরে খাই’ বাহিনী বার বার ছিঁড়ে ফেলে। এত খাটনি করেও ‘দেরে খাই’ বাহিনীর পাপের জন্য ভালো কাজের সুফল আমরা ভোগ করতে পারছি না। রাজনীতিবিদরা তাদের ‘দেরে খাই’ পোষা পাখিগুলোকে সামলাতে পারবেন কিনা জানি না, তবে খেটে খাওয়া মানুষের নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থে ‘দেরে খাই’ বাহিনীকে সামাজিকভাবে নির্মূল করতে হবে। 

           লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর