শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

শোকের মাস হোক আত্মোপলব্ধির উৎস

নূরে আলম সিদ্দিকী

শোকের মাস হোক আত্মোপলব্ধির উৎস

যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ, তার বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতায় যাদের অথবা যাদের পূর্বসূরিদের অবদান আছে, পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে এই রক্তস্নাত বাংলার যেসব দামাল ছেলে অভিষিক্ত; ৪৭ থেকে ’৭১—এই দীর্ঘ পথপরিক্রমণে একেকটি আন্দোলনের সোপান উত্তরণের মাঝে একেক গুচ্ছ তরুণ তাজা তপ্তপ্রাণ অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। কিন্তু এসব কিছুরই পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ প্রতীক ছিলেন জাতির জনক, আমার প্রাণের মুজিব ভাই। আগস্ট মাসটি বাঙালি জাতির তথা বাংলাদেশের জন্য শোকের মাস। কিন্তু আমার জন্য এটি হৃদয়ের রক্তক্ষরণের মাস; অনুভূতি, উপলব্ধি ও মননশীলতার পরতে পরতে অসহ্য ও তীক্ষ যন্ত্রণা সহ্য করার মাস। আজ ৪২ বছর হলো, মুজিব ভাই আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু আমার অনুভূতিতে, বিশ্বাসে এটা আজও পুরোপুরি সত্যরূপে প্রতিভাত হয় না। আমার মননশীলতা, অনুভূতি, হৃদয়ের অনুরণন, কোনো জায়গায় বঙ্গবন্ধু নেই বা তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন—এটা মানতে পারে না। আমার স্বপ্নের মধ্যে তো বটেই, জাগরণেও তাঁর উপস্থিতি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করি। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি, এ এক ব্যতিক্রম অভিজ্ঞতা। নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে রাখি, দীর্ঘ কারারুদ্ধ জীবনের মধ্যে ১৭টি মাস প্রত্যহ এত দীর্ঘ সময় ধরে আমি যে তাঁর নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছি, বাস্তবে কারাগারের বাইরে অথবা ভিতরে অনুজ তার অগ্রজের, সন্তান তার পিতার এত নিবিড় সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য হয় না। যেটি আল্লাহর অশেষ রহমতে আমার হয়েছে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী পূর্ণায়ত পদ্মের মতো উদ্ভাসিত যৌবনের অধিকারী। আজকের যুবকরা সেটি অনুধাবন করতে অক্ষম, এটি আমি শতভাগ নিশ্চিত। তখন আমাদের পুরো জীবনটা চেতনার সমস্ত অংশটুকু রাজনীতির সমুদ্রের অতলান্তে নিমজ্জিত। এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, চাওয়া-পাওয়া সব কিছুই ছিল রাজনৈতিক চেতনার গভীরে নিমগ্ন। বাংলার স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের কল্পনার আবর্তে আর কোনো কিছুই তখন দোলা দিত না। এই যে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরণ—এর অগ্রভাগে ছিলেন মুজিব ভাই। তিনি ছিলেন আন্দোলনের স্থপতি। তাঁর কালজয়ী নেতৃত্বকে ঘিরেই আবর্তিত হয় প্রতিটি আন্দোলনের স্রোতধারা। এই স্রোতধারার স্রষ্টা ছিল ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুকে বহুজনের মধ্য থেকে একক নেতৃত্বে প্রতিস্থাপিত করার পূর্ণ কৃতিত্ব ছাত্রলীগের। রাজনৈতিক চেতনা হিসেবে আমাদের চিন্তায়, মননশীলতায় সুরের মূর্ছনা তুলত— ‘এ মাটি আমার সোনা, আমি করি তার জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা’, ‘সে কবির বাণীর লাগি কান পেতে আছি যে আছে মাটির কাছাকাছি’, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। লাহোরে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে যখন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে আইয়ুবকে উত্খাত করার জন্য পাকিস্তানের সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সর্বদলীয় কর্মসূচি গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেই সম্মেলনের প্রারম্ভে বঙ্গবন্ধু তখনকার পূর্ব-পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশের তরফ থেকে ছয় দফা কর্মসূচিকে আন্দোলনের প্রধান কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করার দাবি তোলেন। এ কর্মসূচিটা তখনকার দিনে প্রশাসনে যারা বাঙালি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন—সর্বজনাব আহমদ ফজলুর রহমান, রুহুল কুদ্দুস, শামসুর রহমান খান জনসন ভাই, অর্থনীতিবিদ নূরুল ইসলাম, রেহমান সোবহানসহ কয়েকজন প্রতিভাপ্রদীপ্ত সিএসপি অফিসার ছয় দফা কর্মসূচিটি গ্রন্থনা করে চরম আস্থা ও প্রতীতির প্রতীক বাংলার মানুষের স্বার্থের প্রশ্নে আপসহীন, অকুতোভয়, দৃপ্ত চেতনার ধারক শেখ মুজিবের হাতে তুলে দেন। শেখ মুজিব ছয় দফা প্রস্তাবটি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সর্বদলীয় বৈঠকে উপস্থাপন করেন। মুজিব ভাই তখন এতটাই প্রদীপ্ত ও অকুতোভয় মানসিকতায় উজ্জীবিত ছিলেন যে, ছয় দফা স্বাধীনতার উপক্রমণিকা—এটি তাঁর প্রতীতি ও প্রত্যয়ে পরিণত হয়।

তিনি ওই সম্মেলনে নির্ভীক চিত্তে বলেন, আইয়ুব স্বৈরাচারী সামরিক শাসক, একনায়ক, গণতন্ত্রের হত্যাকারী—সবই সত্য। তার স্বৈরশাসনের অবসানও অপরিহার্য। কিন্তু তার অবসানে আমার পূর্ব-বাংলার মানুষের মুক্তি ও কল্যাণ বয়ে আসবে না। তার পরিবর্তে যে কোনো ছুতোয়-ছলনায় আরেকজন ক্ষমতায় এসে স্বৈরাচারী হিসেবেই প্রতিভাত হবেন। বাংলাদেশের মানুষের ওপর অবিচার ও শোষণের অবসান হবে না। বরং শোষণের চারণক্ষেত্র হিসেবেই ব্যবহূত হবে। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে আরও বলেন, স্বৈরাচারের অপসারণ চাই, আরও দৃঢ়ভাবে চাই আমার পূর্ব-বাংলা যেন শোষণের চারণক্ষেত্র হিসেবেই অব্যাহতভাবে ব্যবহূত না হয়। আমার কৃষকের বুকের রক্ত পানি করা অর্থায়নে করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ ধূসর মরুভূমি থেকে নয়নাভিরাম মহানগরীতে পরিণত হতে দেখেছি।

কাশ্মীরের জন্য বার বার যুদ্ধ হয়, অথচ আমার সোনার বাংলা সম্পূর্ণ অরক্ষিত থাকে। তিনি আরও বলেন, কাশ্মীরে পাকিস্তানি সৈন্য প্রবেশের প্রাক্কালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী লাহোর আক্রমণ না করে যদি পূর্ব-পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ) আক্রমণ করতেন, তাহলে অনতিবিলম্বে গোটা পূর্ব-পাকিস্তানটাই বাধা-বিমুক্ত অবস্থায় ভারত দখল করে নিতে পারত। মুজিব ভাই এটাও উল্লেখ করতে ভুল করেননি, যুদ্ধবাজ আইয়ুব ও তার সামরিক জান্তা পূর্ব-পাকিস্তানকে রক্ষা করার ন্যূনতম দায়িত্ববোধের পরিচয় দেননি। ’৬৫-এর যুদ্ধ প্রমাণ করেছে, পূর্ব-পাকিস্তান অক্ষত ছিল পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিরোধ শক্তির কারণে নয়, ভারত তার নিজের রণকৌশলেই পূর্ব-পাকিস্তানকে তাদের আক্রমণের আওতার বাইরে রেখেছিল বলে। তিনি আরও কৌতুক করে বলেছিলেন, ১৬০০ মাইল দূরত্বে হলেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একই দেশের অংশবিশেষ। সেখানে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসলে কাস্টম চেকিং-এর বেড়াজাল পেরিয়ে তবে আসতে হয়। পূর্ব-পাকিস্তানে ব্যবহূত টাকার বিপরীতে কোনো রিজার্ভ সোনা বা ডলার কিছুই নেই। জিন্নাহ সাহেবের ছবি ছাপা নোটগুলো সোনা বা ডলারের কোনো শক্তিরই ভিত্তি ছিল না। গতানুগতিক ধারায় চালাতো, তাই চলতো। রাজনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে একই রাষ্ট্রের প্রদেশসমূহে এমন অসহনীয় ও নির্লজ্জ বৈষম্য, আর্থিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় এমন করুণ দশা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এই অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে ছয় দফা কার্যকর করাই একমাত্র রক্ষাকবচ। ওই গোলটেবিলে উপস্থিত পাকিস্তানের দুই অংশেরই রক্ষণশীল নেতারা অন্ধকারে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলেন। আর আইয়ুব খানসহ সামরিক জান্তার কাছে তো সাপের লেজে পা দেওয়ার মতোই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ছিল ওই কর্মসূচি। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, পাকিস্তান সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকেই সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন সমন্বিতভাবে একটা অপ্রতিরোধ্য জান্তা তৈরি করে। যার মুখ্য কেন্দ্রভূমি ছিল পাঞ্জাব। আর নিকৃষ্ট শোষণের শিকার ছিল পূর্ব-পাকিস্তান। অন্য প্রদেশগুলোও যেন পাঞ্জাবিদের জমিদারির একেকটি তালুক ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য চারটি প্রদেশ শোষিত ছিল; কিন্তু কখনোই তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানের মতো দৈন্যদশা তাদের ছিল না। ছয় দফা প্রদানের প্রাক্কালে তখনকার শেখ মুজিবুর রহমান এমনকি পূর্ব-পাকিস্তানের অনেক নেতার মধ্যে অন্যতম ছিলেন। কিন্তু ছয় দফার দাবি উপস্থাপনের পর ছাত্রলীগের নিরলস ও নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলনের বিস্তীর্ণ পথপরিক্রমণের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ তাঁকে বাংলার মানুষের হৃদয়ের সিংহাসনে মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। আমি আমার লেখনী, এবং টক-শোর আলোচনায় প্রতিবারই বলেছি এবং আমৃত্যু বলতেই থাকব, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, স্থপতি, মূর্তপ্রতীক কিন্তু একে বাস্তবায়িত করার সুদক্ষ রাজনৈতিক সৈনিক ও প্রতিস্থাপনের মূল কারিগর সন্দেহাতীতভাবে ছাত্রলীগ ও তার নেতৃত্ব। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুকে প্রাণের চাইতে বেশি ভালোবাসলেও আমি অস্বস্তি বোধ করি, যখন আজকের প্রজন্ম এবং তখনকার বুদ্ধিজীবী মহল, যারা বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে সিআইয়ের দালাল, ভারতের অনুচর হিসেবে আখ্যায়িত করতেন, দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি চাইতেন—তারাই আজ ভোল পাল্টে সর্বকালের সর্বনিকৃষ্ট চাটুকার হয়ে স্বাধীনতার একক কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে বন্দনা-অর্চনা করে সরকার ও আওয়ামী লীগে তাদের অবস্থানকে ক্রমাগতভাবে সুদৃঢ় করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃতি দিয়েই আমি বলতে পারি, আমাদের প্রজন্মে আমার চাইতে স্নেহভাজন, বিশ্বস্ত ও প্রিয়পাত্র মুজিব ভাইয়ের আর কেউ ছিল না। তবুও স্বাধীনতার দীর্ঘ আন্দোলনের একক কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকে দেওয়ার পক্ষপাতী আমি নই। এখানে ছাত্রলীগ তো বটেই, ইত্তেফাক, তার সম্পাদক মানিক ভাই (তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া), বার্তা সম্পাদক শহীদ সিরাজউদ্দীন হোসেনের অনবদ্য সাহায্য-সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতাকে অস্বীকার করলে গোটা ইতিহাসটিই বিকৃত হয়ে যাবে। আজকের রাজনীতির এই ডামাডোলের ক্রান্তিলগ্নে নতুন প্রজন্মকে অবহিত করা আমার নৈতিক দায়িত্ব, ছয় দফাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে গিয়ে ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ হয়েছিল। মানিক ভাইও কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। সর্বজনাব শহীদ সিরাজউদ্দীন হোসেন, মরহুম আসফ উদদৌলা রেজা, মাহমুদ উল্লাহ ভাইসহ অগণিত সাংবাদিক ও সংবাদপত্রকর্মী অনাহারে-অর্ধাহারে কী যে দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন ইত্তেফাক বন্ধ থাকাকালীন কাটিয়েছেন, আজকে তা কল্পনা করাও কঠিন। হাইব্রিড নেতারা তো বটেই, অন্য দল থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা সাইবেরিয়ান পাখিগুলো যারা বামধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিন্ন করে নৌকায় শুধু আশ্রয়ই নেননি, নৌকার মালিকই বনতে চলেছেন; আজকে শেখ মুজিবের রক্ত যাদের ধমনীতে প্রবাহিত— শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সময় বয়ে যাচ্ছে, মস্কো, পিকিং, জাসদ, গণবাহিনী—তাদের সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কূট-কৌশল ও ষড়যন্ত্রের জাল সিরাজ শিকদার বাহিনী ও গণবাহিনী কর্তৃক নৃশংস হত্যাকাণ্ড, ঈদের জামাতে সংসদ সদস্য কিবরিয়া ও রাজবাড়ীতে আরেক সংসদ সদস্য কাজী হেদায়েতকে হত্যা ১৫ আগস্টের বেদীমূল রচনা করেছিল। জাসদ নেতৃত্ব এবং মস্কো, পিকিংয়ের নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুকে কী অশ্লীলভাবে কখনো জাতির পিতা না জুতার ফিতা, শেখ মুজিবের চামড়া দিয়ে ঢোল বানাবো, হাড্ডি দিয়ে ডুগডুগি বাজাবো— এ সমস্ত অশোভন ও নির্মম উক্তি করেছেন।

স্মরণ করলে আজও গর্ব ও প্রশান্তিতে আমার বুক ভরে ওঠে, ১৯৭০-এর নির্বাচনের কিছুকাল আগে ছাত্র ইউনিয়নকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই তারাই আজকে ছাত্রলীগের প্রকৃত নেতৃত্বকে প্রায় নির্বাসিত করে ফেলেছে! যে নৌকার গুন টানতে গিয়ে আমাদের মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেছে, আজকে শেখ হাসিনাকে সামনে বসিয়ে ক্ষমতার পাল তুলে চরম প্রশান্তিতে ক্ষমতার সিংহ ভাগ ভোগ করছেন তারা। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সামরিক বাহিনীর ধিকৃত, চাকরিচ্যুত ও বিপথগামী ২৬ জন কর্মকর্তা ও সৈনিক নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করে। কিন্তু নানারকমের মিথ্যা অপপ্রচারের মাধ্যমে দেশবাসী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সূক্ষ্ম কারিগরের মতো সিরাজ শিকদারের বাহিনী, গণবাহিনী, জাসদ তিলে তিলে এর পটভূমিকা রচনা করে। আফসোস, এককালে সর্বজনবিদিত এই নিগূঢ় সত্যিগুলো আজ রাজনীতিতে বিস্মৃতপ্রায়। ক্ষমতা ও প্রশাসন ভ্রান্ত বামের দখলে। আগস্ট এলে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ তো হয়-ই, একটা আশঙ্কায় সমস্ত হৃদয় কুঁকড়ে কেঁদে ওঠে। ভ্রান্ত বামেরা ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনাকে যেভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছেন, এর শেষ পরিণতি সামাজিক বিপর্যয়ে রূপ নেবে না তো? মৌলিক অধিকার-বিবর্জিত আজকের এই সমাজ ব্যবস্থায় কোনো উন্নয়ন টেকসই হয় না। অধিকার-বিবর্জিত মানুষ স্বস্তি পায় না, নিঃসংশয় চিত্ত হতে পারে না। এই হৃদয়বিদারক আগস্ট মাসে আল্লাহতায়ালার কাছে আমার ফরিয়াদ, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গে শহীদ সবার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত, জঙ্গি-সন্ত্রাস ও মুরতাদদের হাত থেকে স্থায়ী বিমুক্তি। সেটা আসার একমাত্র উপায়, আগামী নির্বাচনটিকে সবার অংশীদারিত্বে সফল করা এবং এর একমাত্র উপায় হলো, ‘জননেত্রী’ ও ‘দেশনেত্রী’র দাম্ভিকতা ও ক্ষমতালিপ্সা বিবর্জিত মানসিকতা, যা অনুষ্ঠিত নির্বাচনটিকে দেশে-বিদেশে শুধু গ্রহণযোগ্যই করে তুলবে না, বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর প্রতিস্থাপিত করবে। বঙ্গবন্ধুর রুহের মাগফিরাতের সঙ্গে সঙ্গে এটিও আমার একান্ত ফরিয়াদ। একটি নিরপেক্ষ সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচনই জাতির স্বাধীনতাকে সুসংহত করতে এবং প্রান্তিক জনতার কাঙ্ক্ষিত সমাজব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আর এটা অর্জন করতে হলে বিভাজন নয়, সত্যিকার ও সঠিক অর্থে সর্বস্তরের মানুষকে যার যার ক্ষেত্রে সক্রিয় ও সরব হতে হবে।

স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন আওয়ামী লীগের আমি কঠোর সমালোচনা করি এ কারণে যে, তারা যেন পথভ্রষ্ট না হয়। ক্ষমতার দাম্ভিকতায় আদর্শচ্যুত না হয় এবং ক্ষমতার মূলভিত্তি প্রান্তিক জনতাকে যেন বেমালুম বিস্মৃত না হয়। যে কোনো বাহিনীর ওপর অন্ধ নির্ভরতা আওয়ামী লীগের জন্য বেমানান। মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রকৃত উৎস প্রান্তিক জনতা।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর