রবিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রতিকার চিকিৎসকেরই হাতে

ড. সাখাওয়াৎ আনসারী

সম্প্রতি দেশের দুটি দৈনিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহর দুটি লেখা প্রকাশ হয়েছে। প্রথমটির শিরোনাম ‘চিকিৎসায় অরাজকতা আর সংঘাত নয়’, আর দ্বিতীয়টির শিরোনাম ‘চিকিৎসাসেবা কর্মীদের নিরাপত্তা আইন জরুরি’।  লেখা দুটি মোটামুটি কাছাকাছি বিষয়সমৃদ্ধ। লেখক চিকিৎসক হওয়ার কারণেই হয়তো চিকিৎসক ও চিকিৎসা-সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি বার বার তার লেখায় উঠে এসেছে। কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠ অর্থাৎ রোগীর স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টি কীভাবে নিশ্চিত করা যায় এবং কী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেই বা হামলা বন্ধ করা যায়, সে বিষয়টি যথাযথ আলোচিত হয়নি বলেই আজকের এ লেখা।

হামলার ঘটনা ঘটে দুটো কারণে : রোগীপক্ষের লোকজনের কাছে কোনো কারণে যদি মনে হয়, এক. ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে, এবং দুই. রোগীর প্রতি চিকিৎসক বা সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে। লেখক বলেছেন, “আমাদের দেশে মৃত্যু হলেই... ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তোলা হয়, যদিও চিকিৎসকের এই ‘ভুল’ নির্ণয় করার কোনো যোগ্যতা তাদের নেই।” লেখকের এ বক্তব্যকে আমলে নিয়ে তাহলে এমন প্রশ্ন করতেই হয়, চিকিৎসকের এই ভুল নির্ণয়ের যোগ্যতা যেহেতু শুধুই চিকিৎসকদের, সেহেতু তারা গত সাড়ে চার দশকে সারা দেশে তদন্তের মাধ্যমে কতগুলো ভুল চিকিৎসা নির্ণয় করেছেন, কতজন চিকিৎসক বা চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তারা এ জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছেন, কতজনের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। সাড়ে চার দশকে এ দেশে ভুল চিকিৎসার সংখ্যা কত, সে পরিসংখ্যান কে দেবে? ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের এ দেশের পুরো এলাকাজুড়ে প্রতিদিন যদি একটি করে ভুল চিকিৎসার ঘটনা ঘটেছে বলেও ধরে নেওয়া হয়, তাহলেও সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১৭ হাজারের মতো। লেখক উল্লেখ করেছেন, ‘চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা বিএমডিসির রয়েছে। ক্লিনিক আর হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি বিভাগ রয়েছে।’ আমাদের জানতে ভারি ইচ্ছা হয়— কতজনের জন্য বিএমডিসি এ যাবৎ শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। চিকিৎসকের এক শতাংশ অর্থই কিন্তু সহস্রাধিক। যে বিভাগের কথা বলা হয়েছে, সেটি কটি হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে? যদি এমন যুক্তি উপস্থাপিত হয় যে, রোগীপক্ষকে বিএমডিসির কাছে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উত্থাপন করতে হবে, তাহলে কী এ প্রশ্ন করা যায় না, চিকিৎসকদের ভুল নির্ণয়ের কোনো যোগ্যতা যাদের নেই, তারাই কীভাবে ভুল চিকিৎসা হয়েছে, এমন অভিযোগ শুধু উত্থাপনই নয়, প্রমাণও করবেন।

এবার দায়িত্বে অবহেলা প্রসঙ্গ। অবহেলা বা দায়িত্বহীনতার অজস্র উদাহরণ চারপাশের হাজার হাজার লোকের মুখে তুবড়ির মতো ফোটে। অবহেলার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত অসদাচরণ, কটুবাচন এবং অহমিকা বোধেরও। বাংলাদেশে চিকিৎসকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সম্পর্কে বহুলভাবে যে কথাগুলো বলা হয়ে থাকে, ‘ডাক্তার বাজে ব্যবহার করে’, ‘কথাই বলে না’, ‘খ্যাচ খ্যাচ করে’ ইত্যাদি। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, দেশে একটি বড় সংখ্যার চিকিৎসক আছেন, যারা আচরণে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে মার্জিত নন। স্বীকার করছি, তারা ছাত্র হিসেবে মেধাবীই ছিলেন, অন্তত সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে যারা পাস করেছেন। কিন্তু এর অর্থ কোনোভাবেই এই নয়, অন্য পেশায় মেধাবীরা যাননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, আমলাদের একটি বড় অংশসহ অনেক পেশার অনেক ব্যক্তিই ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন। যে শিক্ষা মানুষকে বিনয়ী করে না, সে শিক্ষা প্রকৃতার্থে কোনো শিক্ষাই নয়। ভালো এবং বড় চিকিৎসক অর্থ কোনোভাবেই দুর্বিনীত হয়ে ওঠা নয়। তারা কিন্তু বাই অ্যাক্সিডেন্ট নয়, বাই চয়েসেই চিকিৎসক হয়েছেন। সুতরাং কী রোগী, কী রোগীর লোকজন, কারও সঙ্গেই তারা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে পারেন না। বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজ কি জানে না যে, মানুষের ক্ষুব্ধতা ও অসন্তুষ্টির মূল জায়গা এটিই?

চিকিৎসকের অবহেলা-দায়িত্বহীনতার একটি উদাহরণ এখানে উপস্থাপন করছি। হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে নিয়মিত ডিউটি আওয়ারের পরে ফার্স্ট অন কল, সেকেন্ড অন কল প্রথা চালু রয়েছে। অন কলে থাকেন জ্যেষ্ঠ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। কখনো কোনো রোগীর অবস্থার অবনতি হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের হাসপাতালে আসতে বললেই সাধারণত তারা বিরক্ত হন। হাসপাতালে আসার দায়িত্ব এড়ানোর জন্যই তারা প্রায়ই দায়িত্বরত চিকিৎসককে হয় মামুলি উপদেশ দেন, নয়তো এমন কটুবাক্য বলেন, ‘এটুকুই যদি সামাল দিতে না পারেন, চাকরি ছেড়ে দিলেই তো পারেন।’ শুধু অন কলের ক্ষেত্রেই হাজার হাজার দায়িত্বে অবহেলার বিষয়ে গোটা চিকিৎসক সমাজেরই কি কোনো সদুত্তর আছে? লেখককে বলছি, ‘নিজের চিকিৎসক পরিচয় গোপন রেখে আপনিই কোনো হাসপাতালে কোনো জটিল রোগ নিয়ে যান, ভর্তি হয়ে কদিন থাকুন, হাসপাতালে প্রবেশ থেকে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা হবে, তা কতখানি তিক্ততার, হাড়ে হাড়ে টের পাবেন।’

বস্তুত, হামলার প্রতিকার করতে পারেন চিকিৎসক সমাজই। যে দুই কারণে হামলা হয়, তার প্রথমটি অর্থাৎ ‘ভুল চিকিৎসা’ নির্ণয় করার যোগ্যতা যেহেতু চিকিৎসকেরই, সুতরাং যথাযথ এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক পরিমাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও পত্রিকায় ফলাও করে প্রচারের মাধ্যমে রোগীর আস্থা অর্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। রোগীর চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রবেশের অব্যবহিত পর থেকেই যদি চিকিৎসক এবং সংশ্লিষ্টরা রোগীপক্ষকে রোগীর অবস্থা এবং রোগের ধরন ও গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে পুনঃ পুনঃ ধারণা দানের বিষয়টি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন, তাহলে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ থেকে তারা শতভাগ নিষ্কৃতি পাবেন বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। রোগীর অবস্থা এবং রোগের ধরন সম্পর্কে অজ্ঞতাই যেহেতু রোগীপক্ষের ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উত্থাপনের কারণ, সেহেতু রোগীপক্ষকে প্রাজ্ঞতা দানের শতভাগ দায়িত্ব বর্তায় চিকিৎসকদের ওপর।  এই সহজ কথাটি না বললেও চলে। আর দ্বিতীয়টি, অর্থাৎ দায়িত্বে অবহেলার প্রতিকারও তাদেরই হাতে। তারা যদি রোগীপক্ষের সমস্যাগুলো মন দিয়ে শোনেন, তাদের অভিযোগগুলো যথাযথ আমলে নেন, ঔদ্ধত্যপূর্ণ, দুর্বিনীত এবং অহংশীল আচরণ না করে সদাচরণ ও সুবাচনে নিষ্ঠাবান হন, তাহলে রোগীপক্ষ দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলবে না বলেও  আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

 

লেখক : অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর