এক. ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় আমরা হারিয়েছি বাংলা ও বাঙালির আরাধ্য পুরুষ, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অভিশপ্ত এই দিনটিতে জাতির ললাটে যে কলঙ্ক তিলক পরানো হয়েছিল, তার আনুষ্ঠানিক দায়মুক্তি ঘটেছে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি, দীর্ঘ ৩৪ বছর পর। বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম বিলম্বিত সুবিচার প্রায় বিরল; এ দিক থেকে নিশ্চিতভাবেই আমরা গর্ব করতে পারি। এই বিচারের মধ্য দিয়ে তমসাচ্ছন্ন একটি অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এরপরও কি আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, বাংলাদেশের জাতীয় জীবন থেকে ঘোর তমসা বা ষড়যন্ত্রের ইতি টানা গেছে? একদিকে জাতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে জাতির পিতাকে, লাখো মানুষের ভিড় নামে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে, সেই সঙ্গে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়, যেখানে ঘাতকরা এই মহাপুরুষকে অশ্রদ্ধায় শুইয়ে রেখেছিল; অন্যদিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পুরনো ও নতুন ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের গোপন ও প্রকাশ্য তৎপরতা ঝালিয়ে নেয়। তারা মৃত শেখ মুজিবকে অস্বীকার করার কূটকৌশল রপ্ত করে। কারণ বাঙালি শেখ মুজিব ধর্মতান্ত্রিক ও সামরিক আধিপত্যবাদী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছিলেন। মুসলিম প্রধান বিশ্ব জনপদে তিনিই প্রথম একটি আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৌল সংকট বুঝতে হলে, আমার বিশ্বাস, এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে এবং সাহস ও যোগ্যতায় সামনে এগিয়ে অপশক্তিকে রুখবার শক্তি সঞ্চয় করতে হবে।
স্বীকার করতে দ্বিধা থাকা উচিত হবে না যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ফসল। সে দিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মুসলিম প্রধান দেশগুলোর বেশির ভাগ পাকিস্তানের বিভক্তি সমর্থন করেনি। সমর্থন করেনি গণচীনও। তারা প্রায় সবাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের হাতে নির্বিচার গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন সমর্থন করেছে, তথাকথিত রাষ্ট্রকৌশল ও ধর্মরক্ষার নামে! অতএব দেশি-বিদেশি চক্রান্তের ফসল হিসেবে, বিশ্বাসঘাতক কিছু সপক্ষীয় রাজনীতিকের যোগসাজশে, সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী উচ্চাভিলাষী সদস্যের নির্মম বুলেটে নিহত হতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। প্রাণ হারাতে হয়েছে তার পরিবারের নিকটতম সদস্য ও আত্মীয়দের।বাংলাদেশের রাষ্ট্রের সংকট বুঝতে হলে আরও বুঝতে হবে কেন সেই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আত্মস্বীকৃত খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি; কেন দীর্ঘ সময় তাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে? খুনিদের প্রতি এই সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতা ছিল প্রায় প্রকাশ্যেই, পঁচাত্তর থেকে প্রায় দুই যুগ। অতএব ঘাতকদের রাজনৈতিক অনুসারী কে বা কারা— তাকে চিহ্নিত করতে হবে, অন্যথায় বাংলাদেশের রাজনীতির স্বরূপ বোঝা যাবে না।
হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় সব দেশেই। এই বিচার ঘটে আইনের শাসনের স্বার্থে, সুবিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে, সভ্যতার স্বার্থে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচার ঠেকাতে আইন করা হয়েছিল। দীর্ঘ ২১ বছর এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথে কাঁটা হয়েছিল ওই কালো আইন। কিন্তু ওখানেই শেষ নয়। বিচার প্রক্রিয়া শুরু ও বিচারিক আদালতের রায় ঘোষণা করা হলেও, উচ্চ আদালতের অনুমোদন বাধাগ্রস্ত করা হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাঁচ বছরেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের আপিল শুনানি করা যায়নি! ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পরই কেবল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি উচ্চ আদালতে ওঠে। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের বিপুল নির্বাচনী বিজয়ের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার নতুন করে ক্ষমতাসীন হলে চূড়ান্ত বিচারের কাজটি শুরু হয়। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি কারাগারে আটক পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। বিভিন্ন দেশে আজও পালিয়ে আছে আরও ছয় খুনি।
আরও অনুধাবন করা সঙ্গত হবে যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ ২১ বছর তার হত্যার বিচার হয়নি তা-ই নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতির মৃত্যুবার্ষিকীও পালিত হয়নি রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে! ১৫ আগস্ট অতিবাহিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় অবহেলায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই কেবল দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হতে শুরু করে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয় শোক দিবস বাতিল করে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় শোক দিবস এবং সরকারি ছুটি পুনর্বহাল করে।
বঙ্গবন্ধু সব সময়েই বলতেন, বাংলাদেশ এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে, কেউ তাকে ধ্বংস করতে পারবে না। নিশ্চিতভাবেই জানি, পারবে না। কারণ ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। লাখো নারীর সম্ভ্রম বৃথা যেতে পারে না। লাখো মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। এর পরও কথা থাকে। বঙ্গবন্ধু কখনো কী ভেবেছিলেন কেউ তাকে হত্যা করতে পারে, তারই সৃষ্ট বাংলাদেশে? তিনি কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন তার মৃত্যুর পর এই বাংলাদেশে আবারও পাকিস্তানি ভাবধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সচেতন প্রয়াস দানা বাঁধবে?
বিগত ৪৬ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তবতা হচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধীরা বসে নেই। মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতির অনুসারীরা বিভেদে জর্জরিত। সেই সুযোগে বিরুদ্ধবাদীরা সংগঠিত; তারা বাংলাদেশকে হারিয়ে দেওয়ার প্রকাশ্য যুদ্ধে লিপ্ত। যারা বাংলাদেশ চায়নি, তারা বাংলাদেশকে ধ্বংস করতে তৎপর, দেশে এবং বিদেশে। এই মূল্যায়নকে সামনে রেখে ১৫ আগস্ট পালন করা হলে স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ, বাংলাদেশের জনকের প্রতি উপযুক্ত সম্মান দেখানো হবে বলে আমি মনে করি।
দুই. যারা মনে করেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বিপদের মাত্রা কমতে শুরু করেছে, আমি তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিপদের সত্যিকার স্বরূপ বুঝতে হলে একদিকে যেতে হবে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর কাছে, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কাছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম পুরুষকে নিয়ে, যার অতুলনীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরাধীন জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল, যার অসীম প্রেরণা বাঙালির জাতীয় শক্তি ও সাহসের উৎস হয়েছিল, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, তার মৃত্যুর এতকাল পরও, কেন আঘাত করার চেষ্টা হয়?
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধবাদীদের অপপ্রচারের নানা কারণ আছে। প্রধান কারণ তিনি পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-কাঠামো ও সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক এবং সফল জনবিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন— যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। সেই গণবিদ্রোহ এতটাই তীব্র ছিল যে, একদিকে তা শোষণ-বঞ্চনা ও স্বৈরতন্ত্রী পাকিস্তান ভেঙেছে, অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক আধুনিক একটি রাষ্ট্রকে সাংবিধানিকভাবে ভিত্তি দান করেছে। ভুললে চলবে না যে, ১৯৭২-এর রাষ্ট্রীয় সংবিধান অনুযায়ী বিশ্বের গোটা মুসলিম প্রধান জনপদের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত।
বঙ্গবন্ধু যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন, ‘ধর্ম ব্যক্তি জীবনের বড় অবলম্বন; কিন্তু রাষ্ট্র হচ্ছে ধর্ম-বর্ণ, ছোট-বড় নির্বিশেষ সকলের সমান অধিকারের ক্ষেত্র।’ রাষ্ট্রপিতা এটিও উপলব্ধি করেছিলেন যে, ‘ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রনীতি ধর্মের ঔদার্যকেই কেবল খর্ব করে না, সব মানুষের রাষ্ট্রকেও সীমিত করে, জনজীবন বিভাজিত করে।’ তাই তিনি একজন খাঁটি ধর্মানুসারী হয়েও ধর্মের রাজনীতিকে সমর্থনের কারণ তিনি খুঁজে পাননি। সে কারণেই পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে স্বদেশে ফিরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক-হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনকের এ ঘোষণাটি ছিল তার কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণের। এর বাস্তবায়নের পথে তিনি যখন মনোনিবেশ করেছিলেন, যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে তিনি নতুন করে গড়ে তুলতে আরেক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন, ঠিক তখনই তাকে হত্যা করা হয়।
আরও একটি কথা অনুধাবন করা সঙ্গত হবে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের অনুসারীরা কখনই বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তা গ্রহণ করতে পারেনি। বাঙালি যখনই অসাম্প্রদায়িক জাতীয় গৌরব নিয়ে সামনে এগিয়েছে, তার বিরোধীরা তখনই ‘ইসলাম গেল’ বলে চেঁচিয়েছে। বাঙালি জীবনের প্রাণপ্রবাহের মূল শক্তিকে তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের শোরগোলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী কমবেশি বিভ্রান্ত হয়েছে। অথচ কয়েক যুগের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বাঙালি কখনো ধর্মচ্যুত হয়নি, বরং পরিপূর্ণভাবে ধর্মের মর্যাদা রক্ষা করে সে তার অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার গৌরবকে দৃঢ় করেছে। হোক সে ধর্মগতভাবে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ, বাঙালি ধর্মকে কখনো বিভাজনের অস্ত্র বানায়নি।
ব্রিটিশ-ভারতের বিভক্তি ও উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক হানাহানির আলোকে বেড়ে ওঠা মুজিব যথার্থই বুঝেছিলেন, ধর্ম কিংবা সামরিক বাহিনী-কেন্দ্রিক রাজনীতি পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে প্রতারিত করবে, কাজেই এর বিরুদ্ধে লড়াই করাই যোগ্যতম রাজনীতি। এই উপলব্ধিতে তিনি যখন বাংলাদেশ সৃষ্টির নেতৃত্ব দিলেন, তখন ধর্ম ও বর্মবাদী রাজনীতির কুশীলবরা ভীত হয় বৈকি। অতএব বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কৌশল আঁটা হলো, দেশে এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরুদ্ধবাদী নানা সব বিদেশে। তারা সফলও হলো।
কিন্তু হত্যাকারীদের দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫-এর রক্তপাতের পর থেকেই হত্যাকারীদের মুখোশ উন্মোচন হতে থাকল। কারণ তারা সদ্য-স্বাধীন দেশে পাকিস্তানি ধারার পুরনো রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে স্বচেষ্ট হলো, যা তারা চেয়েছিল। জেনারেল জিয়ার শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাসিক্ত রাষ্ট্রীয় সংবিধানকে ইচ্ছামতো কাটছাঁট করা হলো, রাষ্ট্রকে নতুন করে সাম্প্রদায়িক করা হলো। সেই থেকে শুরু হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পেছন যাত্রা। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সামাজিক অগ্রসরতা শুরু হয়েছিল পঁচাত্তরের রক্তপাতের পর তা পেছনযাত্রা শুরু করল! ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশকে একটি নতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা নেওয়া হলো!
কেবল বঙ্গবন্ধু নন, তার হত্যাকারীরা মুক্তিযুদ্ধের গোটা নেতৃত্বকে শেষ করতে উদ্যত হয়েছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধের চার নেতা— সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে বন্দী অবস্থায় কারাগারে হত্যা করেছিল; উত্খাত করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সরকারকে।
বাংলাদেশ, পূর্বেকার পূর্ববাংলা এমন এক জনপদ যেখানে জাতি-ধর্মের সম্মিলিত প্রয়াসেই সব মৌল জাতীয় অর্জন সাধিত হয়েছে। ইতিহাস সাক্ষী, যখনই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি আসন গেড়েছে তখনই বিপন্নতা গ্রাস করেছে। আজ যখন মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বাতাস বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশে শুভবুদ্ধি ও স্বাধীন সংস্কৃতিচর্চাকে ধ্বংস করতে উদ্যত, তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি বক্তব্য মনে পড়ে। এই মনীষী অনেক আগেই বাংলার মাটিতে বাংলাভাষীদের যৌথ জীবনের অনস্বীকার্যতা উপলব্ধি করেছিলেন, মর্মে মর্মে। তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, সেই ১৯৪৮ সালে : ‘এই অঞ্চল যেমন বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমানের স্মারকলিপি হয়ে আছে, প্রার্থনা করি তেমনই এ যেন নতুন রাষ্ট্রে জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সব নাগরিকের মিলনভূমি হয়। আমিন। আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জোটই নেই।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি রাজনীতিকে মধ্যযুগীয় সাম্প্রদায়িক আবর্ত থেকে উদ্ধার করে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ধারায় প্রবাহিত করেছিলেন। প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতিসত্তাকে তিনি রাষ্ট্র পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭০ এর দশকের বাঙালি মানসে যে অভূতপূর্ব দেশপ্রেম, তা ছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে অভাবিত উজ্জীবিত করার; আগের ঐতিহাসিক আন্দোলনগুলোতে যা সম্ভব হয়নি, তা-ই সম্ভব করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আরও একটি বিষয় লক্ষ করার মতো। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিপদের স্বরূপ বুঝতে হলে বাংলাদেশ-বিরোধী আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতার বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এই মহল পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, এমন কি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে নীরব ভূমিকা পালন করেছিল। এমন কি তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনকের হত্যাকারীদের সুরক্ষারও ব্যবস্থা করেছিল। পঁচাত্তর পরবর্তীকালে যে সামরিক ও আধা-সামরিক শাসকরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের পুনর্বাসন করেছিল, এই আন্তর্জাতিক মহল তাদেরও পৃষ্ঠপোষকতাও করেছিল!
মোটকথা, ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিকে তারা পাকিস্তানের আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিল। বাংলাদেশের মাটিতে আরেকটি নতুন পূর্ব পাকিস্তান তৈরির পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। একের পর এক আঘাত চালিয়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তির ওপর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর।
ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর এই আঘাত চলতে থাকে প্রায় দুই যুগ। ভুললে চলবে না, ধারাবাহিক এবং পরিকল্পিত এই আগ্রাসনে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অনেকটাই পথভ্রষ্ট হয়েছে, অনেকটাই বিভাজিত হয়েছে, নতুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ প্রতারিত হয়েছে, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের গৌরব পর্যন্ত খণ্ডিত করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা বাঙালি জাতিসত্তার অসাম্প্রদায়িক চৈতন্যের ব্যাপ্তি ও শক্তি বুঝতে ব্যর্থ হয়। কাজেই তাদের ষড়যন্ত্রের সাফল্য স্থায়ী হয়নি। ইতিহাসের নিজস্ব শক্তি আছে, সে তার আপন শক্তি নিয়ে মাটি ফুঁড়ে বিকশিত হয়েছে, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ আবারও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বা তাদের সমর্থক-অনুসারীদের আলাদা করে দেখার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। যে নামেই আবির্ভূত হোক না কেন, এরা যে কোনো উপায়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে উত্খাত বা আঘাত করতে বদ্ধপরিকর থাকবে। কারণ, তারা এতে নিজেদের অস্তিত্ব সম্পন্ন মনে করে! সে কারণেই ১৫ আগস্টের শোক পালনের তাৎপর্য উপলব্ধি করার প্রয়োজন আছে। এ উপলব্ধিকে সামনে এগিয়ে নিতে প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় শক্তির সম্মিলন, একাত্তরের মতো লড়াই। এ লড়াই বাংলাদেশ রাখার, এ লড়াই কেবল বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের একার নয়, এ লড়াই বাংলাদেশের স্বাধীনতাপন্থী সবার।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও সাংবাদিক।