বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নিয়ে কথা

হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নিয়ে কথা

লেখকের সঙ্গে চলচ্চিত্রের তিন ব্যক্তিত্ব

গত ৫ আগস্টের কথা। যৌথ প্রযোজনার ছবি আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য হুমকি কিনা— এ বিষয় নিয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির উদ্যোগে ইউসিবি পাবলিক পার্লামেন্টে একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।  জাতীয়ভিত্তিক এ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দেশের সেরা দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকস বিতার্কিকরা। আয়োজনে অতিথি হয়ে এসেছিলেন দেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন, জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ফারুক এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর। চমৎকার এই আয়োজনে শিক্ষার্থীরা যুক্তি-তথ্য, চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা, বৈশ্বিক বাস্তবতার আলোকে চলচ্চিত্র নির্মাণ, চলচ্চিত্র ব্যবসার গতি-প্রকৃতি ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে এক প্রাণবন্ত আলোচনায় মেতে ওঠে। বিতার্কিকদের সঙ্গে অতিথিরা যে বিষয়গুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন সেটা হলো— বর্তমান চলচ্চিত্র শিল্পের দুর্গতি, একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়া, পৃষ্ঠপোষকতা ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রকে ঘিরে ভারত-বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অভিযোজনকে। আলোচনায় সবাই যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবং ভারতের সমান স্বার্থের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন।

অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা-লেখক-সাহিত্যিক-নাট্যকার আমজাদ হোসেন বলেন, সাম্প্রতিককালে যৌথ প্রযোজনার নামে যা হচ্ছে তা অসম ও প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। সরকার একটি নতুন কমিটিকে দায়িত্ব দিয়েছে যৌথ প্রযোজনা সংক্রান্ত টেকসই নীতিমালা করতে। নতুন নীতিমালা ভারসাম্যপূর্ণভাবে সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে করা হলে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন সংক্রান্ত সংকট দূর হবে। চিত্রনায়ক ফারুক বলেন, দেশের চলচ্চিত্রকে অবশ্যই এ দেশের মানুষের জীবনাচার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। অনুষ্ঠানে তিনি নবাব এবং বস টু ছবি দুটিকে যৌথ প্রযোজনার ছবি নয় বলে মন্তব্য করেন। অভিনেতা মিশা সওদাগর বলেন, যৌথ প্রযোজনা নিয়ে কোনো আপত্তি নেই, তবে যৌথ প্রযোজনার ছবি হতে হবে সুস্পষ্ট নিয়মনীতির ভিত্তিতে। যেখানে দুই দেশের কলাকুশলী ও বিনিয়োগকারীর স্বার্থের ভারসাম্য থাকবে। তিনি সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া নবাব ছবিতে নায়িকার পোশাক বাংলাদেশের সঙ্গে একেবারেই সামঞ্জস্য নয় বলে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

এবার একটু পেছনে ফিরে দেখি। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারতের উদ্যোগে যৌথ প্রযোজনার ছবি তৈরি নিয়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট শিল্পী-কলাকুশলীরা যতটা ক্ষুব্ধ বা প্রতিবাদী হয়েছেন এর আগে কখনই এমনটি দেখা যায়নি। এ বছর ঈদুল ফিতরের আগে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার দুটি ছবি নবাব এবং বস-টু এর প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক এবং আন্দোলন। সিনেমা সংশ্লিষ্টরা একে অপরের সঙ্গে বিবাদেও জড়িয়ে পড়েন। বিশেষ করে কলাকুশলী এবং সিনেমা প্রদর্শকরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। এরই ধারাবাহিকতায় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটে। প্রদর্শক সমিতির সভাপতি এবং মধুমতি সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদকে এফডিসিতে অপমান করা হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক থেকে শুরু করে কলাকুশলী, সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ সবখানেই উত্তপ্ত অবস্থা তৈরি হয়। আলোচিত বস টু সিনেমায় নায়ক ভারতের জিৎ আর নায়িকা বাংলাদেশের নুসরাত ফারিয়া। অন্যদিকে নবাব ছবিতে নায়ক বাংলাদেশের শাকিব খান আর নায়িকা কলকাতার শুভশ্রী। নির্মাতা ও কলাকুশলীদের পক্ষেও ‘নবাব’ এবং ‘বস টু’ সিনেমা নিয়ে ফেসবুক এবং ইউটিউবে ব্যাপক প্রচারণা চলে। বাংলাদেশের নায়ক শাকিব খান, নায়িকা নুসরাত ফারিয়া এবং কলকাতার নায়ক জিৎ এবং নায়িকা শুভশ্রী তাদের নিজস্ব ফেসবুক পেজে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করে ছবি দেখার জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু এফডিসিকেন্দ্রিক সিনেমার কলাকুশলীদের ১৬টি সংগঠনের সমন্বয়ে গড়া ‘চলচ্চিত্র পরিবার’ ঘোষণা করে তারা কোনোভাবেই কথিত যৌথ প্রযোজনার ছবি মেনে নেবে না। নবাব এবং বস-টু যেন মুক্তি দেওয়া না হয় এ বিষয়ে তারা তথ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। অনুরোধ না মানায় এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খানসহ বেশ কয়েকজনকে ‘চলচ্চিত্র পরিবার’-এর পক্ষ থেকে এফডিসিতে নিষিদ্ধ করা হয়। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে চলচ্চিত্র শিল্পীরা এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন যে, তারা খোদ তথ্যমন্ত্রীরও পদত্যাগের দাবি করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন বলে ঘোষণা দেন। ঈদ উপলক্ষে অবশ্য ছবি দুটি ঢাকা, রাজশাহী, খুলনার বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়া হয়। দুটি ছবিই দেখার জন্য দর্শক সমাগম ছিল বেশ ভালো।

শেষমেশ তথ্যমন্ত্রী এফডিসির পুরনো প্রিভিউ কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি প্রণয়নের ঘোষণা দিলে ‘চলচ্চিত্র পরিবার’ আপাতত তাদের আন্দোলন থেকে সরে আসে। নতুন কমিটি এখন একটি ভারসাম্যপূর্ণ টেকসই নীতিমালা করবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে শুরু থেকেই শিল্পী সমাজ বার বার বলে আসছে তারা যৌথ প্রযোজনার ছবির বিপক্ষে নন। যৌথ নীতিমালায় স্পষ্টভাবে যা যা বলা আছে, সেগুলো অনুসরণ করতে হবে। যৌথ প্রযোজনা চলচ্চিত্র নির্মাণে দুই দেশের পরিচালক, স্ক্রিপ্ট রাইটার ও মুখ্য শিল্পীসহ সমানুপাতিক হারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এসব কিছুই মানা হচ্ছে না বলে আন্দোলনের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। শিল্পী-কলাকুশলীদের আন্দোলনের কারণেই নতুন নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বেশ আগে থেকেই যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মিত হয়ে আসছে। মূলত মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ১৯৭৩ সাল থেকে যৌথ প্রযোজনার ছবির সূচনা হয়। মেধাবী নির্মাতা প্রয়াত আলমগীর কবীরের পরিচালনায় ধীরে বহে মেঘনা ছবিটি ছিল এই উদ্যোগের প্রথম প্রয়াস। সে সময় এ ছবির দুটি উল্লেখযোগ্য গানে কণ্ঠ দেন জনপ্রিয় শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। একই বছরের ২৩ জুলাই আশীর্বাদ চলচ্চিত্রের প্রযোজনায় ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় তিতাস একটি নদীর নাম ছবিটি মুক্তি পায়। যেটি এখনো দর্শকনন্দিত এক ক্লাসিক্যাল সিনেমা। শুধু ভারতের সঙ্গেই নয়; ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও কানাডার সম্মিলিত উদ্যোগে আলোচিত দূরদেশ ছবিটি মুক্তি পায়। বাংলাদেশের প্রখ্যাত পরিচালক এহতেশাম এবং ভারতের অমরিশ পরিচালনা করেছিলেন বহুল প্রশংসিত এ ছবিটি। ছবিটির বাংলাদেশের প্রযোজক ছিল মধুমিতা মুভিজ। দূরদেশ ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন আমাদের দেশের দর্শকনন্দিত নায়িকা ববিতা। ওই সময়ে বলিউডের চারজন সুপারস্টার অভিনয় করেছিলেন এই ছবিতে। ভারতের শশী কাপুর, শর্মিলা ঠাকুর, রাজ বব্বর এবং পারভিন ববি— এই চার শিল্পীর সঙ্গে বাংলাদেশের সুপার স্টার ববিতা ও পাকিস্তানের সুপার স্টার নাদিম ছিলেন বাড়তি আকর্ষণ। ‘দূরদেশ’-এর নব্বই ভাগ শুটিং হয়েছিল কানাডার বিভিন্ন লোকেশনে। একটি গানের শুটিং হয়েছিল ভারতে। কিছু দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিল বাংলাদেশে। অসাধারণ লোকেশনের পাশাপাশি ছবির শ্রুতিমধুর গান মন জয় করে নিয়েছিল দর্শকদের। এই ছবির ‘যেও না সাথী চলেছ একেলা কোথায়’— গানটি সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় বাংলা গানের তালিকায় জায়গা করে নেয়। এ ছবিটিই ওই সময় ‘গেহরি চোট’ নামে হিন্দি ভাষায় একই বছর মুক্তি পেয়েছিল। ‘গেহরি চোট’ তথা ‘দূরদেশ’ সার্কভুক্ত দেশগুলোর সংস্কৃতি বিনিময়ের ধারণাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে এসেছিল। আসলে দূরদেশ ছবিটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর যৌথ প্রযোজনার ছবি ঘিরে নতুন নতুন উদ্যোগ গড়ে উঠতে থাকে।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সরকার যৌথ উদ্যোগের ছবি নির্মাণের ব্যাপারটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে একটি নীতিমালা তৈরি করে। এরপর দীর্ঘ বিরতিতে ২০১২ সালে যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রের জন্য নতুন নীতিমালা তৈরি করা হয়। ২০১২ সালের নীতিমালার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, যৌথ প্রযোজনার সিনেমার ক্ষেত্রে দুই দেশের শিল্পী ও কলাকুশলীর সংখ্যানুপাত সমান রাখতে হবে। চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে দুই দেশ সমান প্রাধান্য পাবে।

কিন্তু সাম্প্রতিককালে যৌথ প্রযোজনার ছবিতে শর্ত না মানার কথা বলছেন কলাকুশলীরা। অবশ্য সরকার তথা তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে বলা হয়, শর্ত মেনে এবং রিভিউ কমিটির প্রত্যয়ন সাপেক্ষে ছবি মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে যেসব সিনেমা নির্মিত হচ্ছে, এসবের বেশির ভাগেরই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া। এর আগে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে অনেকগুলো যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে আশীর্বাদ চলচ্চিত্র। এদের প্রথম যৌথ প্রযোজনার ছবি অবিচার। পদ্মা নদীর মাঝির মতো কালজয়ী সিনেমাও উপহার দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। তাদের শেষ ছবিটি শঙ্খচিল। এ ছাড়াও হঠাৎ বৃষ্টি, মনের মাঝে তুমি, মনের মানুষ, আশেকী, শিকারী— যৌথ প্রযোজনার এই ছবিগুলো দর্শক নন্দিত হয়।

এর আগেও আমরা দেখেছি যৌথ প্রযোজনার ছবি ব্লাক মুক্তিকে কেন্দ্র করে শর্ত ভাঙার অভিযোগ। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর মোতাবেক এ সিনেমাটিকে ঘিরে দুই দেশের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের চুক্তি ছিল, একই সময়ে দুই দেশে ছবিটি মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু এ ছবির বাংলাদেশ অংশের প্রযোজক সে সময় অভিযোগ করেন, কলকাতার প্রযোজনা সংস্থা দাগ ক্রিয়েটিভ মিডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড চুক্তির শর্ত ভেঙেছে। তারা বাংলাদেশের প্রযোজক প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়ে একতরফাভাবে কলকাতায় ছবিটি মুক্তি দিয়েছে। এতে করে বাংলাদেশের প্রযোজনা সংস্থা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পরবর্তীতে এ ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। প্রেম কি বুঝিনি নামে একটি ছবির ক্ষেত্রেও একই ধরনের অভিযোগ উঠলে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডকে নির্দেশ দেয় তথ্য মন্ত্রণালয়। এর আগে নায়করাজ রাজ্জাকও যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।  দেশের শীর্ষ এক দৈনিক পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘১৯৮৬ সালের যৌথ প্রযোজনার নীতিমালায় সব দেশের শিল্পীদের সমান হারে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল। নতুন নীতিমালায় কিছু জায়গা সংশোধন করা হয়েছে। এখনকার নীতিমালায়ও বেশ কিছু নিয়ম বলবৎ থাকলেও ঠিকমতো সেই নিয়ম মানা হচ্ছে না। কেন এবং কার স্বার্থে নতুন করে নীতিমালা তৈরি করতে হয়েছে জানি না।’ একই ধরনের কথা বলেন চিত্রনায়িকা সুচন্দাও। তিনি বলেন, ‘দুই দেশের তারকা শিল্পীদের একমঞ্চে হাজির করতে, নতুন স্বাদ যোগ করতে যৌথ আয়োজনে চলচ্চিত্র নির্মাণ হতেই পারে, যা আগেও হয়েছে। কিন্তু নীতিমালা যদি সঠিক না হয়, তাহলে উভয় পক্ষেরই ক্ষতি হবে।’ জনপ্রিয় অভিনেত্রী ববিতা যৌথ প্রযোজনার ছবিতে শুধু অভিনয় নয়, পাশাপাশি ছবি নির্মাণও করেন। যৌথ প্রযোজনার ছবি নিয়ে তিনিও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শিল্পী-কলাকুশলীদের মূল ক্ষোভের জায়গাটা কোথায় তা কারও অজানা নয়। এটা তো সত্য, কেউ স্বীকার করুক বা না করুক যৌথ প্রযোজনার বিষয়টিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে একটি পক্ষ অধিক মুনাফা লাভের বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়েছে। তারা দেশীয় শিল্পী ও সংস্কৃতি রক্ষার ব্যাপারে যত না সচেষ্ট, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী অধিক মুনাফা লাভে। এই গোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রচ্ছন্ন সুবিধা পেয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সিনেমার সমগ্র শিল্পী-কলাকুশলীর দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে যৌথ প্রযোজনার ছবির নতুন নীতিমালা প্রণয়নে যে কমিটি গঠন করেছেন সেটি অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। নতুন কমিটিতে যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তাদের সিনেমাকেন্দ্রিক জ্ঞান, চিন্তা, অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষ মানুষও। এখন শুধু প্রয়োজন সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো। আশা করি, কমিটি দ্রুতই সবার অংশগ্রহণ ও মতামতের আলোকে একটি উন্নত নীতিমালা উপহার দিয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হবে। যৌথ ছবি নির্মাণের অবশ্যই ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। গল্প, পরিচালক, শিল্পী, মুনাফা সবখানেই সমান অংশগ্রহণ ও সুযোগ থাকতে হবে। সমান স্বার্থরক্ষা সংরক্ষিত হলেই সুষ্ঠু সমাধানে আর কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। নতুন নীতিমালাটি এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে, যেন সেটা দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল রাখতে সক্ষম হয়। আমরা যেন নিছক কারও বা কোনো দেশের ভোক্তাতে পরিণত না হই।

সবশেষে বলব, দেশের সিনেমা শিল্প যখন চরম দুরবস্থায় তখন যৌথ প্রযোজনার ছবি তৈরি ও প্রদর্শন নিয়ে শিল্পী-কলাকুশলী, প্রদর্শকদের মাঝে যে বাদ-বিভাজন তৈরি হয়েছে সেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি ৮ আগস্ট তাদের বার্ষিক সাধারণ সভায় অভিনেতা মিশা সওদাগর, চিত্রনায়ক রিয়াজ, পরিচালক বদিউল আলম খোকন ও প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু অভিনীত, প্রযোজিত ও পরিচালিত কোনো ছবি সিনেমা হলে প্রদর্শন না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের ওপর হামলার বিচার না হলে সিনেমা হল বন্ধ করে দেওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি। যার মধ্য দিয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান চলচ্চিত্র শিল্পের সহাবস্থানের পথকে রুদ্ধ করেছে। আশার কথা দুই পক্ষ ইতিমধ্যে সমঝোতার পথে এসেছেন। উঠিয়ে নিয়েছেন নিষেধাজ্ঞা।

হল মালিক, বুকিং এজেন্ট, শিল্পী-কলাকুশলীরা একে অপরের সঙ্গে বাদ-বিবাদে জড়িয়ে পড়লে সেটা মোটেই আমাদের ঐতিহ্যবাহী চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য মঙ্গলজনক নয়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সব বিরোধের অবসান ঘটিয়ে চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি সময়কে ফিরিয়ে আনতে হবে। মান-অভিমান ভুলে সবাইকে একমঞ্চে কাজ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, সবার অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে যুগোপযোগী যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণের নীতিমালা প্রণয়ন করা হলে দুই দেশই লাভবান হবে।  দুই দেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ও সম্পর্ক আরও জোরদার এবং দৃঢ় হবে। সিনেমায় ফিরে আসবে সুদিন, আগের সেই প্রাণচাঞ্চল্য।

লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর