বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

একটা সময় আসে যখন থেমে যেতে হয়

সমরেশ মজুমদার

একটা সময় আসে যখন থেমে যেতে হয়

কয়েকদিন ধরে ওঁর কথা মনে আসছিল। বহুদিন দেখা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ওঁর সহকারী দীপক রায়কে ফোন করে জানলাম উনি সপ্তাহে একদিন অফিসে আসেন। কবে আসবেন তা জেনে দীপক আমাকে জানিয়ে দেবে।

আমার হিসাবে ওঁর বয়স এখন নব্বইয়ের কাছাকাছি। ওই বয়সে কোনো বঙ্গসন্তানকে অফিসে যেতে দেখিনি। দীপক জানাল কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুরোধ না ফেরাতে পেরে সপ্তাহের একদিন এখনো যাচ্ছেন। কয়েকদিন বাদে দীপকের ফোন এলো, মঙ্গলবারে আসুন। দুটোর পর। মঙ্গলবার সকালে তার ফোন এলো, ‘শুনলাম আপনি নাকি আজ আসছেন?’

বললাম, হ্যাঁ।

‘ঠিক আছে। চলে আসুন।’ ওঁর কণ্ঠস্বরে বার্ধক্যের ছায়ামাত্র নেই। একচল্লিশ বছর আগে যে গলায় কথা বলত অবিকল সেই গলা শুনতে পেলাম। আমি রোমাঞ্চিত।

কিশোরকালে যখন গোয়েন্দা গল্প থেকে বেরিয়ে বাংলা সাহিত্য পড়তে শুরু করেছিলাম তখন আমার কোনো গাইড ছিল না। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরত্চন্দ্র না পড়েই তারাশংকর-বিভূতিভূষণ হয়ে বিমল কর-রমাপদ চৌধুরী ও সমরেশ বসুতে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সে সময় ছোটগল্প পড়তে বেশ ভালো লাগত। তখনকার সুবোধ ঘোষের ফসিল, অযান্ত্রিক, সুন্দরম সমস্ত এখনো স্মৃতিতে ঠিকঠাক বেঁচে আছে। বেদেনী, পুঁইমাচা, প্রাগৈতিহাসিক হয়ে আত্মজা, তিতির কান্নার কণ্ঠ— পড়ে যাচ্ছি একের পর এক, ওই তিতির কান্নার কণ্ঠ পড়ে থমকে গিয়েছিলাম। একটি পনেরো বছরের শেষ কিশোরবেলায় ওই গল্পটি দারুণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। প্রেম সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না কিন্তু অরুণিমা সান্যালকে মনে মনে কল্পনা করতে চাইতাম। তারপর হাতে এলো ‘প্রথম প্রহর’। ছোটগল্পের বই নয়। বাবুপাড়া পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান সুনীলদা ইতস্তত করে বলেছিলেন, ‘যদিও একটু আর্লি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তুই যখন রাক্ষস, সব গিলে ফেলছিস, পড়ে ফ্যাল এটাও।’

রাতের খাওয়া শেষ হলে হারিকেনের আলো কমিয়ে বইটা খুলেছিলাম। মনে আছে, বইয়ের টাইটেল পেজগুলোর একটা পাতায় ছাপা ছিল এ লাইনগুলো, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়— ‘প্রথম প্রহরে সবাই জাগে, দ্বিতীয় প্রহরে ভোগী, তৃতীয় প্রহরে তস্কর জাগে, চতুর্থ প্রহরে যোগী।’ তুলসী দাসের ‘দোঁহা’ আমি আগে পড়িনি, শুরুর মুখে লাইন চারটি পড়ে সেই বয়সে জীবনদর্শন হলো। মনে আছে, রাত নিশুতি হয়ে গেছে, কোথাও কোনো শব্দ নেই, সেই ঘুমন্ত পৃথিবীতে আমি ডুবে আছি বইয়ের পাতায়। শেষরাতে বিছানায় গেলাম যখন তখন ঘুম আসছিল না। আমি কখন যে বইয়ের নায়ক হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর পিয়াপসন্দ কখনো আসক্তি থেকে অনেক পরে ভারতবর্ষের মতো গল্প পড়েছি আর ভেবেছি কেমন করে লেখেন।

আমার প্রথম গল্প বেরিয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায় উনিশশ সাতষট্টি, সেপ্টেম্বর মাসে, গল্প দেখতেন বিমল কর। একটু একটু করে তার কাছাকাছি হয়েছি। দেখেছি, অনেক যুবক লেখক, যারা আমার থেকে বয়সে অনেক বড়, বিমলদাকে ঘিরে থাকেন। আর তখনই তাকে দেখতে পেতাম। তিতির কান্নার লেখক বসে আছেন তার রবিবাসরীয় সম্পাদকের চেয়ারে, কিন্তু চেহারায় রোমান্টিকতার কোনো চিহ্ন নেই। দূর থেকে মনে হয়েছিল ওঁর মেজাজ কোনো কারণে খুব খারাপ অথবা পেটের ব্যথায় কাতর হয়ে আছেন, মুখের চেহারা এরকম করে রাখতেন। রবিবারের পাতায় যে গল্প বের হয় তা ওঁরই নির্বাচন। একদিন সাহস করে নতুন গল্প নিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। বলেছিলাম রবিবারের জন্য গল্প দিতে চাই। তিনি মুখ তুলে তাকালেনও না। গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু পড়ছিলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে ওঁকে ইম্প্রেস করতে জানিয়েছিলাম যে, ‘দেশে’ গল্প ছাপা হয়েছে। উনি মুখ না তুলে বললেন তাহলে ‘দেশেই’ জমা দিন। এখানে কেন? গল্পটি ফেরত নিয়ে চলে এসেছিলাম।

রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম আলাপে এরকম কথা হয়েছিল।

শুনে বিমল কর খুব হাসলেন। বললেন, ‘ওর ভেতরটা একদম অন্যরকম। পরে বুঝবি।’ এ ঘটনার দুই বছর পরে ‘দেশ’ পত্রিকায় যাব বলে ওই বাড়ির করিডর দিয়ে হাঁটছিলাম। দেখলাম উনি উল্টোদিক থেকে আসছেন। গম্ভীর মুখ। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটুও না থেমে বলে গেলেন, ‘একটা গল্প দিয়ে যাবেন। সোমবারের মধ্যে।’

দাঁড়িয়ে গিয়ে ফিরে তাকালাম। তিনি তখন চোখের আড়ালে। মনে হলো, ঠিক শুনলাম তো! ছুটে গেলাম ওঁর সহকারীর কাছে। তিনি বললেন, ভুল শুনিনি। সেই শুরু কিন্তু সহজ সম্পর্ক তৈরি হতে আরও অনেক সময় লেগেছিল।

রমাপদ চৌধুরী মিশুকে মানুষ নন। অথচ অফিসে আসতেন আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো ভিড় বাসে চেপে। যখন মেট্রো চালু হলো তখন ওঁর একটু ঝামেলা কমল। চিরকাল ধুতি এবং পাঞ্জাবি পরেছেন। ওঁকে শার্ট প্যান্ট পরা অবস্থায় কেউ দেখেছেন কিনা সন্দেহ আছে। একসময় সিগারেট খেতেন খুব। দিনে চল্লিশ-পঞ্চাশটা। অফিসের ভিতরে যখন ধূমপান বন্ধ বলে ঘোষণা করা হলো তখন বেশ কয়েকবার তাঁকে দেখা যেত সামনের ফুটপাতে অনুজদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন সিগারেট আঙ্গুলে নিয়ে। আশি বছর বয়সেও তাঁকে ওইরকম দেখেছি। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘এখনও সিগারেট?’

হেসে বলেছিলেন, ‘আমার তো কোনো অসুবিধে হচ্ছে না।’

যতদূর জানি দীর্ঘকাল আনন্দবাজারে চাকরি করেও মাত্র দুটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছেন তাদের পত্রিকায়। একটি তো বেশ ছোট। কোনোকালেই বেশি লেখেননি। বছরে একটি উপন্যাস, একটি কি দুটি ছোটগল্প। তাই আমরা গোগ্রাসে গিলতাম। প্রতিটি উপন্যাসের লেখার পেছনে একটা না একটা কারণ থাকত। কখনোই গল্পের জন্য গল্প লেখেননি। রমাপদ চৌধুরী কখনোই কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে যাননি। বিশেষ পছন্দের কয়েকজনকে নিয়ে আড্ডা মারতেন। বন্ধুত্ব ছিল বিমল কর এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে।

নতুন লেখকদের সুযোগ এবং উত্সাহ দিতে সবসময় তৈরি তিনি। রবিবাসরীয় আনন্দবাজারের সম্পাদক হিসেবে কত অচেনা লেখককে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তার হিসাব করতে খেই রাখা যাবে না। শাস্ত্রবিরোধী গল্পকারদের দিয়ে উপন্যাস লিখিয়েছেন। শ্যামলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, শংকরলাল ভট্টাচার্য থেকে অমর মিত্র, সবাইকে সুযোগ দিয়ে গিয়েছেন একের পর এক। আমরা যখন লিখতে এসেছিলাম তখন সম্পাদকরা ইচ্ছা করলেও সুযোগ দিতে পারেননি জায়গার অভাবে। পাঁচটি উপন্যাস ছাপা হবে। দশজন বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় লেখকের মধ্য থেকে পাঁচজনকে বেছে নিতে হতো সম্পাদককে। দুটি কাগজে ভাগ হয়ে যেতেন দশজন। নতুন লেখকের সেখানে কোনো জায়গা নেই। পরে যখন প্রবীণরা চলে গেলেন তখন রমাপদদাই শুরু করেছিলেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রত্যেক বছর একজন তরুণকে সুযোগ দিয়ে দেখতেন পাঠকরা তাকে কীভাবে গ্রহণ করছে।

বছর তিরিশেক আগে আমি উদ্যোগী হয়েছিলাম রবীন্দ্রসদনে একটি গল্পপাঠের আয়োজন করতে। দশ মিনিটের গল্প পড়বেন দশজন বিখ্যাত লেখক। প্রথমেই রাজি করিয়েছিলাম আশাপূর্ণা দেবীকে। তারপর সন্তোষ কুমার ঘোষ, বিমল কর। কিন্তু যে নামটি ছাড়া তালিকা এগোয় না তাঁর কথা বলতেই সঙ্গীরা মাথা নাড়ল, ‘রাজি হবেন না। বিমলদার পরে শংকর, সমরেশ বসু, সুনীলদা, শীর্ষেন্দুদা, সঞ্জীবদের বলতে হবেই।’ আমি কিন্তু রাজি হতে পারছিলাম না। রমাপদদাকে বাদ দিতে বাধ্য হলে ওই অনুষ্ঠান করাই উচিত নয়।

ওঁর কাছে গেলাম। তখন সম্পর্ক একটু সহজ হচ্ছে, অন্তত মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন। আমার প্রস্তাব শোনামাত্র দুদিকে মাথা নাড়লেন, ‘পাগল।’

আমি যত বুঝাই তত তিনি মাথা নেড়ে চলেছেন। শেষে বললেন, ‘আমাকে আপনি কখনো কোনো সভা-সমিতিতে যেতে দেখেছেন?’

‘এটা তো সাধারণ সভা-সমিতি নয়। সন্তোষদা, বিমলদা, সমরেশদা থাকছেন।’

‘ওঁরা বড় লোক, থাকতেই পারেন, আমাকে বাদ দিন।’

কিন্তু আমি বাদ দিতে রাজি হলাম না। লেখকরা যেসব গল্প ওইদিনের অনুষ্ঠানে পড়বেন তা একত্রিত করে ছাপার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। সবাই দিয়ে দিয়েছিলেন। রমাপদ চৌধুরী সমানে ‘না’ বলে যাচ্ছেন। শেষে একটি ছোটগল্প দিয়ে বললেন, ‘এতবার বলছেন তাই দিচ্ছি। কিন্তু দয়া করে পড়তে বলবেন না।’

সেই সন্ধ্যায় রবীন্দ্রসদনে ভিড় উপচে পড়েছিল। আমাকে চমক দিয়ে রমাপদ চৌধুরী শুধু আসেননি, দারুণ ভালো পড়েছিলেন গল্পটা। এখানে একটা কথা বলি। অনেকেই ভালো লেখেন কিন্তু পড়তে পারেন না। পড়ার দোষে ভালো গল্পও খারাপ শোনায়। আবার সাধারণ গল্পও পড়ার গুণে অসাধারণ লাগে শুনতে। যেটা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় পারেন।

বহুদিন দেখা হয়নি। দেখা করতে গেলাম। আমায় দেখে হেসে বললেন, ‘বসুন।’

আমি অবাক হয়ে গেলাম। মনে হলো, সেই প্রথম দেখার দিনে ওকে যেমন দেখেছি এখনো সেরকম আছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন আছেন?’ বললেন, ‘সব ঠিক আছে শুধু সায়াটিকার ব্যথাটা খুব জ্বালাচ্ছে।’

‘আপনি তো রোজ দফতরে আসেন না?’

‘না। আসতেই চাইছিলাম না। কর্তৃপক্ষ জোর করেছিলেন আমি এলে তারা খুশি হবেন। একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য আসি। বাসে ট্রামে উঠতে পারি না, তাই ওদের পাঠানো গাড়িতে আসি। আরে আমি তো নব্বইতে পৌঁছে গেলাম। বাষট্টি বছর চাকরি করছি। আর নয়। এই ডিসেম্বরেই শেষ। এরপর বাড়িতেই থাকব।

‘আপনি কি এখনো সিগারেট খান?’

‘না.। কয়েক বছর আগে শরীরটা বেচাল হলো। নার্সিংহোমে ভর্তি হলাম। মারাত্মক কিছু নয়। ডাক্তার বললেন মাসখানেক বাড়িতেই থাকতে। বাড়ি ফিরে যেতেই চাঙ্গা হয়ে সিগারেটের প্যাকেট খুঁজলাম। কোথাও নেই। স্ত্রী-কন্যারা সব বিদায় করে দিয়েছেন। অনেক অনুরোধ করলাম, দিনে একটা খাব। ওরা রাজি না হওয়ায় ঠিক করলাম, আর খাব না।’

‘আপনি তো সারা জীবনের লেখালেখির জন্য এক কোটি টাকার পুরস্কার পেয়েছেন। কখনো ভাবতে পেরেছিলেন?’

‘প্রথম কথা এক কোটি টাকা নয়। আয়কর বাদ দিলে পঁয়ষট্টি লাখ টাকা। আচ্ছা, এই বয়সে ওই টাকা পেয়ে কী করব আমি। একটা লোভনীয় খাবার তো কিনে খাওয়ার আগে দশবার ভাবতে হয়। গল্প লিখে প্রথম টাকা পেয়েছিলাম পাঁচ টাকা। তার আনন্দ কিন্তু এক কোটির চেয়ে কম ছিল না।’

এর মধ্যে মুড়ি এলো, সঙ্গে বেগুনি, পিয়াজু। আগে যেমন আসত। বললেন, ‘এখন ঝাল একদম খেতে পারি না। বেগুনিটা মুড়ির সঙ্গে এখনো খাই।’

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি বছরে একটাই উপন্যাস লিখতেন। সেটাও বন্ধ করে দিয়েছেন বহু বছর হলো। কেন?’

এবার সোজা হয়ে বসলেন রমাপদ চৌধুরী। বললেন, ‘সমরেশ, জীবনে একটা সময় আসে যখন থেমে যেতে হয়। এই থামতে জানাটা খুব জরুরি। একসময় আমারও মনে হলো যা লেখার তা লিখে ফেলেছি। সেই খড়গপুর থেকে এই কলকাতার জীবনে যা দেখেছি, ভেবেছি তা লিখে ফেলার পর আমার কলম বন্ধ করা উচিত। করলাম। ডাক্তার বা উকিলদের মতো ধুঁকতে ধুঁকতে প্র্যাকটিস চালানোর কোনো মানে হয় না।’

‘এখন মাঝে মাঝে মাথায় লেখা আসে না?’

‘একদম না।’

রমাপদ চৌধুরী নব্বইতে পৌঁছেও যথেষ্ট সতেজ। যিনি গল্ফগ্রিন থেকে প্রফুল্লচন্দ্র সরকারে সপ্তাহে একদিন স্বচ্ছন্দে আসতে পারেন তার পক্ষে বহু বছরের অভ্যাসে একটা উপন্যাস বা কয়েকটা গল্প এখনো লেখা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু তার মনে হয়েছে, থামতে শেখা উচিত।

            লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর