বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

ঈশপ গ্যাটে ও আইনস্টাইন ছিলেন প্রতিবন্ধী

ড. শামসুল আরেফিন

ঈশপ গ্যাটে ও আইনস্টাইন ছিলেন প্রতিবন্ধী

এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় দেশের আটটি সাধারণসহ কারিগরি ও মাদ্রাসা মিলিয়ে মোট ১০টি শিক্ষা বোর্ড থেকে ১৪ লাখ ৪৬ হাজার ৬৫৩ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন। এদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নানা কারণে এদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। অতীতে এ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সমাজের বোঝা হিসেবে গণ্য করা হলেও সেই প্রেক্ষাপট এখন আর বর্তমান নেই। কারণ এরা ইতিমধ্যেই জাতীয় পর্যায়ে যেমন নানা ক্ষেত্রে দক্ষতা ও পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন আন্তর্জাতিক পরিসরেও কেউ কেউ উজ্জ্বল করেছেন স্বদেশের ভাবমূর্তি।

১৯৭৪ সালে দেশে প্রথমবারের মতো ৪৭টি সাধারণ বিদ্যালয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সমন্বিত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ঘটে। পরবর্তী সময়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠে অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের গৃহীত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অটিজম বা অটিজমস্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, বাক প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা ইত্যাদি বহুবিধ প্রতিবন্ধিতা নিরসনে, সেবা প্রদানে জনমনে যথেষ্ট সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়। বছর তিনেক আগে ‘বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন, ২০০১’ রহিত করে একটি যুগোপযোগী ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ প্রণীত হয়। এ আইনের অধীনে নাগরিকের মৌলিক মানবিক অধিকারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী এবং অপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর একই সঙ্গে অধ্যয়নের বিধান রাখা হয়েছে। গুরুত্বারোপ করা হয়েছে মূল ধারার বিদ্যালয়ে, প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর উপযোগী বিশেষ ব্যবস্থাধীন শিক্ষাদানের ওপর। মোদ্দা কথা, প্রতিবন্ধিতার কারণে কোনো শিক্ষার্থীকে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা যাবে না। শিক্ষার সর্বস্তরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি সাপেক্ষে, একীভূত বা সমন্বিত শিক্ষায় অংশগ্রহণে কোনো প্রকার বৈষম্য থাকা আইনের পরিপন্থী। থাকলে তা নিঃসন্দেহে শাস্তিযোগ্য অপরাধের শামিল বলেই ব্যক্ত করা হয়। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ৭১ ক(৩) উপ-বিধিতে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে মনোযোগ আকর্ষণের নোটিস প্রদান করা হয়। ১৬ মে ২০১৭ তারিখের এক চিঠিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদপত্র ইতিমধ্যেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপযোগী কর্মক্ষেত্র চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। এখন প্রয়োজন তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পথ মসৃণ করা। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি প্রতিবন্ধিতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেও বিশ্ব পরিবর্তনে মেধার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন প্রতিবন্ধী ছিলেন। জীবন্ত লিজেন্ড পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও প্রতিবন্ধী। দেশের বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পাঠদানের উদ্যোগ যতই সীমিত পরিসরে হোক নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। সম্মিলিতভাবে আমরা যদি আমাদের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ সুগম ও সম্প্রসারিত করে দিই তাহলে তারাও বিভিন্নক্ষেত্রে সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সক্ষম হবেন।

দেশে ৪২টি সরকারি এবং ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৩৭টি। উপজেলা পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের অংশ হিসেবে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতিপ্রাপ্তির দোরগোড়ায়। সময়ের প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বাস্তব বিবেচনাপ্রসূত চাহিদামাফিক আসন সংরক্ষণ করা অসম্ভব কিছু নয়। ভুলে গেলে চলবে না প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা আমার আপনার, আমাদেরই ভবিষ্যৎ বংশধর।

আমরা শারীরিক প্রতিবন্ধী মহান লেখক ঈশপের কথা জানি। তার কালজয়ী নীতি গল্পের রস-আস্বাদন করেননি এমন পাঠক বিরল। মহাকবি হোমার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছিলেন। পৃথিবীর আলো তার দেখা হয়নি। কিন্তু মহাকাব্য ইলিয়াড ও এডিসির মাধ্যমে যে অম্লান দ্যুতির বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে গেছেন তা শুধু তার জন্মভূমি গ্রিসেই নয়, ইউরোপসহ গোটা পৃথিবীর সভ্যতা-সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধারাকেও করেছে সমান আলোকিত।         লেখক : কবি ও গবেষক।

সর্বশেষ খবর