শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভুল চিকিৎসা আর চিকিৎসা ব্যবস্থায় অবহেলা

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুুল্লাহ

ভুল চিকিৎসা আর চিকিৎসা ব্যবস্থায় অবহেলা

সম্প্রতি চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুলজনিত কারণে রোগীর মৃত্যুর বেশ কিছু অভিযোগ বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছে। তা নিয়ে হাসপাতাল বা ক্লিনিক ভাঙচুর, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গোলযোগ, হাতাহাতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও নার্সদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া— এসব ঘটনা ঘটছে। প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ আর তাই বিষদ আলোচনার দাবি রাখে। মনে রাখা দরকার, কোনো চিকিৎসকই রোগীকে মারতে চান না। তাই প্রশ্নটা হত্যার নয়, বরং অবহেলা, ভুল এবং অদক্ষতার। পেশা হিসেবে চিকিৎসা অনন্য হলেও চিকিৎসক অনন্য নন, তারাও মানুষ। অন্য পেশার লোকদের মতোই নানা ধরনের মানুষের সমাবেশ এখানে। যে কোনো পেশার লোকজনের মধ্যে কেউ নিঃস্বার্থ পরোপকারী, কেউবা চরম পেশাদার, আবার কেউ স্বার্থান্বেষী। ডাক্তারদের বেলায়ও তাই। ফলে দক্ষ হাতের সেবার সঙ্গে সঙ্গে অবহেলা, ভুল ও অদক্ষতার ঘটনাও ঘটে। দেশের এমন কোনো পেশা নেই যেখানে অবহেলা, অরাজকতা, দুর্নীতি এ ধরনের অভিযোগ নেই। কাজেই ডাক্তারদের বেলায় সবকিছুই ভালো হবে, এটা আশা করা যায় না। ডাক্তাররাও সব অফিসে বা কোনো প্রয়োজনে অন্যের কাছে গিয়ে কি ভালো আচরণ বা সহযোগিতা পান?

ভুল যে কারও হতে পারে, চিকিৎসক আলাদা নন। সব ভুলের গুরুত্বও এক নয়। ভুল করে কাশির সিরাপ এক চামচ কম দেওয়া, আর ভুল করে ডান কিডনির বদলে বাম কিডনি কেটে ফেলা বা এক ওষুধের বদলে অন্য বা মারাত্মক ওষুধ দেওয়া এক নয়। কিছু ভুলের জন্য কোনো অজুহাতই গ্রহণযোগ্য নয়, এসব ক্ষেত্রে ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিল করার বিধানসহ অন্যান্য শাস্তি দেওয়ারও নিয়ম আছে। তাই কেউ মারা গেলে যদি ডাক্তারের অদক্ষতা বা অবহেলায় হয়ে থাকে, তবে প্রমাণ সাপেক্ষে অবশ্যই তার শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু রোগী মারা যাওয়া মানেই ভুল করা নয়। মনে রাখতে হবে, সব রোগীকে ডাক্তার ভালো করতে পারবেন না। যেমন স্ট্রোক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হলে, লিভার বা কিডনি নষ্ট হয়ে গেলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। অনেক রোগের কারণ এখনো অজানা এবং সব রোগের চিকিৎসা পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও হয় না। তাদেরও অনেক সময় ভুল-ভ্রান্তি হয়, যদিও তা ইচ্ছাকৃত নয়। আমাদের দেশে অনেক চিকিৎসা ওষুধ, প্রযুক্তি বা অবকাঠামোর অভাবে করা সম্ভব হয় না। আইসিইউতে রোগী মারা যায় বেশি, কারণ সেখানে মুমূর্ষু রোগীই ভর্তি হয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই অবস্থা জটিল হওয়ায় কিছুই করা সম্ভব হয় না। কিছু কিছু চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর আত্মীয়স্বজনের সম্মতির প্রয়োজন হয়। দেখা যায়, রোগীর আত্মীয়স্বজনের একেক জন একেক সিদ্ধান্ত দেন। রোগীকে ভর্তি করাবেন কিনা, কোথায় করাবেন, সার্জারি করাবেন কিনা, প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করতে পারবেন কিনা, এসব সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেন, সময় নষ্ট হয়। কিন্তু রোগী মারা গেলে চিকিৎসকের দোষ দেওয়া হয়।

বিত্তবান রোগীরা বিদেশের নামি-দামি হাসপাতালে অনেক অর্থ খরচ করে চিকিৎসা নিয়ে আসেন। এরপর আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতাল বা ছোটখাটো ক্লিনিকের সঙ্গে তুলনা করেন এবং বলেন, এখানকার চিকিৎসা খুবই খারাপ। এটা মোটেও যৌক্তিক নয়।  

আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে ভুলকে অনিবার্য করে তোলে। হাসপাতালগুলোতে রোগীর অত্যধিক চাপ, প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা কম, তাদের স্বল্পসময়ে অনেক রোগী দেখতে হয়, ফলশ্রুতিতে সব রোগীর প্রতি মনোযোগ দেওয়াও সম্ভব হয় না। ভুল চিকিৎসার আশঙ্কাও তাই বাড়ে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যাও কম। অনেকেই ভালো চিকিৎসার আশায় প্রাইভেট চেম্বারে গিয়েও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা পান না বা অসুবিধার সম্মুখীন হন। কারণ যে বিশেষজ্ঞ রোগীকে চিকিৎসা দেবেন তিনিও মাত্রাতিরিক্ত চাপের মধ্যে থাকেন, হিমশিম খান। অন্যদিকে অনেক দরিদ্র রোগী চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে পারেন না। তারা পরীক্ষা তো দূরে থাক, ওষুধ কেনার টাকাও জোগাড় করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসককে নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই সেবা দিতে হচ্ছে। এমনকি মুমূর্ষু রোগীকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই চিকিৎসা দিতে হয়। এতে ভুলের ঝুঁকিও বাড়তে পারে, কিন্তু এ ছাড়া আর উপায়ও থাকে না। শতভাগ নিয়ম মেনে বইয়ে লেখা আদর্শ চিকিৎসা দিতে হলে বেশির ভাগ রোগীকে হয় চিকিৎসা ছাড়াই বাড়ি ফিরতে হবে অথবা চিকিৎসা হবে, কিন্তু বাড়িঘর জমিজমা বিক্রি করে চিকিৎসার খরচ বহন করতে হবে, যা অনেকের পক্ষেই অসম্ভব।

এ কথাও মনে রাখা উচিত, আমাদের চিকিৎসকদের হাতে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী সুস্থ হচ্ছেন। তাদের সেবায়, দক্ষতায় অনেকে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসছেন। শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন কতশত অপারেশন হচ্ছে, প্রায় সবাই ভালো হয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। হৃদরোগের বড় বড় জটিল অপারেশনসহ কিডনি বা লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন দেশেই হচ্ছে এবং বিদেশে যাওয়ার প্রবণতাও কমে আসছে। কিন্তু এসব কখনো প্রচার পায় না। দেখা যায় দৈবাৎ দু-একজনের বেলায় অঘটন ঘটলে, এমনকি সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে, সেটাই মিডিয়ায় বেশি প্রচার পায়। ফলে মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করে সব চিকিৎসককেই ঢালাওভাবে কাঠগড়ায় তোলা হয়, এমনকি চিকিৎসার মান-মর্যাদাও ভূলুণ্ঠিত করার চেষ্টা চলে। ব্যক্তিগতভাবে কোনো একজন দায়ী হলে সব ডাক্তারকে একসঙ্গে দোষারোপ বা ঢালাও অপপ্রচার কোনোক্রমেই কাম্য হতে পারে না।

আমাদের স্বীকার করতেই হবে, ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ভুল বা অবহেলার যে অভিযোগ আনা হয়, তা অনেকাংশেই সত্য। এটাও ঠিক, ভুল আর অবহেলার ধারণা অনেক সময় অজ্ঞতার কারণেও হয়ে থাকে। রোগীর কাছে যা ভুল বা অবহেলা মনে হয়, তা সব সময় ঠিক নয়। মানুষ মারা যাবেই, কাজেই মারা গেলেই ডাক্তার দায়ী, এ ধারণাও ঠিক নয়। ভালো হলে আল্লাহ ভালো করেন, আর মারা গেলেই ডাক্তার মারেন, এ প্রবাদ কতটুকু যৌক্তিক সেটাও বিবেচনা করা উচিত।

অনেক রোগী প্রায়ই অভিযোগ করেন, অনেক দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছি, কোনো ডাক্তার-নার্স ঠিকমতো আসে না, ভালো করে দেখে না, ওষুধপত্র ঠিকমতো দেন না ইত্যাদি। অভিযোগগুলো অনেক ক্ষেত্রে সত্য এবং সত্যিকার অর্থেই ডাক্তার বা নার্স রোগীকে নিয়মিত দেখা উচিত। আবার অনেক রোগী বা তার আত্মীয়স্বজন মনে করেন, ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে যাওয়া মাত্রই সেবা পাওয়া যাবে অথবা আশা করেন চিকিৎসক বার বার এসে দেখে যাবেন। প্রত্যেকের কাছেই তার রোগীর সমস্যাই সবচেয়ে বেশি বলে মনে হয়। কিন্তু চিকিৎসককে যখন একই সঙ্গে অনেক রোগীকে সেবা দিতে হয়, তখন কাউকে একটু অপেক্ষা করতেই হবে। অনেকে আবার কোনো অধ্যাপকের অধীনে রোগী ভর্তি করে আশা করেন সেই অধ্যাপক তখনই রোগীকে দেখে যাবেন। অথচ অধ্যাপকদের শুধু একাধিক রোগীই থাকে না, তাদের ছাত্র পড়ানো, পরীক্ষা নেওয়াসহ একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করতে হয়। তবে নিজে না দেখলেও তার অধীন চিকিৎসকরা ঠিকই রোগীকে দেখেন এবং সব তথ্য অধ্যাপককে জানিয়ে থাকেন। এটা রোগী বা তার আত্মীয়স্বজন জানতে পারেন না, তাই অনেক সময় অবহেলার অভিযোগ তোলেন। আরও একটি কথা বলা উচিত, সবকিছুর জন্য অনেকে চিকিৎসককে দায়ী করেন। দেখা যায় হাসপাতালে ওষুধ নেই, বিছানাপত্র ঠিক নেই, পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই, খাবারের মান ভালো নেই, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব এবং এগুলোর জন্যও ডাক্তারকে দায়ী করেন। আসলে এসব দেখভালের দায়িত্ব ডাক্তারের নয়, আলাদা প্রশাসন বা কর্তৃপক্ষের। অথচ দোষ দেওয়া হয় ডাক্তারকেই। এখানে চিকিৎসক ছাড়াও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, নার্স, ওয়ার্ড বয়, টেকনিশিয়ান সবারই নিজ নিজ ভূমিকা আছে। চিকিৎসকের দিকে আঙ্গুল তোলার আগে তার কর্মপরিধি বোঝা দরকার।

এ কথা সত্য যে, একজন রোগী নেহায়েত দায়ে পড়েই চিকিৎসকের কাছে আসেন। তাই চিকিৎসকের ভুল বা অবহেলা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না, বিশেষ করে যখন তা জীবন-মৃত্যুর মাঝে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। কোনো রোগীর ক্ষতি হলে বা মারা গেলে তার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব স্বাভাবিকভাবেই আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন এবং এটাই স্বাভাবিক। চিকিৎসকের ছোট, গুরুত্বহীন ভুলও তখন বিরাট হয়ে দেখা দেয়। এ বিষয়টা চিকিৎসকদেরও উপলব্ধি করা দরকার এবং মানবিক দৃষ্টিতেই দেখা দরকার। সাধারণ লোকজন অনেক ক্ষেত্রেই সহনশীল। রোগীর মৃত্যুতে আবেগাপ্লুত হয়ে চিকিৎসককে দায়ী করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্য দেশের মতো মামলা-মোকদ্দমায় যান না। তারা ভাগ্যকে মেনে নেন। চিকিৎসকের সীমাবদ্ধতা তারাও বোঝেন, জীবন-মৃত্যু চিকিৎসকের হাতে নয়, এটাও মানেন। ডাক্তারদের তাই একটু ধৈর্য ধরে তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিই এড়ানো যায়।

আবেগের বশে হোক বা স্বাভাবিক বিবেচনায় হোক, চিকিৎসকের ভুল হয়েছে বা অবহেলা ছিল এ ধরনের ধারণা যদি রোগীর বা তার স্বজনের হয়েই থাকে, তবে তাদের অবশ্যই আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু অভিযোগ করলেই চিকিৎসক ভুল করেছেন বলে ধরে নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তদন্তে প্রমাণ হলে গ্রেফতার করাই যায় এবং শাস্তি দেওয়া উচিত, কিন্তু তার আগেই অপরাধী ঘোষণা করে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত? ভুল বা অবহেলার অভিযোগ করলেই হবে না, তা প্রমাণ হতে হবে, ভুলের মাত্রা দেখতে হবে, তার কারণ বিশ্লেষণ করতে হবে। এসব ছাড়াই পত্র-পত্রিকায় দাগী আসামির মতো পরিচয় করিয়ে দেওয়া, হাজতে নেওয়া শুধু হয়রানি নয়, নিদারুণ অমানবিক এবং অন্যায়।

তা ছাড়া কথায় কথায় চিকিৎসককে অবহেলা আর ভুলের অভিযোগে বিদ্ধ করলে তা সমগ্র চিকিৎসক সমাজেই ভুল সংকেত দেবে। একদিকে চিকিৎসাকে মহান ব্রত বলে সেবা দাবি করা আর অন্যদিকে ঢালাওভাবে সব চিকিৎসকের সঙ্গে অপরাধীর মতো আচরণ করা অযৌক্তিক। কোনো চিকিৎসক ভুল করলেই সব চিকিৎসককে সমানভাবে দায়ী করাও অনুচিত। এতে সেবাপরায়ণ চিকিৎসকরাও ঝুঁকিপূর্ণ, জটিল রোগীর চিকিৎসা দেওয়া থেকে নিরুৎসাহিত হবেন, রোগীর মারা যাওয়ার ন্যূনতম আশঙ্কা থাকলেই তাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেবেন। রোগীর আর্থিক দিক বিবেচনা করে কম খরচে ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা করা থেকে বিরত থাকবেন। চিকিৎসকের এই এড়িয়ে চলার মনোভাব অনেক রোগী বিশেষ করে দরিদ্র রোগীদের জন্য মঙ্গলময় হবে না বলাই বাহুল্য।

স্বীকার করতেই হবে, চিকিৎসকদের দক্ষতার ক্রমাবনতি এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার জন্য আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই দায়ী। চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থা দিন দিন অবনতির দিকেই যাচ্ছে। ভালো চিকিৎসক তৈরির অনেক অন্তরায় রয়েছে, যেমন যত্রতত্র মেডিকেল কলেজের ছড়াছড়ি, মানসম্মত মেডিকেল কলেজের অভাব, মেডিকেল কলেজ স্থাপনের শর্ত পূরণ না করেই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, কিছু কিছু প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে মেধার বিকাশের চেয়ে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে সুষ্ঠু পড়াশোনার পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে আর চিকিৎসা শিক্ষার মান হচ্ছে নিম্নমুখী। শিক্ষক সংকট, দক্ষ প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অপ্রতুলতা, ন্যূনতম সংখ্যক শিক্ষকের পদ না থাকা বা শূন্য থাকা ও সহযোগী লোকবলের অভাব, দলীয় অথবা রাজনৈতিক প্রভাব বলয় সব কিছুই যোগ্য চিকিৎসক তৈরির অন্তরায়। হাতে-কলমে শিক্ষার সুযোগ অনেক প্রতিষ্ঠানেই সীমিত, এমনকি রাজধানীর অনেক নামি-দামি প্রতিষ্ঠানেও। স্নাতকোত্তর শিক্ষার অবস্থা আরও খারাপ। রাজনৈতিক বিবেচনায় ভর্তি আর পাস করানোর অভিযোগ বাজারে চালু আছে। কিন্তু শেখানোর যোগ্যতাসম্পন্ন লোকজন দিন দিন কমে যাচ্ছে। চিকিৎসকদের পাঠ্যক্রমে চিকিৎসাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক অংশটুকু যাও-বা পড়ানো হয়, মানবিক দিকটা একেবারেই অবহেলিত থাকে। রোগীর সঙ্গে আচরণ, তথ্য আদান-প্রদান, সেবার মনোভাব, এগুলোর ভিত গোড়াতেই শক্ত করা দরকার, কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তা হয় না। এর সঙ্গে কর্মজীবনে যোগ হয় নানা রকম হতাশা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পেশাগত। ডাক্তারদের পদোন্নতি সোনার হরিণ, দলাদলি এখানে মূল নিয়ামক। কর্মক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা কম, সেবা দিতে চাইলেও দেওয়ার উপায় নেই। নবীন ডাক্তারদের বেশির ভাগেরই নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তাই নিঃস্বার্থ সেবার মনোভাব ক্রমেই লোপ পায়। চিকিৎসা ব্যবস্থার এই অবহেলিত রূপ তৈরি করছে অদক্ষ, হতাশাগ্রস্ত আর কখনো কখনো আদর্শহীন চিকিৎসক, যাদের দ্বারা ভুল আর অবহেলা হওয়াই স্বাভাবিক। শুধু একতরফা চিকিৎসকের ওপর দোষ চাপানো অনুচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাই হচ্ছে। সমস্যা দক্ষ চিকিৎসক তৈরি এবং চিকিৎসা ব্যবস্থায়। ভালো চিকিৎসক তৈরির যথাযথ ব্যবস্থা না করে ভালো সেবা পাওয়া বা আশা করা কি সম্ভব? একতরফা ডাক্তারদের ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ কী? যারা প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত, তাদের কি কোনো দায়িত্বই নেই?

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চিকিৎসকদের অবশ্যই কিছু করণীয় আছে। অনেক রোগী বা তার আত্মীয়স্বজনের অভিযোগ, ডাক্তাররা রোগীর সঙ্গে ভালো করে কথা বলেন না, রোগীর অভিযোগ ভালো করে শোনেন না বা ভালোভাবে রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন না, ভালো আচার-আচরণও করেন না। রোগ সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলেও তা রোগীকে বোঝান না। ফলে ডাক্তার এবং রোগীর সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এ অবস্থায় যারা ডাক্তারি পেশায় জড়িত, তাদের রোগীর আস্থা অর্জনকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। চিকিৎসার শুরুতেই রোগীর কথাবার্তাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনতে হবে, তাকে সময় দিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। সম্ভব হলে রোগীকে তার অবস্থা জানাতে হবে, অনেক সময় জটিল রোগ যেমন ক্যান্সার অথবা নিরাময়যোগ্য নয়, এমন রোগ রোগীর আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবকে আলাদাভাবে জানাতে হবে। কতটুকু চিকিৎসা করা সম্ভব জানাতে হবে, কোনো সীমাবদ্ধতা থাকলে তাও জানাতে হবে। মোটকথা রোগীর সমস্যা বা চিকিৎসার ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। সব সমস্যার সমাধান হবে না ঠিকই; কিন্তু আন্তরিকতার প্রমাণ রাখতে হবে। এতে চিকিৎসক ও রোগীর মাঝে দূরত্বসহ ভুল বোঝাবুঝি অনেকটাই কমে আসবে।

আরও একটা কথা বাজারে চালু আছে যে, অনেক ডাক্তার বিভিন্ন ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন পান। হয়তোবা মুষ্টিমেয় ডাক্তার এর সঙ্গে জড়িত, অথচ ঢালাওভাবে সব ডাক্তারকে মানুষ দায়ী করে। এই বদনামটুকু ঘোচাতে ডাক্তারদের এগিয়ে আসতে হবে। তবে সার্বিকভাবে এ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাই মুখ্য। দেশের অন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মতো মেডিকেল কলেজগুলোও অরাজকতার বাইরে নেই। ভালো চিকিৎসক তৈরির অন্তরায়গুলো দূর করার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বিএমডিসিকে আরও যথাযথ এবং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসকের ভুলের মাশুল অনেক ক্ষেত্রেই অপূরণীয় হয়ে থাকে, অন্য সব পেশায় তা নয়। তাই চিকিৎসা খাত নিঃসন্দেহে বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, বাস্তবমুখী করা, এর সমস্যাগুলো জরুরি ভিত্তিতে চিহ্নিত করা ও সমাধান করার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। চিকিৎসকের অবহেলার অভিযোগ অবশ্যই তদন্ত করে দেখা উচিত, প্রমাণ হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, কিন্তু তা হবে সমস্যার উপশম মাত্র। প্রতিরোধ করতে হলে সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ঘিরে থাকা অবহেলার স্বরূপ উদ্ঘাটন করে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। দক্ষ ডাক্তার তৈরির বদলে অদক্ষ ডাক্তার তৈরির ব্যবস্থা রেখে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না।

লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর