বৃষ্টি আল্লাহর পরম নিয়ামত। পবিত্র কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যে পানি পান কর তা সম্পর্কে কি ভেবে দেখেছ? তোমরাই কি মেঘ থেকে তা বর্ষণ কর, নাকি আমি বর্ষণ করি? আমি ইচ্ছা করলে তাকে লবণাক্ত করে দিতে পারি। তবু কি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না?’ (সূরা ওয়াকিয়া : ৬৮-৭০)। পানির সবচেয়ে নিরাপদ উৎস হলো বৃষ্টি। বৃষ্টির ফলেই উর্বর হয় মাটি। মাটির বুক চিরে জন্মে তরুলতা, গাছপালা, নয়নাভিরাম শস্য ও ফলমূল। মানুষ ও পশুপাখির জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় যতসব রিজিক। শুধু জীবিকাই নয়; আমাদের চারপাশে জমে থাকা আবর্জনা, রোগ-জীবাণু ধুয়ে-মুছে করে দেয় পরিষ্কার। বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও বৃষ্টির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যে বৃষ্টির স্বাভাবিক ধারা নিয়ামত তথা রহমত অতিবর্ষণের ফলে তাই পরিণত হয় গজবে। অনাবৃষ্টিতে যেমন মাটি শক্ত হয়ে যায়, ফসলের অভাবে দুনিয়ায় হাহাকার শুরু হয়, তেমনি অতি বৃষ্টিও মানুষের চরম ভোগান্তির কারণ হয়। অতি বৃষ্টির ভয়াল রূপই বন্যা নাম ধারণ করে। প্লাবিত হয় রাস্তা-ঘাট সব কিছু। গাছপালা, শস্য, ফসলের মাঠ সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেড়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। রোগ-জীবাণু পরিষ্কার হওয়ার বিপরীতে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ। আসলে কোনো নিয়ামত পেয়ে তার কৃতজ্ঞতা আদায় না করার ফলেই অনেক সময় তা গজবে পরিণত হয়। বৃষ্টির পর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় না করাও তা গজবে পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ। সূরা ফুরকানের ৫০ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘আর আমি তা (পানি) তাদের মধ্যে বণ্টন করি যেন তারা স্মরণ করে; কিন্তু অধিকাংশ লোক শুধু অকৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করে।’ অনাবৃষ্টিতে বৃষ্টি প্রার্থনা করে নামাজ (সালাতুল ইসতিসকা) আদায় করা হয়; মসজিদে মসজিদে শুরু হয় দোয়া। আমরা বৃষ্টির আগে প্রার্থনা করলেও বৃষ্টি পাওয়ার পর আল্লাহর দরবারে আদায় করি না কোনো শুকরিয়া। বৃষ্টি যখন স্বাভাবিক হয়, তখন আমাদের উচিত আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করা। শুকরিয়া আদায়ের পাশাপাশি বৃষ্টির রহমতের পানি যেন গজবে পরিণত না হয় সে জন্য বৃষ্টিপ্রাপ্তির পর আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে। অতি বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কখনো মানুষের পাপের কারণেও হয়। পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের ওপর যেসব বিপদ-আপদ পতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গোনাহ ক্ষমা করে দেন।’ (সূরা শুরা : ৩০)। তাই এ থেকে বাঁচার জন্য ক্রমবর্ধমান হত্যা, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, দুর্নীতিসহ সব ধরনের গুনাহের কাজ থেকে আল্লাহতায়ালার কাছে তওবা করতে হবে।
পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার প্রতিও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের বাড়ির আশপাশের ড্রেনগুলোকে আমরা ‘সরকারের জিনিস’ মনে করে এতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখি। ময়লা আটকে থাকায় ড্রেনের স্বাভাবিক পানি চলাচল ব্যাহত হয়। অল্প বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হয় চরম জলাবদ্ধতার। তাই মনে রাখা উচিত যে, এ ড্রেনগুলো আমাদের। সরকার তো আমাদের প্রয়োজনেই এগুলো বানিয়েছে। এগুলো পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব তো আমাদের। আমরা যদি এগুলোকে আবর্জনা ফেলে বন্ধ করে দিই তাহলে সরকারের একার পক্ষে সেগুলো পরিষ্কার রাখা সম্ভব নয়। আমাদের এগুলো ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এগুলোতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখার অধিকার আমাদের নেই। এ ড্রেন শুধু আমার একার নয় যে, আমি এতে ময়লা ফেলে তা ভরে রাখব। বরং কেউ অজ্ঞতাবশত ড্রেন অপরিষ্কার করে রাখলেও আমরা সবাই মিলে আমাদের স্বার্থেই তা পানি চলাচলের উপযোগী করে রাখব। ড্রেনগুলো পরিষ্কার থাকলে বৃষ্টির পর তাড়াতাড়ি পানি নিষ্কাশন হবে। আমরাই কষ্ট থেকে মুক্তি পাব।
বিচলিত না হয়ে ধৈর্য ধারণ করা অতি বৃষ্টির সময়ের আরেকটি আমল। সাহাবায়ে কেরাম বিপদে-মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করতেন। অতি বৃষ্টিতে অধৈর্য, বিচলিত না হয়ে ধৈর্যের সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নিলে আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করবেন। অতি বৃষ্টি হয়ে যাবে ক্ষমাপ্রাপ্তির কারণ। পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান, মাল ও ফলফলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। আর আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন! যারা মুসিবতের সময় বলে, ‘নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা আল্লাহরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী’, তাদের ওপরই রয়েছে তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও রহমত আর তারাই সুপথপ্রাপ্ত। (সূরা বাকারা : ১৫৫-১৫৭)। অতি বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধৈর্য ধারণ করলে তা থেকে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও মর্যাদাপ্রাপ্তির উসিলা। তাই অতি বৃষ্টিতে মুমিনদের উচিত মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে ধৈর্যের সঙ্গে তাতে করণীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া।অতি বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার আমল হলো সদকা করা। দান-সদকার কারণে আল্লাহতায়ালা বান্দার প্রতি খুশি হয়ে তার ওপর থেকে গজব উঠিয়ে নেন। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সদকা আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু রোধ করে।’ (তিরমিজি : ৬০০)। অতি বৃষ্টিতে দোয়া করাও নবীজির শেখানো অন্যতম আমল। ইসলামের শিক্ষা হলো, বৃষ্টি প্রার্থনা করে যেমন দোয়া করতে হয় তেমনি অতি বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতেও দোয়া করতে হয়। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, “একবার জুমার দিন নবীজি (সা.) খুতবা দেওয়ার সময় এক সাহাবি মসজিদে প্রবেশ করে আরজ করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ, জীবজন্তু মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে, আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য বৃষ্টি প্রার্থনা করুন! নবীজি (সা.) দুই হাত উঠিয়ে দোয়া করলেন। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর দোয়ার পর দিগন্তে মেঘের উদ্ভাস হয়। অথচ আকাশে বিন্দুমাত্র মেঘের ছোঁয়াও ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যে মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হয়। ছয় দিন অব্যাহত বৃষ্টির পর সপ্তাহান্তে পরবর্তী জুমায় পুনরায় ওই ব্যক্তি আবার আরজ করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ, ধন-সম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পানিতে পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে, আল্লাহর কাছে বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার দোয়া করুন! নবীজি (সা.) দুই হাত উঠিয়ে দোয়া করলেন, ‘আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়ালা আলাইনা’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাদের ওপর থেকে সরিয়ে নাও! বর্ণনাকারী বলেন, তখনই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর আমরা রোদের মধ্যেই নামাজ থেকে বের হই। (বোখারি : ১০১৩)।
লেখক : জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কারি ও খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ, বোর্ড বাজার, গাজীপুর।