শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

যেভাবে এলো পবিত্র কাবা

মাওলানা কাসেম শরীফ

পবিত্র কাবা শরিফ পৃথিবীতে আল্লাহর জীবন্ত নিদর্শন। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই আল্লাহতায়ালা কাবাকে তাঁর মনোনীত বান্দাদের মিলনমেলা হিসেবে কবুল করেছেন। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান, যা পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল হিসেবে বিবেচিত। এ বিষয়ে পিএইচডি করেছেন ড. হুসাইন কামাল উদ্দীন আহমদ। তার থিসিসের শিরোনাম হলো— ‘ইসকাতুল কুররাতিল আরধিয়্যা বিন্ নিসবতে লি মাক্কাতিল মুকার্রামা।’ (মাজাল্লাতুল বুহুসুল ইসলামিয়া, রিয়াদ : ২/২৯২)

ওই থিসিসে তিনি প্রাচীন ও আধুনিক দলিল-দস্তাবেজের আলোকে এ কথা প্রমাণ করেছেন যে কাবাই পৃথিবীর মেরুদণ্ড ও পৃথিবীর মধ্যস্থলে অবস্থিত। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পানিসর্বস্ব পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি এ কাবাকে কেন্দ্র করেই।

কাবাগৃহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তা পৃথিবীর সর্বপ্রথম ও সুপ্রাচীন ঘর। কোরআনের ভাষায়, ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা বাক্কায় (মক্কা নগরীতে) অবস্থিত।’ (সূরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৯৬)

হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে কাবার সৃষ্টি। আল্লাহতায়ালা যখন ফেরেশতাদের দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, তখন তাঁরা আসমানে বায়তুল মামুরের আদলে নির্মিত একটি ইবাদতখানার জন্য প্রার্থনা করেন। আল্লাহতায়ালা এর আদলে পৃথিবী সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে ফেরেশতাদের মাধ্যমে কাবা সৃষ্টি করেন। তখন তা সাদা ফেনা ছিল। সে সময় পৃথিবীতে পানি ছাড়া কিছু ছিল না। আল্লাহর আরশ ছিল পানির ওপর। হাদিসের ভাষ্যমতে, কাবার নিচের অংশটুকু পৃথিবীর প্রথম জমিন। বিশাল সাগরের মাঝে এর সৃষ্টি। ধীরে ধীরে এর চারপাশ ভরাট হতে থাকে। সৃষ্টি হয় একটি বিশাল মহাদেশের। এক মহাদেশ থেকেই সৃষ্টি হয় অন্য সব মহাদেশ। মাটি বিছানোর পর জমিন নড়তে থাকে। হেলতে থাকে। এর জন্য আল্লাহ পাহাড় সৃষ্টি করেন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন, যাতে পৃথিবী তোমাদের নিয়ে আন্দোলিত না হয় (হেলে না যায়)।’ (সূরা : নাহল, আয়াত : ১৫)

বেহেশত থেকে দুনিয়ায় আগমনের পর হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-এর অনুরোধে সেটিকেই তাঁদের ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করে দেন আল্লাহতায়ালা। নূহ (আ.)-এর সময়কার মহাপ্লাবনে কাবাঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আল্লাহর নির্দেশে আবার কাবা শরিফ পুনঃনির্মাণ করেন হজরত ইব্রাহিম (্আ.) ও তাঁর ছেলে ইসমাইল (আ.)। তার পর থেকে কখনো বন্ধ থাকেনি কাবাঘরের জিয়ারত। সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আমলে এ আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণতা পায়। নবুয়ত লাভের ২২ বছর পর ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে হজ পালন করেন রসুল (সা.)। তাঁর দেখানো নিয়ম অনুসারেই প্রতি বছর শান্তিপূর্ণভাবে হজ পালন করেন লাখ লাখ মুসলমান।

ইমাম বাগভি (রহ.) লিখেছেন, জগত সৃষ্টির দুই হাজার বছর আগে মহান আল্লাহ এক ঘূর্ণিঝড় প্রেরণ করেন, যা এ পানিকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। আর এতে কাবাগৃহের অবস্থান স্থলে (বর্তমানে যেখানে কাবা অবস্থিত) গম্বুজের মতো একটি ফেনার সৃষ্টি হয়। অতঃপর আল্লাহতায়ালা এর নিচে মাটির পৃথিবীর বিস্তৃতি দেন। তাতে পর্বতমালা সৃষ্টি করে স্থিতি দান করেন। পৃথিবীকে স্থিতি দানকারী পর্বতের মধ্যে প্রথম পর্বত হলো আবু কুবাইস নামক পর্বতটি। এ কারণেই মক্কাকে ‘উম্মুল কুরা’ বা মূল জনপদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। একাধিক হাদিসে এসেছে, হজরত আদম (আ.) পৃথিবীতে প্রেরিত হওয়ার পর প্রথম বারের মতো তিনি এ কাবাগৃহটি তৈরি করেন। এটি এমন জায়গায় নির্মিত হয়, যার ঠিক ওপরে সপ্তম আসমানে বায়তুল মামুর অবস্থিত। ওই ঘরকে কেন্দ্র করে ফেরেশতারা মহান আল্লাহর ইবাদত করেন। আদম (আ.) নির্মিত এ কাবা হজরত নূহ (আ.)-এর মহাপ্লাবনে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু কাবা গৃহের চিহ্ন সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়নি। ওই চিহ্নিত স্থানে হজরত ইবরাহিম (আ.) কাবা নির্মাণ শুরু করেন। (তাফসিরে মাজহারি)

তাফসিরবিদ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, হজরত ইবরাহিম (আ.) পাঁচটি পাহাড় থেকে পাথর এনেছেন। পাহাড়গুলো হলো— হেরা, সিনাই, সিরিয়ায় অবস্থিত লুবনান, জুদি ও জায়তা। কাবা শরিফের ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল হেরা পর্বতের পাথর দ্বারা।

এক পর্যায়ে কাবাগৃহের দেয়াল উঁচু হয়ে যায়। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর পক্ষে তা নাগাল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন ইসমাইল (আ.) একটি পাথর খণ্ড সংগ্রহ করেন।  হজরত ইবরাহিম (আ.) ওই পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে কাবাগৃহের গাঁথুনী কর্ম সম্পাদন করেন। হাদিসে এসেছে, কাবাগৃহের দেয়াল যতই উঁচু হতে লাগল পাথরটির উচ্চতাও ততই বৃদ্ধি পেতে লাগল। তা ছাড়া পাথরটির পৃষ্ঠে ইবরাহিম (আ.)-এর দুই পায়ের স্পষ্ট ছাপ আজও বিদ্যমান। গৃহের চতুর্দিকের দেয়াল নির্মাণে এ পাথরটি তিনি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ব্যবহার করতেন। তখন থেকে এ পাথরটি ‘মাকামে ইবরাহিম’ নামে পরিচিত। কাবা নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর হজরত জিব্রাইল (আ.) তাঁদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে হজের রীতিনীতি বিস্তারিতভাবে শিখিয়ে দেন। অতঃপর জিব্রাইল (আ.) তাদের নিয়ে আরাফাতে পৌঁছেন। জিব্রাইল (আ.) হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে প্রশ্ন করেন, ‘হাল আরাফতা মানাসিকাকা— আপনি কি হজের নিয়ম-কানুন জেনে নিয়েছেন?’ হজরত ইবরাহিম (আ.) জবাবে বলেন, ‘আরাফতু— হ্যাঁ, আমি জেনেছি।’ অতঃপর আল্লাহতায়ালা হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে এ মর্মে নির্দেশ দেন যে তুমি বিশ্ববাসীর উদ্দেশে হজের আহ্বান কর। এ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে কোরআন বলছে— ‘মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পদব্রজে ও সব ধরনের ক্ষীণকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে। তারা আসবে দূর-দূরান্ত পথ অতিক্রম করে।’(সূরা : হজ, আয়াত : ২৭)। এ ঘোষণার পর থেকে হাজার বছর ধরে ‘লাব্বাইক’-এর মিছিলে শামিল হন হজযাত্রীরা।

লেখক : সাংবাদিক।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর