শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

সর্বজনস্বীকৃত নির্বাচন ছাড়া মুক্তি নেই

নূরে আলম সিদ্দিকী

সর্বজনস্বীকৃত নির্বাচন ছাড়া মুক্তি নেই

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত রাজনীতির অঙ্গনে প্রবীণতম ব্যক্তি। বয়সের ভারে ন্যুব্জমান। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মূল স্রোতধারায় তিনি অবস্থান করেন না। উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যরা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব বহন করেন না। বরং তারা ক্ষমতাহীন সম্মানের পাত্র মাত্র।

তারা ঠুঁটো জগন্নাথ নন, আবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্মাতাও নন। পৃথিবীর রাজনৈতিক অঙ্গনে সব বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠনে এ রকম একটা অবকাঠামো থাকে, প্রবীণদের মুখ রক্ষা করার জন্য। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় তখনই, যখন নিজের অবস্থান না বুঝে আগ বাড়িয়ে দাম্ভিক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করতে থাকেন বা বেসামাল বক্তব্য দিতে থাকেন তাদের কেউ কেউ। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাদেরই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। তার মন্ত্রণালয় এবং সংগঠনে অবস্থানের বিবেচনা না করে তার অসংলগ্ন অপ্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক শিষ্টাচারবিবর্জিত উক্তি শুধু তাকেই হাস্যকর করে তোলে না, সংগঠনকেও বিপাকে ফেলে দেয়। প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে এবং সরকারেও প্রচণ্ড মতবিরোধ সৃষ্টি করে। সম্প্রতি জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন এবং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ক্ষমতাসংবলিত রায়ের বিরুদ্ধে তার মন্তব্যে শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তার ধারণা নেই বলেই শিক্ষিত সমাজের কাছে স্পষ্ট হয়েছে।

অন্যদিকে ওয়েজ বোর্ড গঠন নিয়ে তার রূঢ় ও কর্কশ মন্তব্য সাংবাদিকদের আত্মমর্যাদাতেই কেবল আঘাত হানেনি, সাংবাদিক সমাজকেই অপমানিত করেছে। তাদের আত্মমর্যাদায় নিদারুণভাবে আঘাত হেনেছে। এ কথা সত্যি, সাংবাদিকদেরও একাংশ আদর্শবিবর্জিত, সুযোগসন্ধানী ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে মারাত্মক বিভাজন তো সৃষ্টি করেছেন, তাদের প্রতি আস্থা রাখার ন্যূনতম জায়গাটিও তারা অক্ষুণ্ন রাখেননি। মানুষের আস্থার পাদপীঠটাকে নিজের হাতেই তারা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছেন। মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, আসফ-উদ-দৌলা রেজা, প্রয়াত রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখ ব্যক্তিত্ব সাংবাদিকতায় যে গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি বিনির্মাণ করেছিলেন তা আজকে ভগ্ন প্রাসাদের মতোই জরাজীর্ণ ও ম্রিয়মাণ। আজকে সাংবাদিকতা অকুতোভয়ে ন্যায্য কথা বলতে পারে না। কোনো না কোনো দলের স্বার্থ রক্ষায় কথা বলে। তবুও একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রীর এ রকম উগ্র প্রতিক্রিয়া সত্যিই অনভিপ্রেত। ‘রাবিশ’ এবং ‘বোগাস’ শব্দ দুটির যত্রতত্র প্রয়োগ রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়িয়ে গোটা দেশেই তার ভাবমূর্তিকে এতটাই ক্ষুণ্ন করেছে যে, মানুষ তাকেই এখন ‘রাবিশ’ ও ‘বোগাস’-এর প্রতীক হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। একজন সিনিয়র মন্ত্রী হিসেবে বিচারব্যবস্থাকে তিনি কেমন করে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন যে, ‘যতবার তারা ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করবে, ততবারই সংসদে ওই সংশোধনীটি পাস করা হবে!’ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিদের তিনি কীভাবে বলতে পারেন, ‘আমরা তাদের নিয়োগ দিই।’

সারাটি জীবন তিনি নিজে চাকরি করেছেন, এখনো শেখ হাসিনার অধীনে চাকরিই করছেন। তার ব্যক্তিগত জীবনের কোনো অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা তাকে দীপ্তিহীন আগুনের নির্দয় দহনে প্রতিনিয়ত দগ্ধীভূত করে কিনা, আমি জানি না। তবে তার বেসামাল, অসংলগ্ন ও অমার্জিত উক্তিসমূহ আমাকে তো বটেই, সমগ্র জাতিকেই লজ্জিত করে।

তিনি ইংরেজি সাহিত্যের লোক; কখনো অর্থনীতি পড়েননি। তবে ঘটনাচক্রে এরশাদ সাহেবের মন্ত্রিপরিষদে তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অস্থিরচিত্তই শুধু নন, ভীতসন্ত্রস্ত। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের নাম প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তারা এত প্রভাবশালী যে, তাদের নাম প্রকাশ করা যাবে না।’

তারই হিসাবমতে, ১০ বছরে ৬ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এই বিশাল অঙ্কের টাকা কারা পাচার করলেন, কোথায় কীভাবে পাচার হলো, যারা পাচার করেছেন তাদের নাম এবং দলগত পরিচয় সবই হয়তো তিনি জ্ঞাত। কিন্তু এসব তথ্য না ধরে পাশ কাটিয়ে গিয়ে তিনি তার পদ ও পদবির প্রতি যথাযথ দায়িত্ববোধের প্রকাশ তো করেননি, বরং সমগ্র জাতিকে তিনি প্রচণ্ডভাবে ধোঁকা দিয়েছেন। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ পূর্ণ বেঞ্চের ঘোষিত রায়ে বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও অপসারণ— সবকিছুর নিয়ন্ত্রণের ভার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করার বিধানটি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সব বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের গৃহীত সিদ্ধান্তটি দলমতনির্বিশেষে উন্মুক্ত চিত্তে মেনে নেওয়া উচিত। ১৯৭২ সালের প্রণীত শাসনতন্ত্রের ১১১ ও ১১২ ধারায় সুপ্রিম কোর্টকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং এটি শাসনতন্ত্রের সঙ্গে আদৌ সাংঘর্ষিক নয়, বরং সংগতিপূর্ণ। একে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে অবলোকন করা এবং নিজ নিজ আঙ্গিকে এর বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া ও অনভিপ্রেত তর্ক-বিতর্ক সুপ্রিম কোর্টকে শুধু বিতর্কিত করাই নয়, শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেওয়ার শামিল।

বিজ্ঞ বিশ্লেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। আইনে ন্যূনতম জ্ঞানের যারা অধিকারী তাদের দ্বারা এ রকম একটি অভিমতের বিরোধিতা করা শাসনতন্ত্রের প্রতি অবহেলা ও অসম্মান প্রদর্শন করার হীনমন্যতাকেই তুলে ধরে। আওয়ামী লীগের মন্ত্রিবর্গ বা সংসদ সদস্যরা কেউ যে অবগত ও অবহিত নন এটা বলা ধৃষ্টতা মাত্র। কিন্তু বেদনাদায়ক হলেও সত্য আওয়ামী লীগের কিছু সংসদ সদস্য, সংগঠনের নেতা এবং মন্ত্রী এই রায়ের বিরুদ্ধে যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, তা দলের বিজ্ঞ, সৃজনশীল ও শাসনতন্ত্র মেনে চলা ব্যক্তিবর্গের প্রতিবাদেই থমকে যেতে পারত। কিন্তু বিষয়টি নেতিবাচক ও বিপজ্জনক ধারণার সৃষ্টি করে, সরকারপ্রধান যখন এ রায়ের প্রতি নেতিবাচক ইঙ্গিত প্রদর্শন করেন। এটা কীসের আলামত বহন করে? সরকারপ্রধান কি সর্বোচ্চ আদালতকে তোয়াক্কা করেন না? নাকি শাসনতন্ত্রের যে অনুচ্ছেদে সংসদের সিদ্ধান্ত অথবা শাসনতন্ত্রের ব্যাখ্যায় সুপ্রিম কোর্টকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে, সে অধ্যায়টি তিনি পাঠ করেননি? এটা জাতির জন্য শুধু অকল্যাণকরই নয়, ভয়ঙ্কর আশঙ্কাজনকও বটে।

অন্যদিকে আন্দোলন ও জনমত গঠনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বিএনপি যে কোনো ছল-ছুতায় অথবা ছিদ্র দিয়ে ক্ষমতার প্রাসাদে অনুপ্রবেশ করতে চায়, তারা আহাম্মকের মতো বগল দাবিয়ে গলা ফাটাচ্ছে— সরকারের পদত্যাগ করতে হবে। অথচ সংসদের পদত্যাগের বিষয়টি রায়ের মধ্যে কোথাও আসেনি। যেখানে ওয়েস্টমিনস্টার ধরনের সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত (ইংল্যান্ড, ভারত, পাকিস্তান এমনকি বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে) সেখানে শাসনতন্ত্র, সংসদ এবং মন্ত্রিপরিষদ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত প্রদানের এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আছে। এই তো সেদিন পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক অযোগ্য ঘোষণা করার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা-না আসার প্রশ্নে গণভোটে সেখানকার জনগণের সুস্পষ্ট অভিমত বেরিয়ে আসার পক্ষে হয়েছে। ব্যতিক্রমধর্মী হলেও সত্য লেবার ও কনজারভেটিভ পার্টি উভয়েই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে সংযুক্ত হওয়ার পক্ষে ছিল। এ প্রশ্নে ইংল্যান্ডের প্রতিভাপ্রদীপ্ত তরুণতম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগ করেন এবং থেরেসা মে তার স্থলাভিষিক্ত হন। এতদসত্ত্বেও গণভোটের অনেক দিন পর সেখানকার সর্বোচ্চ আদালত সংসদে বিষয়টি পেশ করার জন্য রায় দিয়েছে। বোধ করি আবুল মাল আবদুল মুহিত অবগত আছেন, আমেরিকায় কয়েকটি মুসলিম দেশের প্রবেশাধিকার খর্ব করে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে নির্বাহী আদেশ জারি করেছিলেন, সেখানেও সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ (কেবল একটি দেশের ক্ষেত্রে বহাল থাকে) জারি করে। তবু কি জনাব মুহিত বুঝতে পারেন না, আদালতের হাত কত লম্বা। সেই হাতকে খাটো করার ক্ষমতা ‘রাবিশ’ উচ্চারণে অভ্যস্ত লোকটির তো নাই-ই, সংসদেরও এখতিয়ারবহির্ভূত। সংসদ, আদালত, প্রশাসন এবং দেশের সমগ্র প্রান্তিক জনতাকে নিয়েই দেশ। একে তো নাচুনে বুড়ি তার উপরে ঢোলের বাড়ি। মৌলিক অধিকারবিবর্জিত, সংশয়চিত্ত আজকের আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রান্তিক জনতা যখন সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটা নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। দুই দাম্ভিক নেতৃত্বের প্রচণ্ড একগুঁয়েমি ও দাম্ভিকতায় সীমাহীন দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে গণতন্ত্র যখন ইনসেনটিভ কেয়ারে তখন সরকারি দলের বয়োবৃদ্ধ নেতার এ ধরনের অসাংবিধানিক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তি এবং সর্বপ্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ বিএনপি যে কোনো ছল-ছুতায় সরকারের পদত্যাগের দাবি উত্থাপন করে দেশটাকে রাজনৈতিকভাবে ক্রমে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে— তার বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরব হওয়ার জন্য সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজকে স্ব স্ব আঙ্গিকে এবং সম্মিলিতভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ পরিক্রমণের অভিযাত্রী হিসেবে বেদনাহত চিত্তে হৃদয়ে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ নিয়ে লক্ষ্য করছি, এ দেশটি ক্রমান্বয়ে দুর্নীতিতে ছেয়ে যাচ্ছে। যে প্রত্যাশা নিয়ে, দুর্নীতিবিমুক্ত মৌলিক অধিকারের সূর্যস্নাত যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আমরা ’৭০-এর নির্বাচনের ম্যান্ডেটকে ভিত্তি করে গোটা মার্চের অগ্নিঝরা দিনগুলোয় ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি করেছিলাম, ’৭০ সালের নির্বাচনটি অনুষ্ঠিতই শুধু নয়, ৯৮ ভাগ মানুষের ম্যান্ডেট আদায় করতে পেরেছিলাম। রক্তস্নাত বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক এবং সর্বস্তরের প্রান্তিক জনতার মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারে উজ্জীবিত হয়ে আমরা উত্তাল মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিরলস ও নিষ্কলুষ আন্দোলনের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে শুধু একটি চেতনার মোহনায় দাঁড় করাইনি, সাফল্যের সৈকতে বিজয়কে প্রতিস্থাপিত করতে পেরেছিলাম। সেদিন আমাদের হৃদয়ের কোনো জায়গায়ই আজকের অবক্ষয়ে নিমজ্জিত সামগ্রিক সমাজব্যবস্থার এই জীর্ণদশার কোনো প্রতিবিম্ব ছিল না। বঙ্গবন্ধুর দিগন্তবিস্তৃত হৃদয় এবং আমাদের মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যোদয়ের মতো পবিত্র হৃদয়ের কোথাও ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তা, পদ-পদবির কোনো প্রলোভন এতটুকু ঠাঁই পায়নি। আমরা ভাবতেও পারিনি, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে এসেও সমগ্র দেশটিকে দুর্নীতির ঘনঘোর অমানিশার মধ্যে অবরুদ্ধ দেখতে হবে।

আজকের গণতান্ত্রিক অধিকারবিবর্জিত এ সমাজটি অকস্মাৎ আসেনি। এজন্য অতিসূক্ষ্ম কৌশলে পটভূমি তৈরি করা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সমগ্র দেশের যত্রতত্র অস্ত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। মুক্তিযোদ্ধারাও অস্ত্র সমর্পণ করেননি, স্বাধীনতাবিরোধীরা তো নয়ই। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি যখন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন ভয়ভীতি ও আশঙ্কা তার বা আমাদের কোনো পরিচয়ই ছিল না। পদ-পদবি, ঐশ্বর্য-প্রাচুর্য, ভোগ-বিলাস আমাদের আকাঙ্ক্ষার আবর্তে ছিল না। স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে— এই গর্বে বক্ষ স্ফীত ছিল, বিজয়ের স্লোগানে কণ্ঠ মুখরিত ছিল।

জীবন সায়াহ্নে এসে আজকের বাংলাদেশ, যেখানে কিছু উন্নয়ন আছে বটে কিন্তু মৌলিক অধিকার নেই। সমগ্র দেশটি দুটি দাম্ভিক নেতৃত্বের সাংঘর্ষিক মানসিকতা ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার মুখোমুখি। এক নির্মম অভিশাপের দুর্বিপাকে আমরা কোন পাপে পড়ে গেলাম! দেশটির এই দৈন্যদশা দেখে হৃদয়ের বিস্তীর্ণ ক্যানভাসে তাই আজকে প্রধান আত্মজিজ্ঞাসা।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ’৭০-এর নির্বাচিত এমএনএ ও এমএলএদের নিয়ে গঠিত হয় কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি। তারা বঙ্গবন্ধুর নিঃস্বার্থ অভিপ্রায়ের আঙ্গিকে একটা সময়োপযোগী এবং যথার্থ শাসনতন্ত্র দেশের জন্য প্রণয়ন করেন। যেটিকে ম্যাগনাকার্টা হিসেবেও অভিহিত করা যেতে পারে। যে শাসনতন্ত্রের অনুচ্ছেদে অনুচ্ছেদে মানুষের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ছিল। ইচ্ছা করলেই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ’৭৫ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারত। কিন্তু গণতান্ত্রিক মানসিকতায় উজ্জীবিত সংগঠন আওয়ামী লীগ ’৭৩-এর নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত করে ’৭২ সালে রচিত শাসনতন্ত্রের পক্ষে গণম্যান্ডেট পাওয়ার জন্য। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের মানুষ বুক উজাড় করে ’৭২-এর শাসনতন্ত্রের পক্ষে ম্যান্ডেট প্রদান করে ’৭৩-এর নির্বাচনে। সেই নির্বাচনের স্বতঃস্ফূর্ততা ইতিহাসের অবিস্মরণীয় ঘটনা।

মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তিরা গর্তের মধ্যে লুকিয়ে গিয়েছিল। আমাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো কোনো শক্তিই তাদের ছিল না। ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে আসা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য তাদের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনে। আর তাদের পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতায় ও অর্থায়নে এবং জাসদের অস্ত্রে দেশে ক্রমে গণতান্ত্রিক মানসিকতা ধ্বংসের ধারা শুরু হয়। একদিকে জাসদের গণবাহিনী, সিরাজ শিকদার, হক, তোহা ও টিপু বাহিনীর সশস্ত্র ও ভয়ঙ্কর দৌরাত্ম্য এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে অপপ্রচার দেশটিকে ক্রমেই অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। অন্যদিকে রাশিয়াসহ কমিউনিস্টরা বঙ্গবন্ধুকে ক্রমাগত উসকানি দিতে থাকে গণতন্ত্রের পথ বর্জন করে একদলীয় সমাজব্যবস্থা কায়েমের।

বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ঘাপটি মেরে বসে থাকা গণতন্ত্রের শত্রুরা সুযোগ খুঁজতে থাকে। সামরিক বাহিনীর ২৬ জন দুরাচার পাপিষ্ঠ এই আগস্টের ১৫ তারিখে নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রেরও মৃত্যু ঘটে।

’৭৫-এর পর বিভিন্ন ধারাবাহিকতায় নির্বাচন হয়েছে বটে, কিন্তু গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও অবস্থা তথৈবচ। এর পরিবর্তন, মৌলিক অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং নির্ভেজাল গণতন্ত্রের জয়যাত্রা না দেখে গেলে একটা না পাওয়ার হাহাকার ও অতৃপ্তি নিয়ে আমাকে দুনিয়া থেকে যেতে হবে। আমার কোনো রাজনৈতিক দল নেই। তবুও আমি প্রতিনিয়ত আমার বক্তব্যে, লেখনীতে ও সার্বক্ষণিক চিন্তা-চেতনায় গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে অবারিত প্রচেষ্টায় নিমগ্ন থাকি।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর