রবিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

কোর্টের রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ‘স্নায়ুযুদ্ধ’

কাজী সিরাজ

কোর্টের রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ‘স্নায়ুযুদ্ধ’

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় সারা দেশে এখনো আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ব্যাপারে সরকারি দলের, এমনকি মনে হয় সরকারের প্রতিক্রিয়াও নেতিবাচক। সরকার ও সরকারি দল বলছে— এ রায়ে তারা হতাশ, ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ। আর সরকারের মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি কালবিলম্ব না করে বলে দিয়েছে, এ রায় যথার্থ। রায় ঘোষণার পর বিএনপিকে বেশ উত্ফুল্ল মনে হচ্ছে। বুঝে হোক, না বুঝে হোক, সর্বত্র তাদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সরকারি দলের বিরুদ্ধে যেন একটা ‘উইন-উইন’ ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।  ক্ষমতাসীন দলের ওপর এর একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়েছে। তাদের মধ্যে কেমন জানি একটা শঙ্কার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। এ যেন দুই দলের মধ্যে একটি ‘স্নায়ুযুদ্ধ’। গত সাড়ে আট বছরের ধারাবাহিক শাসনকালে শাসক লীগকে এমন একটি বিব্রতকর ও বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে বলে মনে পড়ে না। বিএনপি সুযোগ বুঝে যেন চেপে ধরেছে সরকার ও সরকারি দলকে। বিএনপি ছাড়াও ১৪ দলীয় সরকারি জোটের বাইরের কোনো কোনো দল ও বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের রায়কে যৌক্তিক বলছেন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীতে বর্তমান শাসক দল বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করেছিল। এর আগে এ ক্ষমতা ছিল বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের’ হাতে। সরকার ও সরকারি দলের দায়িত্বশীলদের যুক্তি হচ্ছে, এ ব্যবস্থা সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া কর্তৃক প্রবর্তিত এবং আরেক সেনাশাসক জেনারেল এরশাদ কর্তৃক অনুসৃত— যা গণতান্ত্রিক চেতনাবিরোধী ও বাহাত্তর সংবিধানের লঙ্ঘন। তাই তারা ব্যবস্থাটি রদ করে ক্ষমতাটি পুনরায় সংসদের ওপর ন্যস্ত করেছেন। এটি আংশিক সত্য, পুরো সত্য নয়। বাহাত্তর সংবিধানে এ ক্ষমতা সংসদের হাতে ছিল বটে, কিন্তু বাকশাল ব্যবস্থা কায়েমের চতুর্থ সংশোধনীতে ক্ষমতাটি রাষ্ট্রপতির হাতে নিয়ে আসা হয়েছিল। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থাটি সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া প্রবর্তন করেছিলেন, সরকার ও সরকারি দলের এ বক্তব্যও সঠিক। কিন্তু সমালোচনাকালে আর একটি সত্য তারা গোপন করছেন। সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী পাস হওয়ার ঘটনা খুব আগেকার নয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে টানা দীর্ঘ সাড়ে আট বছর। এখন তাদের দ্বিতীয় মেয়াদ চলছে। প্রথম মেয়াদের পুরোটাই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তারা সংবিধানে বহাল রেখেছিলেন। এমনকি আলোচিত-সমালোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ নানা বিষয়ে পাস করা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতেও ব্যবস্থাটি তারা বহাল রেখেছিলেন। অর্থাৎ  ব্যবস্থাটি উত্তম ভেবেছিলেন। কাজেই এ ব্যাপারে এককভাবে জিয়াউর রহমান বা সামরিক শাসকদের ওপর দোষ চাপানো এবং নিজেদের দায় এড়ানো ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করা বাস্তবতা-বর্জিত। তবে হ্যাঁ, সরকার ও সরকারি দলের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসতেই পারে। তারা হয়তো বিচার বিভাগের ওপর কিছুটা প্রভাব রাখতে চেয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতের উল্লিখিত রায়ে এমন বক্তব্যও এসেছে যে, ‘বিচার বিভাগকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।’

বিচার বিভাগ ন্যায়বিচারের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করে। সরকার ও সরকারি দলের এতে ভয়টা কোথায় বুঝতে পারি না। তবে এটুকু বুঝতে পারি, কোনো প্রকার দুশ্চিন্তা না থাকলে সরকারি দল বিচারপতি অভিশংসনের ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে নিয়ে যেত না। একেবারে নিকটবর্তী চিন্তা থেকেই সংশোধনীটি (ষোড়শ) পাস করা হয়েছিল বলে ধারণা আছে কারও কারও। এ ব্যাপারে সরকার ও সরকারি দলের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয়। কোনো এক সামরিক শাসক প্রবর্তন করেছিলেন বলে ব্যবস্থাটির ব্যাপারে আপত্তি থাকলে ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ নামটি বদলে দেওয়া যায় কিনা ভাবতে পারত সরকারি দল। ব্যবস্থাটি বিচার বিভাগের মর্যাদার প্রশ্নে শোভন ও সমীচীন কিনা তা কি বিবেচনা করা যায় না? কোনো বিষয়ে আপত্তি বা দ্বিমত থাকলে সুপ্রিম কোর্টের কাছে সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়ার কি কোনো সুযোগ ছিল না? ব্যাপারটি নিয়ে ‘গভীর’ আলোচনা ও মতামত দেওয়ার বিশেষজ্ঞ আমি নই। তবে যেহেতু লেখালেখি করি, পাঠকরা বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন, রায় প্রকাশের পর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত রায় এবং এর পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য, যুক্তি, বিশ্লেষণ পড়ে আমার যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে তা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাচ্ছি। সরকার ও সরকারি দল এ রায় কিন্তু প্রত্যাখ্যান করেনি। প্রয়োজনে আইনি মোকাবিলার কথা বলছে। তবে দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্টরা বার বার পরিষ্কার করেছেন যে, রায়ের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল। সরকার ও সরকারি দল বাতিল হওয়া ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে উদাহরণ দিচ্ছে তা কিন্তু সবল নয়। তাছাড়া কোনো কিছু উত্তম না হলে তা অনুসরণ করতে হবে কেন? গত কদিনে এ ব্যাপারে যা জানার চেষ্টা করেছি তাতে বুঝেছি সংসদীয় অভিশংসনের ব্যবস্থাটি এখন ভারতসহ বিভিন্ন বড় গণতন্ত্রের দেশে প্রশ্নবিদ্ধ। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ‘বোঝাপড়ার’ স্তরে আছে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এ প্রসঙ্গে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বিচারকদের অপসারণের প্রক্রিয়া পরীক্ষা করে দেখার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট দেখতে পান যে, এসব দেশের বেশির ভাগ দেশে বিচারক অভিশংসনের প্রক্রিয়া প্রধানত দলীয় দৃষ্টিকোণ ও রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে ইতিমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ জন্য ভারতে সুপ্রিম কোর্ট সংস্কার সাধনের প্রস্তাব রেখেছেন। এতে একটি স্বাধীন বিচারবিভাগীয় কমিশন দ্বারা বিচারকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা প্রমাণের কথা বলা হয়েছে। আর কমিশন বা কাউন্সিল বিচারকদের দ্বারা গঠনের কথা বলা হয়েছে। তিনি ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, এসব দেশের অভিজ্ঞতা পরিষ্কার করেছে যে, সংসদীয় অভিশংসনের প্রক্রিয়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতাকে উত্তরোত্তর দুর্বল করেছে’ (দৈনিক প্রথম আলো, ৭ আগস্ট ২০১৭)।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ব্যাপারে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কতটা সিরিয়াস তা বোঝা যায় সাম্প্রতিক একটি পদক্ষেপ থেকে। এ ব্যাপারে নয়াদিল্লি থেকে আশিস গুপ্তের পাঠানো একটি খবর গত ৭ আগস্ট ’১৭ দৈনিক আমাদের অর্থনীতিতে ছাপা হয়। ‘ভারতে বিচারপতি নিয়োগে সরকারি হস্তক্ষেপে রাজি নয় সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট’ শিরোনামের খবরে বলা হয়, ‘বিচারপতি নিয়োগে সরকারি হস্তক্ষেপের চেষ্টা আটকে দিয়েছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।’ দেশে প্রধান বিচারপতি জে এস খেহরসহ পাঁচ সিনিয়র বিচারপতি নিয়ে গঠিত ‘কলেজিয়াম’ ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দিয়েছে, বিচারপতি নিয়োগে কলেজিয়ামই শেষ কথা বলবে। এই নিয়োগে কেন্দ্রের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। কেন্দ্রীয় সরকার এসব নিয়োগের জন্য যে আলাদা কমিশন গঠন করতে চেয়েছিল তা অসাংবিধানিক বলেও জানিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কেন্দ্রীয় বিচার মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর পাওয়া গেছে।... কেন্দ্রীয় সরকার চাইছিল, এবার থেকে ‘কলেজিয়ামের’ বদলে “ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশনের (এনজেএসি) মাধ্যমে বিচারকদের নিয়োগ করা হোক। পাঁচ বিচারকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী এবং দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে এই কমিশনের সদস্য করা হবে বলে কেন্দ্র জানিয়েছিল।... সরকারের সিদ্ধান্ত আটকে দিয়ে বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া ‘কলেজিয়াম’ নিজের হাতেই রেখেছিল। তবে কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রণালয়ও চেষ্টা ছাড়েনি। এনজেএসি গঠনের বিরুদ্ধে যে রায় সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা দিয়েছিলেন তা পুনর্বিবেচনা করার আবেদন জানানো হয়েছিল আইন মন্ত্রকের তরফে। নিউজ-৯৮ এর এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আর কোনো পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন নেই বলে কলেজিয়ামের পাঁচ সদস্যই সহমত হয়েছেন। কলেজিয়াম মনে করছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার স্বার্থেই বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে থাকা জরুরি।” ভারতের সুপ্রিম কোর্ট উল্লিখিত দুটি বিষয়ে যে দৃঢ় ও স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে তাতে বিচার বিভাগের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার ব্যাপারে তাদের সুচিন্তিত ও সম্মিলিত মনোভাবেরই প্রকাশ ঘটেছে। যারা সব কিছু না ভেবে বলছেন যে, বাংলাদেশ আর পাকিস্তান ছাড়া সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বিচারপতিদের সংসদীয় অভিশংসন প্রক্রিয়া চালু আছে। তারা ভারতের সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান পর্যালোচনা করলে নিশ্চয়ই তাদের যুক্তিকে আর ধারালো মনে করবেন না। সংসদীয় অভিশংসন প্রক্রিয়া চালু থাকলেও এ ব্যাপারে সর্বত্র বিচার বিভাগের মধ্যে যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে, এ তথ্য তাদের যুক্তি ও অবস্থানকে একেবারেই নড়বড়ে করে দিয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার, শাসক দল, সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার ও শাসক দলীয় নেতানেত্রীরা বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে এগোলে অনেক ভালো করবেন। যেসব দেশে বিচারপতিদের সংসদীয় অভিশংসন প্রক্রিয়া চালু আছে সেসব দেশের সর্বোচ্চ আদালত যে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে না ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রকাশ্য অবস্থান দেখে কেউ তা বলতে পারেন না। বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই যেমন বিশ্বের অনেক দেশ থেকে ব্যতিক্রম এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ও অগ্রণী হয়ে থাকবে বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।

আগেই উল্লেখ করেছি, সরকার রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। প্রধান বিচারপতিও বলেছেন, রায়ের গঠনমূলক সমালোচনা হতে পারে। সরকার ও সরকারি দল নিশ্চয়ই বিষয়টি নিয়ে ভাববে, ভাবা উচিত। তবে একটি কথা অভিজ্ঞজনরা বলছেন, রায় নিয়ে সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি এত উল্লসিত না হলে এবং এ রায়ের ফলে ‘এই বুঝি সরকার পড়ে গেল’ ভাব সৃষ্টির চেষ্টা না করলে সরকার ও সরকারি দলের রি-অ্যাকশনটা এমন আক্রমণাত্মক হতো না হয়তো। চির বৈরী প্রতিপক্ষের আচরণ শাসক দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের ভিতর ভীতিসঞ্চারক ও আতঙ্ক সৃষ্টিকারী হওয়ায় নেতা-কর্মীদের মনোবল শক্ত রাখার জন্য সরকার ও সরকারি দল বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিয়ে আবেগতাড়িতভাবে এমন কিছু বলে ফেলেছে মনে হয় যা নীতির নয়, শুধুই আবেগের। এখন পর্যন্ত উচ্চ আদালতের ভূমিকায় মনে হচ্ছে, বিষয়টি তারা উদারভাবে দেখছেন। সরকার ও সরকারি দলের কাছে নিবেদন করব, কোনো বিষয়ে কোথায় থেমে যেতে হবে নিশ্চয়ই তা বোঝার ক্ষমতা আপনাদের আছে, প্রধানমন্ত্রীর তো অবশ্যই আছে। যেখানে ভারতের মতো শক্ত ভিতের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকার সুপ্রিম কোর্টকে সমীহ করছে। আমাদের দেশেও তা করলে বিচার বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্র ও সরকারের মর্যাদাও বাড়বে। পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসও বৃদ্ধি পাবে। সরকার ও সরকারি দল রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে কঠোরভাবে সমালোচনামুখর। তাদের মতে, সংসদকে অবমাননা করা হয়েছে এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হেয় করা হয়েছে ও মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার মূল্যায়নের পর আওয়ামী লীগের এ অভিযোগটি অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে বলে মনে হয়। সাতজন মাননীয় বিচারপতিই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, এই ধারা স্বাধীন মত প্রকাশের ব্যাপারে সংসদ সদস্যদের হাত-মুখ বেঁধে দিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল যেহেতু সরকার গঠন করে তাই সরকার, সরকারি দল ও আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতির চালচিত্র অনুযায়ী দলের প্রধান নেতার ইচ্ছাতেই সব হয়— এটা কি মিথ্যা? বিচার বিভাগের এ ব্যাপারে শঙ্কার কারণ থাকতে পারে না তা তো নয়। বিষয়টি এমনই মনে হয়। সংসদ নিয়ে আলোচনা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সূত্র ধরেই হয়েছে। বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। বর্তমান সংসদের গঠন, প্রকৃতি, ভবিষ্যৎ  নির্বাচন ও সংসদ গঠন এবং গণতন্ত্রের বিকাশের স্বার্থে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের গুরুত্ব নিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর তো কম আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হোক তা আমি চাই না।’ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও পর্যবেক্ষণ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের মূল স্পিরিটের সঙ্গে কি সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক? তারপরও কোনো বিষয়ে যদি অমত, দ্বিমত ও ক্ষোভ থাকে তার প্রতিকারের জন্য আইনি পথে হাঁটতে পারে সরকার ও সরকারি দল। আইনমন্ত্রী তেমন কথাই বলেছেন। সরকারের মন্ত্রী মিনিস্টার ও সরকারি দলের কোনো নেতার বক্তব্য সর্বোচ্চ আদালতের নজরে পড়েনি বিএনপি তা ভাবল কী করে? তারা কেন এ ব্যাপারে অস্থিরতায় ছটফট করছে। তাদের আচরণে মনে হয়েছে তারা সরকার ও বিচার বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বিচার বিভাগকে দিয়ে তাদের প্রতিপক্ষকে কাবু করতে চায়। যোগ্য ও সবল নেতৃত্বে মজবুত সংগঠন ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিকভাবে রাজনৈতিক মাঠে পরাস্ত করতে না পারলেই একটি রাজনৈতিক দল নানা অবলম্বন খোঁজে। বিএনপির সমর্থক তো সরকারি দলের সমর্থক থেকে কম বলে মনে হয় না। রাজনীতিতে হার-জিতের খেলাটা প্রকাশ্য রাজনীতির মাঠে-ময়দানেই হোক না। এমন কোনো কাজ তাদের করা উচিত নয় যাতে বিচার বিভাগ বিব্রত হয়। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সাময়িক রাগ-বিরাগ-উত্তেজনার দ্রুত অবসান হোক।  সব মতদ্বৈধতার অবসান হোক, সম্মানজনক সমাপ্তি ঘটুক সব কিছুর।  স্বমহিমায় উজ্জ্বল থাক আমাদের বিচার বিভাগ, রাষ্ট্রের অপর দুই ‘অঙ্গের’ সঙ্গে সম্পর্ক থাক আস্থার, ভালোবাসার।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর