রবিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাজনীতিতে সহনশীলতার বিকল্প নেই

রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী

রাজনীতিতে সহনশীলতার বিকল্প নেই

আমাদের দেশটিকে নিম্নমধ্যম আয়ের রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ করার জন্য বর্তমান সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব যে বিরল-সাফল্য অর্জন করে চলেছেন তাতে তাদের নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু সুশাসনের বেলায় এ সরকারের অর্জন সবকিছুকে ম্লান করে দেয় বার বার, ঠিক তেমনি সার্বিকভাবে আমাদের রাষ্ট্রটির গণতন্ত্রহীন দশার জন্য দেশে-বিদেশে নিন্দিত হতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের প্রধানতম উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এটাকে দেশের স্নায়ুকেন্দ্র বললে ভুল বলা হবে না। সেই প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম ও দুর্নীতির যেসব অভিযোগ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে তাতে জনগণ হতাশ হতে বাধ্য— সেটা ‘জাতীয়-লজ্জা’র বিষয় বলে পরিগণিত হচ্ছে।

দুর্নীতির কারণেই প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প-ব্যয় করার পরেও ঢাকা মহানগর এখনো জলাবদ্ধতার নগরী, বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয় করেও চট্টগ্রাম মহানগর এখন জলাবদ্ধতায় বন্দী। দেশের প্রধান দুটি নগরীর এ নরকতুল্য দুর্দশায় নগরবাসী দিশাহারা—এ ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে বর্তমান সরকারের। অথচ এ ব্যাপারে প্রতিকার করার লক্ষ্য নিয়ে সরকারের উদ্যোগও দায়সারাগোছের।

বলা চলে, এ সরকারের আমলে একটি প্রতিষ্ঠানও নেই যেখানে দুর্নীতি হয় না, চাকরি-বাকরি সবই হয় ঘুষের বিনিময়ে, কেনাকাটা যা কিছু হয়, ঠিকাদারির মাধ্যমে, সবই হয় উেকাচের বিনিময়ে। চোখ-কান খোলা রেখে চললে যে কেউই তা দেখতে পাবে, জানতে পারবে।

ডাকসু, রাকসু, ইউকসুসহ সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঝুলে আছে দুই-আড়াই যুগ ধরে। এসব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রসংসদগুলোর নির্বাচন দেওয়া হলে বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন নির্বাচিত হয়ে আসতে পারে এই ভয়ে নির্বাচন দেওয়া হচ্ছে না সুদীর্ঘ দুই/আড়াই যুগ ধরে। ফলে নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসার পথ রুদ্ধ। আর পাশাপাশি সরকারি দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে। তাতে প্রাণহানি হয়েছে অনেক, এখনো হচ্ছে, কিন্তু সরকারের হেলদোল নেই তাতে। বদনাম যতই হোক, সন্ত্রাসীদের শাসন করতে পারছে না, আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতৃত্ব। সরকারের সদিচ্ছা প্রমাণের জন্য অবিলম্বে সব উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন দিতে হবে।

এরই সঙ্গে যোগ হয়েছে— প্রধানমন্ত্রীর ‘ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব’। বেগম খালেদা জিয়া ইউরোপে গেছেন চিকিৎসা করাতে, প্রবাসে অবস্থানরত নিজের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সময় কাটাতে, সেখানে কিছু রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে তিনি যেতে তো পারেনই, বিভিন্নজনের সঙ্গে তার একক বা যৌথ বৈঠকও চলতে পারে। তাতে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী একজন প্রবীণ রাজনীতিক বেগম খালেদা জিয়া ‘ষড়যন্ত্র-হোতা’ হন কীভাবে! ষড়যন্ত্র করতে হলে ব্রিটেনে যাওয়ার দরকার পড়ে!

জনপ্রিয় এক দৈনিকের খবর (৮ আগস্ট)— খাদ্য অধিদফতরের আনা ৩৩ হাজার মে. টন (যার দাম প্রায় ৯০ কোটি টাকা) গম হাওয়া করে দিয়েছে সরকারের কর্মচারীরা, এখন কেউই দায়িত্ব নিচ্ছে না, দুর্নীতির এই রূপ সম্পর্কে সরকার কী বলবে?

পুরান ঢাকায় দেশ-কাঁপানো যে বিশ্বজিৎ  হত্যাকাণ্ড ঘটে প্রকাশ্য দিবালোকে, (সবার সামনে কুপিয়ে ও পিটিয়ে যে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়) সরকারি দলের ছাত্রসংঠনের সন্ত্রাসীদের দ্বারা, সেই ঘটনার বিচারে হাই কোর্টের রায়ে নিম্ন-আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর মধ্যে ছয়জন সর্বোচ্চ দণ্ড থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। যেখানে ভিডিওচিত্রে সব খুনিকে হত্যা-তৎপরতায় সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, সেখানে পুলিশ ও ফরেনসিক রিপোর্টের ব্যর্থতার জন্য দায়ী কে? সরকারি প্রতিষ্ঠান নয় কি? 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির সবাইকে আন্দোলন করতে ব্যর্থতার জন্য পদত্যাগ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি একটা ব্যাপার তো বলেন না— বিএনপিকে রাস্তায় দাঁড়াতে দিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, কার নির্দেশে? তাদের সরকারের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে নয় কি! বিএনপি গণতান্ত্রিক আন্দোলন তাহলে কীভাবে করবে? আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবারও ৭ আগস্ট বিএনপিকে উদ্দেশ করে বলেছেন— ‘আদালত ক্ষমতায় বসাবে, বিদেশিরা ক্ষমতায় বসাবে— এমন রঙিন খোয়াব এই দেশে সফল হবে না।’ বিএনপি চেয়ারপারসন বা অন্য শীর্ষ নেতারা তেমনটা ভেবে রেখেছেন সেই প্রমাণ কি তিনি দিতে পারেন? অবশ্যই পারবেন না। গাত্রদাহ ঝাড়ার রাজনীতি কোনো সুস্থ-রাজনীতির ভাষা হতে পারে না, কাদের সাহেবের মতো ঝানু রাজনীতিক সেটা নিশ্চয়ই জানেন।

প্রতিবেশী ভারতসহ দুনিয়ার সব দেশেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নিজ নিজ রাষ্ট্রের সব স্বার্থের ব্যাপারেই আন্তঃসংলাপ ব্যবস্থা কায়েম রয়েছে। এক দল আরেক দলকে ‘ষড়যন্ত্রকারী’, ‘দেশপ্রেমহীন’, ‘রাষ্ট্র ধ্বংসকারী’, ‘ষড়যন্ত্রকারী’ ইত্যাদি অভিযোগ করে সব সময় তুলাধোনা করার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত নয় তারা। তারা একে অপরকে যোগ্য ভাবে, একে অপরকে সঠিক মূল্যায়ন করে। রাজনৈতিক মতানৈক্য তাদেরও আছে, তারাও সমালোচনা করে, তবে প্রতিপক্ষ দলটিকে ‘জানী-দুশমন’ ভাবে না তারা, এক দল আরেক দলকে ‘ফুঁ’ মেরে একেবারে উড়িয়ে দেয় না।

দেশে যে অকাম্য অবস্থা বিরাজ করছে তার অবসানে আগামী নির্বাচনের দিকে চেয়ে আছে মানুষ। কিন্তু নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে সরকারের মধ্যে কার্পণ্য বিরাজ করছে। তারা যেনতেন প্রকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহারের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ প্রবণতা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। দেশের স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতৃত্বকে উপলব্ধি করতে হবে, উদার হতে হবে, সৎ  পন্থা অনুসরণের মানসিকতা অর্জন করতে হবে— ১৫ ফেব্রুয়ারি বা ৫ জানুয়ারি মার্কা নির্বাচন আর কেউই গ্রহণ করতে রাজি নয়, নির্বাচন হতে হবে শতভাগ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক। এর কোনো বিকল্প কারও কাছে নেই। তাই,  বিরোধী সব পক্ষের সঙ্গেই বসতে হবে সরকারি দলকে, খোদ সরকারকে।

লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক

সর্বশেষ খবর