সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

ফারাক্কা বাঁধের লক গেট খুলে দেওয়া হয়েছে

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

ফারাক্কা বাঁধের লক গেট খুলে দেওয়া হয়েছে

বন্যা, খরা, সুনামি, আইলা প্রভৃতি দুর্যোগ কি কখনো ম্যান-মেড হয়? মানুষ কি এ বিপর্যয় তৈরি করতে পারে? এসব প্রকৃতির কর্মকাণ্ড। এর ফলে দেশে দেশে হাজার হাজার, লাখো লাখো লোক বছরের পর বছর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়েই যারা অহরহ খেলা খেলছেন, তাদের মধ্যে একজন হলেন ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। বিরোধী দলে থাকার সময় এই বিপর্যয়গুলোকে ম্যান-মেড বলতেন। এখন ক্ষমতায় এসেও বলছেন, ম্যান-মেড বন্যা।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে যে বন্যা চলছে, সেটাও ম্যান-মেড বলে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। যার পরিণাম দাঁড়াচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ মানুষ। চাষি, খেতমজুর এবং সাধারণ মানুষ বন্যার জলে ভেসে যাচ্ছে। কলার ভেলায় করে তাদের মৃতদেহগুলো সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কলার ভেলার ওপরেই শিশুর জন্ম হচ্ছে। এবার শুধু পশ্চিমবঙ্গের উত্তরেই নয়, বন্যা হয়েছে বাংলাদেশের উত্তর প্রান্তেও। বন্যা বাংলাদেশেও মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গেই শুধু নয়, বন্যা হয়েছে ভারতের রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটকের মতো রাজ্যে। যেখানকার মুখ্যমন্ত্রীরা কিন্তু বলছেন না, এটা ম্যান-মেড বন্যা।

পেশাগত জীবনে আমি ভারতের বিশিষ্ট সিভিল ইঞ্জিনিয়ার দেবেশ মুখার্জি এবং বাংলাদেশের দিনাজপুরের বি এম আব্বাসের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। দুজনের সঙ্গে আমার নানা সময় দেখা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের নদ-নদী নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা করেছি। আব্বাস সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয় পাকিস্তানের আইয়ুবের আমলে। সে সময় তিনি ফারাক্কার কাজ দেখতে এসেছিলেন। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী ফারাক্কা বাঁধের কাজ হচ্ছিল। ব্যারাজ তৈরির আগে গঙ্গার গতি রোধ করে দেওয়া হয়েছিল। তখন পায়ে হেঁটে গঙ্গা পারাপার করা যাচ্ছিল। সেই শুকনো রিভারবেডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেবেশ মুখার্জি এবং বি এম আব্বাস কথা বলছিলেন। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আমিও সে কথাবার্তা শুনছিলাম।

আব্বাস সাহেব দেবেশ বাবুকে হঠাৎ বললেন, দেবেশ তুমি তো অগস্তা মুনি। সব জলই তো শুষে নিয়েছ। শুনে দেবেশ বাবু বললেন, শোন আব্বাস, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি আগে একে অপরকে চিনতেন? দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠলেন, আমরা শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের রুমমেট ছিলাম। দেশভাগের পর আব্বাস চলে গেল পূর্ব পাকিস্তানে। একসঙ্গে চার বছর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি। আমরা সহপাঠী। তাদের কথোপকথন একটা কারণেই উল্লেখ করছি। তা হলো যে কোনো সমস্যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা যায়। পরবর্তীকালে ঢাকা এবং জাতিসংঘেও আব্বাস সাহেবের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। আমি যখন ঢাকায় ছিলাম, তখন তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সেচ উপদেষ্টা। তিনি প্রায়ই আমাদের অফিসে এসে দিল্লিতে ভারতের তৎকালীন সেচমন্ত্রী ড. কে এল রাওয়ের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিতে বলতেন। বেশ কয়েকবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেও দিয়েছিলাম।

তিনি প্রথমে আইয়ুব পরে বঙ্গবন্ধু এবং তারও পরে জিয়ার উপদেষ্টা ছিলেন। পুরনো ইতিহাস এ জন্যই লিখছি, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভাষায় বলা হয়, ভারত ও বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী রেইনকেড বা বৃষ্টির জলে পুষ্ট। কিন্তু খরার মৌসুমে দেখা যায়, নদীগুলোর নাব্য বালি পড়ে জল ধারণের উপযোগী থাকে না। শত শত কোটি টাকা খরচ করে বাঁধের পর বাঁধ দেওয়া হয়। যেহেতু নদীর নাব্য কমে গিয়ে বালি এবং চড়া পড়ে বেশি বর্ষা হলে, তা উপচে পড়ে। জেলার পর জেলা বন্যাকবলিত করে তোলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নদীগুলো কেন সংস্কার করা হয় না? বালি কেন অপসারণ করা হয় না? কেন তার নাব্য ঠিক রাখা হয় না? কারণ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব।

এ বছরের বন্যায় সেই বহু বিতর্কিত তিস্তায় এত জল ধরে রাখা গেল না। কারণ তিস্তা মজে গিয়েছে। সংস্কার করে তার নাব্য বাড়ানো হয়নি। একই সঙ্গে উত্তরবঙ্গের আত্রাই, মহানন্দা, ফুলহার, পুনর্ভবাসহ প্রায় ১০টি নদী প্লাবিত হয়ে পড়েছে। জল ধরে রাখতে না পেরে আশপাশের গ্রামাঞ্চল ভাসিয়ে জল ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশেও। নাব্য কমে যাওয়া ছাড়াও চড়া পড়ে গিয়ে সেখানে বসতি পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়েছে। নদী সংস্কার করার জন্য ভারত সরকার প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা রাজ্য সরকারকে অনুদান দেয়। কিন্তু সে টাকা কোথায় যায়, কে খায় তা বর্তমান ইঞ্জিনিয়াররা বলতে পারেন না।

ইতিহাস থেকে জেনেছি ১৯৪২ সালে দামোদর নদীর ভয়ঙ্কর বন্যায় কলকাতা সাত দিন জলের তলায় ছিল। সব রেললাইন জলের তলায় ডুবে যায়। তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেব দামোদরে বাঁধ দিয়ে জল আটকে রাখার একটি পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে ৭ জুলাই তখনো ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়নি, জওহরলাল নেহরু ও বিধান রায় মিলে আমেরিকার টেনেসি ভ্যালির একদল ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরি করান। সেই ’৪৮ সালেই দামোদর ভ্যালি করপোরেশনের কাজ শুরু হয়। এটাই ছিল জওহর লাল নেহরুর প্রথম স্বপ্ন। আর পাশে ছিলেন ড. বিধান চন্দ্র রায়।

নেহরুর আমলে চীনের চৌ এন লাই, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্ন, মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসেরদের ডিভিসি এলাকা ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছিল। ’৪২ সালের সেই ভয়াবহ বন্যার হাত থেকে কলকাতাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কলকাতার কাছে গঙ্গায় পলি জমে নাব্য এতই কমে যাচ্ছিল যে, বিদেশ থেকে বড় বড় ড্রেজার এনে পলি তোলার কাজ তারা শুরু করে গিয়েছিলেন। কলকাতার কাছে গঙ্গার ড্রেজিংয়ের জন্য কম করে হলেও ৪০ বছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কেন হয়নি তার জবাব দিতে পারেন রাজনীতিকরা।

এদিকে এবারের বন্যায় চরম বিপদের মধ্যে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, উত্তর দিনাজপুরসহ বিস্তীর্ণ উত্তরবঙ্গ। বিভিন্ন জায়গায় নদীর বাঁধ ভেঙেছে। জলমগ্ন হয়ে পড়েছে একের পর এক গ্রাম, ধসে পড়েছে সেতু। জলে ডুবে রয়েছে হাসপাতালও। নৌকা করে রোগীদের আনা-নেওয়া করা হচ্ছে। জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে বইছে জল। অসংখ্য মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন জাতীয় সড়কের ওপর। খাদ্য ও পানীয় জলের জন্য বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার পড়ে গিয়েছে সব ক’টি বানভাসি এলাকায়। গত ২৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে আত্রাই নদীর জল বিপদসীমা পার করে বইছে। বালুরঘাট, গঙ্গারামপুর, বুনিয়াদপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জনপদ কার্যত জলের তলায় চলে গিয়েছে। পুনর্ভবা নদীর জল কূল ছাপিয়ে গ্রামে ঢুকেছে। পুনর্ভবা, টাঙন, আত্রাই নদীর জলে একের পর এক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

গত কয়েক দিন যাবৎ লাগাতার বৃষ্টিতে বিহার এবং উত্তর প্রদেশেও গঙ্গার জল ফুলে উঠেছে। বাঁধ বাঁচাতে ফারাক্কা বাঁধের বেশির ভাগ লকগেটই খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ব্যারাজের নিচের অংশ মুর্শিদাবাদ। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে ব্যাপক নদী ভাঙন। মালদহের গঙ্গা ও ফুলহারের পাড়জুড়ে ব্যাপক ধস নেমেছে। বেশ কিছু বাড়ি ও চাষের জমি জলের তলায় তলিয়ে গেছে।

বৃষ্টি কমে গেলেও উত্তরবঙ্গের তিন জেলা জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও আলিপুর দুয়ারের পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। সর্বত্রই শুরু হয়েছে ত্রাণের জন্য হাহাকার। মাথা গোঁজার জন্য সামান্য ত্রিপল ও প্লাস্টিকের চাদরও পাননি অনেক মানুষ। জমা জল ও পচা আবর্জনা থেকে ছড়াচ্ছে একাধিক রোগও। বন্যাক্লিষ্ট অঞ্চলগুলোতে বহু মানুষ পেটের অসুখ ও অন্যান্য সংক্রমণ রোগের শিকার হয়েছেন। হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোও জলের তলায় চলে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসাও পাচ্ছেন না বন্যাদুর্গত মানুষ।

আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড, চীন প্রভৃতি দেশে নদীর নাব্য বজায় রাখার জন্য বছরে ৯ মাস নদীগুলোতে ড্রেজিং করা হয়। কারণ পলি পড়ে প্রকৃতির নিয়মেই। সুতরাং ড্রেজিং না করলে বছরের পর বছর বন্যায় চাষবাদ নষ্ট হয় এবং মানুষ ও সম্পত্তিহানি ঘটে।

এই লেখা যখন লিখছি, তখন পশ্চিমবঙ্গের বন্যা ১৫ দিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের উত্তর প্রান্তের সঙ্গে দক্ষিণ প্রান্তের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কবে তা স্বাভাবিক হবে সে ব্যাপারেও কোনো কথা কেউ বলতে পারছেন না। অথচ এই ভয়াবহ বন্যার মোকাবিলা কী করে করা হবে, সে কথা না ভেবে শুধু ম্যান-মেড বন্যা বলে দায় সেরেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

নাব্য ঠিক রাখা বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। এবার তিস্তাসহ উত্তরবঙ্গের নদীগুলোতে যে পরিমাণ বন্যা হয়েছে, সেই জল যদি ধরে রাখা যেত, তাহলে শুকনো মৌসুমে সেই জল বাংলাদেশকে দেওয়া কোনো কঠিন কাজ হতো না। নাব্য বাড়িয়ে নদীগুলোর জল ধারণের ক্ষমতা তৈরি করার পরিকল্পনার দায়িত্ব প্রশাসনের। গবাদিপশু ও মানুষের প্রাণ, কৃষিজ ফসল এবং সম্পত্তি রক্ষায় সেই প্রশাসকদের কানে কবে জল ঢোকে সেটাই এখন দেখার। লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর