সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

কোনটা বিকৃতি, কোনটা বঙ্গবন্ধুর অসম্মান

শওগাত আলী সাগর

কোনটা বিকৃতি, কোনটা বঙ্গবন্ধুর অসম্মান

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায় নিয়ে এক ধরনের ‘যুদ্ধাবস্থা’ তৈরি হয়েছে দেশে। সমরাস্ত্র নিয়ে কেউ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে না পড়লেও ‘বাক অস্ত্র’ নিয়ে সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীরা, শাসক দলের নানা পর্যায়ের নেতা-কর্মী প্রধান বিচারপতির ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করেছেন। বাহ্যত ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া রায় নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কিছু বলা হচ্ছে না। রায়ে দেওয়া প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পর্যবেক্ষণ নিয়েই যতই ক্ষোভ-বিক্ষোভ। অবস্থা দৃষ্টে মনে হতে পারে, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে চলে যাওয়া নিয়ে সরকার কিংবা শাসক দলের তেমন কোনো মনোবেদনা নেই। তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মান রক্ষায় এক ধরনের ‘ধর্মযুদ্ধে’ অবতীর্ণ হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের অভিযোগ—প্রধান বিচারপতি পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করেছেন। আইনমন্ত্রী ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মিট দ্য প্রেস’-এ প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলেছেন। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও বলেছেন, প্রধান বিচারপতি নাকি ‘বাবার নাম ভুলিয়ে’ দিতে চেয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল সরাসরি এ মামলার শুনানিতে অংশ নিয়েছেন। তার জমা দেওয়া ঢাউস লিখিত বক্তব্য প্রধান বিচারপতির অনেক মন্তব্যের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়েছে রায়ে। তবে এদের কেউই সুস্পষ্টভাবে কোন বক্তব্যের মাধ্যমে ‘বাবার নাম ভুলিয়ে’ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে কিংবা কোন অংশে ইতিহাস বিকৃতির উপাদান আছে, তা উল্লেখ করেননি। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির ‘মিট দ্য প্রেসে’ উপস্থিত থাকা সাংবাদিকদের কেউও আইনমন্ত্রীর কাছে জানতে চাননি, প্রধান বিচারপতি কোন ইতিহাসটা বিকৃত করে নতুন কী ইতিহাস তার রায়ে সংযুক্ত করেছেন। ফলে পুরো যুদ্ধটাই চলছে অনেকটা হাওয়ার ওপর।

কেউ কেউ অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, মামলার বিচারের বিষয়বস্তু হলো বিচারক অপসারণ-সংক্রান্ত ১৯৭২ সালের সংবিধানের একটি মূল অনুচ্ছেদ ৯৬ ফিরিয়ে আনা। ওই অনুচ্ছেদে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ছিল সংসদের হাতে। এ বিষয়ে রায় দিতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বিষয় টেনে এনেছেন। আদালতের কার্যক্রম সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারা জানেন, রায় লেখার একটি নির্দিষ্ট ফরমেট আছে। সেই ফরমেটে শুনানিতে উপস্থাপন করা যুক্তি-তর্কের ব্যাপারে আদালত তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। আলোচ্য মামলায় রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল তার উপস্থাপনায় সংসদ ও সংবিধান সৃষ্টি হওয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। আদালতে জমা দেওয়া লিখিত নিবেদনে তিনি ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণ, বাহাত্তরের বাংলাদেশ গণপরিষদে ড. কামাল হোসেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, আসাদুজ্জামান খান, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, তাজউদ্দীন আহমদের দেওয়া বক্তৃতা তুলে ধরেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, সংবিধান রচনা এবং প্রথম সংবিধানের মৌল বিষয়সমূহ নিয়ে প্রধান বিচারপতিকে মন্তব্য করতে হয়েছে। এটি রায় লেখার নির্দিষ্ট এবং অনুসৃত ফরমেট এবং নজিরের কারণেই ঘটেছে। বলা যায়, অ্যাটর্নি জেনারেলের নিবেদনই প্রধান বিচারপতিকে ইতিহাসের মাঠঘাট রায়ে তুলে আনতে হয়েছে।

ইতিহাসের মাঠঘাট তুলে আনতে গিয়ে কি প্রধান বিচারপতি কোনো বিকৃতি ঘটিয়েছেন? কোনো বাহুল্য ঘটিয়েছেন? রায়ের বিশ্লেষণ এবং পর্যালোচনা বলে—প্রধান বিচারপতি কোনো বাহুল্য করেননি, বিকৃতি তো নয়ই। তিনি বরং ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের প্রতি সশ্রদ্ধ থেকেছেন, ইতিহাসের প্রতি শতভাগ সত্যনিষ্ঠ থেকেছেন।

আসুন, আদালতের রায়ে দেওয়া প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের দিকে নজর দেই। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, “...ইয়াহিয়া খান অবশেষে নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন, ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করতে পারে—এটি ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কল্পনারও অতীত। সমগ্র দেশের জন্য একটি সংবিধান রচনার লক্ষ্যে এই নির্বাচন হয়েছিল।

ইয়াহিয়া খান শেষ পর্যন্ত সমগ্র পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি। বরং তিনি নিরস্ত্র, নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত গণহত্যা সংঘটিত করেন। তিনি জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন বাংলাদেশের অসহায় জনগণকে নির্বিচারে হত্যায় মেতে ওঠেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।” এই অংশটুকু প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ থেকে হুবহু উদ্ধৃত করা হয়েছে। এই বক্তব্যের কোথায় ইতিহাস বিকৃতি আছে? বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন—এটি কি সত্য ইতিহাস নয়? তা হলে আইনমন্ত্রী কিসের ভিত্তিতে বলেছেন, প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণে ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে।

এবার আসি প্রধান বিচারপতির যে উক্তিটি নিয়ে এত হৈচৈ হচ্ছে সে প্রসঙ্গে। শাসক দলের নেতা এবং মন্ত্রীদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘কোনো একজন ব্যক্তি দ্বারা কোনো একটি দেশ বা জাতি তৈরি হয়নি।’ মূলত এ বক্তব্যটির মধ্যেই তারা বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা, অস্বীকার করার উপাদান বের করে তুলকালাম বাঁধিয়ে দিয়েছেন। সিনিয়র একজন মন্ত্রী দেশের সর্বোচ্চ আদালতের শীর্ষ বিচারপতিকে প্রকাশ্য জনসভা থেকে তাচ্ছিল্যভরে ‘তুমি’ সম্বোধন করেও বক্তৃতা করেছেন।

আদালতের রায়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রধান বিচারপতির যূথবদ্ধ একটি বক্তব্যের একটি অংশ এই উক্তিটি। পুরো প্যারাটি থেকে একটি লাইনকে বিচ্ছিন্ন করে এটি নিয়ে আলোচনা করলে পর্যবেক্ষণের মূল স্পিরিটই কেবল ব্যাহত হয় না, অর্থের বিকৃতিও ঘটে। প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, “No nation- no country is made of or by one person. If we want to truly live up to the dream of Sonar Bangla advocated by our Father of the nation, we must keep ourselves free from this suicidal ambition and addiction od I’ness, that only one person or one man did all this etc.” ‘কোনো জাতি বা দেশ কোনো এক ব্যক্তিকে দিয়ে গড়ে ওঠে না, কিংবা কোনো একজন দ্বারা তা গঠিতও হয় না। আমরা যদি সত্যিই জাতির জনকের সোনার বাংলা’র স্বপ্নের পরিপূর্ণতা চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের আমিত্বের আসক্তি এবং এই আত্মঘাতী অভিপ্রায় থেকে মুক্ত হতে হবে।’

প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যের তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য পর্যবেক্ষণে এই বক্তব্যের আগের অংশটুকু পড়ে নিতে হবে। লক্ষণীয়, প্রধান বিচারপতি কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের বিবরণ দিতে গিয়ে ‘কোনো জাতি বা দেশ কোনো এক ব্যক্তিকে দিয়ে গড়ে ওঠে না, কিংবা কোনো একজন দ্বারা তা গঠিতও হয় না।’— এই মন্তব্যটি করেননি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের স্পিরিট আলোচনার সূত্র ধরে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলায় বসবাসের শর্ত হিসেবে তিনি এই উক্তিটির অবতারণা করেছেন। অর্থাৎ তার মতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের স্পিরিটই ছিল এটি।

একটা কথা উল্লেখ করা দরকার। প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের আগ পর্যন্ত ঘটনা প্রবাহে শেখ মুজিবুর রহমান বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে তিনি জাতির জনক শব্দটি বেছে নিয়েছেন। ইতিহাসের উপাদানও তো তাই। বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্মের পর থেকেই তো শেখ মুজিব জাতির পিতা, প্রধান বিচারপতি সম্বোধনের ক্ষেত্রে সেই ধারাবাহিকতাটি সচেতনভাবেই অনুসরণ করেছেন।

বলছিলাম প্রধান বিচারপতির চোখে বাংলাদেশের সংবিধানের মূল স্পিরিটের কথা। প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম বাক্যের প্রথম শব্দটি হচ্ছে ‘আমরা’। ‘আমরা’—এই শব্দ এবং এর ‘আমরা’ এর চেতনার ওপরই একটি জাতির শক্তি নিহিত। একটি জাতি গঠনের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে এই ‘আমরা’। একটি জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এই ‘আমরা’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটা কমিউনিটিতে যারা থাকেন তারা যতক্ষণ না ‘আমরা’বাদ এর রহস্যময় রসায়নে নিজেদের একীভূত করে ফেলতে না পারেন ততক্ষণ একটি কমিউনিটি কমিউনিটিই থেকে যায়। যে মুহূর্তে তারা এই পর্যায়ে উন্নীত হয় তখনই একটি কমিউনিটি জাতিতে রূপান্তরিত হয়। জাতি গঠনের অতি অপরিহার্য এই উপাদান সম্পর্কে আমাদের ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’রা অনুধাবন করেছিলেন বলেই সংবিধানের প্রথম বাঁকেই তারা সংযুক্ত করেছিলেন, “We, the people Republic of Bangladesh, having proclaimed our independence on the 26th day of March, 1971 and, through a historic struggle for national liberation, established the independent, soverign people’s Republic of Bangladesh.” প্রধান বিচারপতি বলছেন, এর অর্থ হচ্ছে জনগণ সর্বময় ক্ষমতার উৎস, জনগণই হচ্ছে সত্যিকার অর্থে সার্বভৌমত্বের অর্জনকারী, সংবিধানেরও। কাজেই সংবিধানের মুখবন্ধ বলছে আমাদের সংবিধানের আইনি ভিত্তি হচ্ছে জনগণ, যারা আসলে প্রকৃত ক্ষমতার উৎস।

জনগণের গুরুত্ব তুলে ধরতে পর্যবেক্ষণের এই পর্যায়ে এসে প্রধান বিচারপতি আবার মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহে ফিরে গেছেন। তিনি বলছেন, ‘এত অল্পসংখ্যক অস্ত্র নিয়ে, এত অল্পসংখ্যক প্রশিক্ষিত যোদ্ধা নিয়ে সামরিক লড়াইয়ের ইতিহাসে কেউ কোনো যুদ্ধে জিততে পারেনি। কিন্তু ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণ সেটি করেছে। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত একটি প্রশিক্ষিত হিংস্র সেনাশক্তির বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করেছি, আমরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। তাদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য নিয়ামক কী ছিল? কেবল অস্ত্রশস্ত্র? উত্তর হচ্ছে—না। এটি ছিল ‘আমরা জনগণ’-এর দুর্জয় সাহসিকতা, প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি, সহযোগীদের ঐকান্তিক অনুভূতি যা—পাকিস্তানিদের জন্য দুর্জেয় করে দিয়েছিল। এই অভিন্ন একাত্মতার প্রতিফলনই ঘটেছে সর্বোচ্চ সামাজিক দলিল সংবিধানের প্রথম বাক্যে।’ তিনি বলছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে পশুশক্তির বিরুদ্ধে বীরোচিত লড়াইয়ের কথা মনে রেখেই আমাদের প্রতিষ্ঠাতারা সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে সর্বময় ক্ষমতা জনগণের বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।’

প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, ‘আমরা যদি সতর্কতার সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের দর্শনের দিকে নজর দেই তাহলে দেখব, “আমরা বাংলাদেশের জনগণ” থেকেই আমাদের সব মৌলিক চিন্তা-ভাবনা বিকশিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে আমরা যে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি তার মূলে রয়েছে এই “আমরাবাদ” (উইনেস) প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এখন আমরা অজ্ঞতা ও স্বেচ্ছাচারিতার কবলে পড়ে। এই আমরাবাদকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছি।’ এর পরেই তিনি সেই বাক্যটি ব্যবহার করেছেন যা নিয়ে শাসক দল ও সরকার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে যাচ্ছে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রধান বিচারপতির এই পর্যবেক্ষণটির আগে বা পরে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা বা মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা নিয়ে কোনো আলোচনা ছিল না, যে কারণে মনে হতে পারে, বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বকে এখানে অস্বীকার করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়া, তার স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া—এ পর্যন্ত যথাযথভাবেই তিনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সংবিধানের ক্ষমতার আলোচনায় সঙ্গত কারণেই জনগণের ক্ষমতার প্রশ্নটি আলোচনায় এসেছে, কেননা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত সরকারই সংবিধানে জনগণকে সর্বময় ক্ষমতার উৎস বলে স্বীকৃতি দিয়ে রেখেছেন। প্রধান বিচারপতি সেই আলোচনাটুকুই এখানে তুলে ধরেছেন মাত্র। সেই আলোচনায়ই মুক্তিযুদ্ধে দেশের নিরস্ত্র জনসাধারণের ইস্পাতকঠিন ঐক্য পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষিত বিশ্লেষণই ‘কোনো একজন ব্যক্তি দ্বারা কোনো একটি দেশ বা জাতি তৈরি হয়নি’—বাক্যটি এসেছে। সেই বিশ্লেষণটি তিনি দেখিয়েছেন সংবিধানে জনগণকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে উল্লেখের প্রেক্ষাপট বর্ণনায়। বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে—সে তথ্য তো তিনি আগেই বলে ফেলেছেন।

প্রধান বিচারপতি কিন্তু এই বাক্যটির পরেও আরও কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধ নেতৃত্ব দিয়েছে (বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে)। কিছুসংখ্যক উগ্রপন্থি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ছাড়া সর্বস্তরের জনগণই এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।’ প্রধান বিচারপতি এখানে কোনো ভুল তথ্য দিয়েছেন? তা হলে?

প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক এবং দেশটির জাতির জনকের মর্যাদায়ই রেখেছেন। তার ঘোষিত স্বাধীনতার ডাক বাস্তবায়নে সর্বস্তরের জনগণের ইস্পাতকঠিন ঐক্য আর অসম সাহসী লড়াইয়ে সমন্বিত জনতার কৃতিত্বের বিবরণে যে বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেই বাক্যে স্বাধীনতার স্থপতির অবমাননা খোঁজা, তাতে ইতিহাসের বিকৃতি খোঁজা আমাদের মানসিক দীনতাকেই প্রকট করে তোলে।

লেখক : টরন্টোর বাংলা পত্রিকা ‘নতুনদেশ’-এর প্রধান সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর