মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাইফুর রহমান : আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি

লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.)

সাইফুর রহমান : আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি

সেপ্টেম্বর মাস চলছে। ২০০৯ সালের এ মাসের ৫ তারিখে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় সাইফুর রহমান আকস্মিকভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। সাইফুর রহমানের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। অনেক দীর্ঘ পথ পরিক্রমণ। বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি দলের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থেকেছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত কাছের মানুষ-বিশ্বস্ত অনুগত, friend and philosopher if not gide. সাইফুর রহমান বাংলাদেশের উন্নয়নের ইতিহাসে এক কিংবদন্তি পুরুষ। চার-চারবার সরকারে থেকে ১২টি জাতীয় বাজেট তিনি প্রণয়ন করেছেন। সংসদে উপস্থাপন করেছেন, জাতিকে উপহার দিয়েছেন।  বাংলাদেশের তথা দক্ষিণ এশিয়াসহ এই সমগ্র অঞ্চলে এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। অবিশ্বাস্য। দারিদ্র্যপীড়িত, অনুন্নত, বহুল সমস্যাজর্জরিত একটি দেশকে স্বনির্ভর অর্থনীতির ওপর দাঁড় করাতে তিনি বিরামহীন কঠোর পরিশ্রম করেছেন। বিনিদ্র রজনী যাপন করেছেন। তার ছিল অর্থনৈতিক দূরদৃষ্টি, বিশ্ব-অর্থনীতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান। ছিল প্রজ্ঞা আর বিচক্ষণতা। আর ছিল অদম্য সাহস আর বিশ্বাস। দক্ষিণ এশিয়ায় তিনিই প্রথম রাজনীতিক অর্থনীতিবিদ যিনি বাজার-অর্থনীতি এবং বিশ্বায়নের বাস্তবতার সুদূরপ্রসারিত গুরুত্বকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তিনিই প্রথম যিনি অর্থনীতিতে ব্যাপক সংস্কারের সূচনা করেন এবং বিস্তৃতি ঘটান। বাজার-অর্থনীতি value added tax (VAT)-এর প্রবর্তন নব্বই শতকে অভাবনীয় ছিল। সাইফুর রহমানের এটি ছিল একটি দুঃসাহসী পদক্ষেপ। অনেক সমালোচনা এসেছে। শুল্কের এই নতুন অবিশ্রুত সংযোজন মানুষ গ্রহণ করতে চায়নি। এমনকি নিজের দলের মধ্যেও অনেক বিতর্ক এসেছে। কিন্তু তিনি অবিচল থেকেছেন। সাইফুর রহমান ১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংকের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংকের গোল্ডেন জুবিলি স্যালিব্রেশনে সভাপতিত্ব করেন। এটি বাংলাদেশের জন্য কম গৌরবের কথা নয়। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম অর্থনীতির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে যুগান্তকারী অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন, সংস্কার এনেছেন। তিনি ছিলেন এক উদারপন্থি, সংস্কারবাদী, বাস্তবতায় বিশ্বাসী, প্রাগমেটিক রাজনীতিক। তিনি বুঝেছিলেন বাংলাদেশকে যদি একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়, বিশ্বসভায় টিকে থাকতে হয়, যদি সমৃদ্ধির পথে আগুয়ান হতে হয়, দারিদ্র্যমুক্ত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়, তা হলে সংস্কার এবং ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে। মান্ধাতার আমলের চিন্তাধারার গড্ডালিকা প্রবাহ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যুগের দাবি মানতে হবে, যুগোপযোগী হতে হবে। তার এই চিন্তার বাস্তবায়ন করতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পূর্ণ আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। দুর্নীতির সর্বগ্রাসী করাল থাবা থেকে দেশকে রক্ষা করতে তিনি স্বাধীন জাতীয় দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমার মনে পড়ছে, ১৯৯১-১৯৯৬-এ বিএনপির শাসনামলে কোনো এক সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পাকিস্তান সফরে গেলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো বাংলাদেশের অর্থনীতির বিপুল উন্নয়নের কথা তুলে ধরেন এবং সফরসঙ্গী অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি হাস্যোচ্ছলে বেগম জিয়াকে বলেন, ‘আমরা আপনাকে দেশে ফিরে যেতে দেব। তাকে আমাদের এ-মুহূর্তে খুব প্রয়োজন। তার জাদুর হাতের স্পর্শে আমরা লাভবান হতে চাই।’

সাইফুর রহমানের চরিত্রে একটা বড় দিক ছিল তার স্পষ্টবাদিতা, তার সত্যকথন। আর সত্য বেশি সময়ই শ্রুতিমধুর নয়-শ্রুতিকটু। রূপ-নারানের কূলে জেগে ওঠে কবিগুরু অনুধাবন করেছিলেন সত্য যে কঠিন। রক্তের আখরে লেখা। সাইফুর রহমান কঠিনেরে ভালোবেসেছিলেন। তিনি বাস্তবতার নগ্নরূপ প্রত্যক্ষ করতে চোখ বন্ধ রাখেননি। তাকে অনেক সময় তার ক্যাবিনেট কলিগরা হয়তো ভুল বুঝেছেন, সমালোচনার তীর নিক্ষেপ করেছেন, তার রাজনীতির চলার মসৃণ পথকে বন্ধুর করেছেন; কিন্তু তিনি কখনো আপস করেননি। নিজের বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি। জীবনের শেষ আড়াইটি বছর তাকে আমি বেশ কাছে থেকে অনেক অন্তরঙ্গ পরিবেশে দেখার সুযোগ পাই। তিনি আমার কাছে তার অনেক অতীত স্মৃতিচারণ করতেন। অতীতের অনেক ঘটনা তুলে ধরতেন। সুখস্মৃতি রোমন্থন করতেন। অনেক ভুলভ্রান্তির কথাও উঠে আসত। আমি তাকে প্রায়ই বলতাম, আপনার জীবন অত্যন্ত বর্ণাঢ্য ঘটনার ঘনঘটায় সমৃদ্ধ। আপনি আপনার আত্মজীবনী লিখুন। ইতিহাসের মূল্যবান দলিল হয়ে থাকবে। প্রজন্মের কাছে এটা আপনার দায়বদ্ধতা। ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ তিনটি ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে আপনি আমাদের মাতৃভূমিকে প্রত্যক্ষ করেছেন, কাজ করেছেন, সংগ্রাম করেছেন, সরকার চালিয়েছেন। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে অনেক উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেছেন, ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করেছেন, সম্পৃক্ত হয়েছেন— এসব কথা অভিজ্ঞতার আলোকে লিখুন। আমি বলেছি, ইংরেজিতে একটি কথা আছে either pblish or perish। আর আপনি তো perishable item নন। Not at all. তাই আপনাকে pblish-এ থাকতে হবে। বিকল্প কিছু নেই। তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘কিছু কথা কিছু স্মৃতি’ প্রকাশনার প্রথম কপিটি আমাকে নিজের হাতে দুটি কথা লিখে উপহার হিসেবে তুলে দেন। বইটি তিনি লিখেছেন, পাবলিশ করেছেন একরকম নীরবে-নিভৃতে। কোনো প্রকাশনা উৎসব নয়, মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান নয়, কোনো টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরাবন্দী নয়। তার বইয়ের প্রায় পুরোটাই তিনি আমাকে বেশ কয়েকবার পড়ে শুনিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে তার বিভিন্ন স্মৃতির কথোপকথন বিভিন্ন ঘটনা তিনি উল্লেখ করেছেন। অনর্গল ক্লান্তিহীন বলে যেতেন। আমি একজন ভালো শ্রোতার ভূমিকা পালন করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যেতাম। গল্প বলায় যে কত সুখ, তা তাকে দেখে অনুভব করার চেষ্টা করতাম। সাইফুর রহমানের আদর্শ পুরুষ ছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া। তার সঙ্গী, বন্ধু-সহচর। সবচেয়ে অনুগত, সবচেয়ে আস্থাভাজন। তিনি আজীবন জিয়ার আদর্শের অনুসারী থেকেছেন, তাতে এতটুকুও ব্যত্যয় হয়নি, এতটুকুও চ্যুতি ঘটেনি। জিয়ার সাহস, সততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম তাকে উদ্বুদ্ধ রাখে, তার মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ধাবমান করে। সাইফুর রহমান দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। তাকে প্রায়ই এ্যাপোলো হসপিটালসে নিতে হতো। কিডনি, প্রস্টেটের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগেছেন। কিন্তু কী অদ্ভুত? অসুস্থতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেননি। একটি নির্মম সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পৃথিবী থেকে চলে গেলেন। তার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি-পরিবৃত বিশাল পরিবারের কাছে বিষয়টি মেনে নেওয়া বহু দিন পর্যন্ত খুব কঠিন হয়ে থাকবে। রোজার মধ্যেই তিনি ইন্তেকাল করলেন। ২০০৮ সালের রোজায় তার বাসায় একটা সুন্দর ইফতারি ও নৈশভোজের আয়োজন ছিল। তিনি বিদেশি কয়েকজন বন্ধুকেও নিমন্ত্রণ করেছিলেন। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর শিয়ান-চু (গণচীনবাসী)সহ আরও কয়েকজন। মানবজমিন-এর সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী কামাল ইবনে ইউসুফ ছিলেন। আমিও ছিলাম। সাইফুর রহমান সম্পর্কে আমার পাশে উপবিষ্ট শিয়ান-চু বলেছিলেন, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল এক দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাংকের করিডোরে বাংলাদেশ একটি আলোচিত নাম, একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। আর তা সম্ভব হয়েছে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের একক প্রচেষ্টায়। তিনি শতকরা সাত ছুঁইছুঁই জাতীয় প্রবৃদ্ধিকে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যক্ষ করতে এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্যে নিজেই উদ্যোগী হয়ে ঢাকায় নিয়োগ নিয়েছেন। মর্মান্তিক দুর্ঘটনার মাত্র দুই দিন আগে তিনি আমাকে টেলিফোন করে বললেন, ‘মাহবুবুর রহমান কী করেন? আমাকে দেখে যান। আমি কাল-পরশু সিলেট যাব ঠিক করেছি।’ এখানে প্রসঙ্গত বলে রাখি, তিনি আমাকে সব সময় পুরো নাম ধরে সম্বোধন করতেন। আমি বলতাম, স্যার এত বড় নাম কেন বলেন? শুধু মাহবুব বলবেন। তিনি বলতেন, কেন আমাকে তো সবাই সাইফুর রহমান বলেন, কেউ সাইফুর বলেন না। এত সহজ-সরল মানুষ ছিলেন তিনি। তার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা, কোনো আর্টিফিশিয়ালিটি কেউ কখনো খুঁজে পায়নি। হ্যাঁ, যে-কথা বলছিলাম, আমি পর দিন তার বাসায় যাই। দীর্ঘক্ষণ থাকি। এ কথা, সে কথা, দেশ-জাতি-রাজনীতি, দল-দলীয় কর্মকাণ্ড অনেক প্রসঙ্গ। আমি সাইফুর রহমান সাহেবের কথায় সেদিন অনেক উদ্বেগ, অনেক উৎকণ্ঠার প্রকাশ লক্ষ করি। তিনি বার বার বলছিলেন কী যে সব হয়ে গেল, এমনটি হওয়ার তো কথা ছিল না। আমাদের তো একটা ব্রাইট ফিউচার ছিল। তার বাসা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, সিলেট থেকে ফিরে আসি; আপনাকে ইফতারিতে ডাকব। হায়রে কী নিঠুর বিধির বিধান। তিনি আর ফিরলেন না। তিনি মহাপ্রস্থানে গেলেন। সব কিছু চাওয়া-পাওয়ার অতীতে, ঊর্ধ্বলোকে। বাংলাদেশের মানুষ, ঢাকার মানুষ, সিলেটের মৌলভীবাজারের মানুষ বাহার মর্দন গ্রামের মানুষ হৃদয়-নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে গভীর শ্রদ্ধাভরে অশ্রুসজল নয়নে দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়েছে।  আমরা ও তার গুণমুগ্ধ সবাই প্রাণভরে দোয়া করি।  তার রুহের মাগফিরাত কামনা করি।  আল্লাহর ওলি হজরত শাহজালাল (রহ.) ও হজরত শাহ পরান (রহ.)-এর দোয়ায় তিনি বেহেশতবাসী হোন।  আমিন।

            লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান।

সর্বশেষ খবর