বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

পীর বা বাবার কোনও প্রয়োজন আছে?

তসলিমা নাসরিন

পীর বা বাবার কোনও প্রয়োজন আছে?

আমার মা এক পীরের মুরিদ ছিলেন। পীর যা বলতেন, মা তাই বিশ্বাস করতেন। মা’র অসুখ হলে মা পীরের ‘পড়া পানি’ খেতেন। পড়া পানি খাওয়ার পর অসুখ বেড়ে গেলে মা আমার ডাক্তার বাবার শরণাপন্ন হতেন। বাবার চিকিৎসায় মা সেরে উঠতেন। তারপরও পীরের ওপর থেকে মা’র ভক্তি যায়নি। একবার পীর বললেন তিনি তাঁর সব মুরিদকে পাখনাওয়ালা ঘোড়ায় চড়িয়ে, উড়িয়ে নিয়ে যাবেন আরব দেশে। মা সহ সব মুরিদ বিশ্বাস করলেন এ কথা। মা তো সুটকেস গুছিয়ে তৈরি হয়ে ছিলেন। পরে কী কারণে যেন পীর তাঁর ‘উড়ে আরব যাওয়ার’ প্রজেক্ট ক্যান্সেল করেছিলেন। মুরিদরা তারপরও কোনও রকম সন্দেহ করেননি পীরকে। বিশ্বাস এমনই ভয়ঙ্কর।

বাংলাদেশের মুসলমানদের যেমন ‘পীর’, ভারতের হিন্দুদের তেমন ‘বাবা’। ‘বাবা কালচার’ বহু পুরনো। মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে পুঁজি করে বাবারা ব্যবসা করেন। কিছু মাতাও গজিয়েছে। হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাস প্রচণ্ড। এমন একটা পুরনো ধর্ম! অজস্র রূপকথা। লক্ষ কোটি দেব-দেবী। কাউকে মানলেও হয়, না মানলেও হয়। এই অঞ্চলের লোক দুর্গাকে মানে তো ওই অঞ্চলের লোক বিষ্ণুকে মানে। ধর্ম বিশ্বাস করায় বা ধর্ম পালন করায় কোনও জবরদস্তি নেই। নতুন প্রজন্মের হিন্দুদের সম্ভবত নাস্তিক হলেই মানাতো। কিন্তু নাস্তিকের সংখ্যা হিন্দুদের মধ্যে খুবই কম। দেব-দেবী তো মানেই, অধিকাংশ হিন্দু কুসংস্কার মানে। আঙুলগুলোয় কুসংস্কারের পাথর। গাড়িতে লেবু-লঙ্কা ঝুলিয়ে রাখে, বেড়াল দেখলে গাড়ি থামিয়ে ফেলে। জ্যোতিষী ব্যবসাও জমজমাট।

বাবারা দেদার ঠকাচ্ছে সাদাসিধে মানুষকে। কত বাবা যে ভক্তদের দেওয়া টাকার পাহাড়ে বসে আছে, আর নিশ্চিন্তে কুকর্ম করছে। সত্য সাঁই বাবা শুনেছি কচি কচি ছেলেদের ধর্ষণ করতেন। চারজন কিশোর প্রতিবাদ করেছিল বলে ওদের খুন করেছেন। অদক্ষ হাতে ছোট ছোট জাদু দেখাতেন। যে কেউ ইচ্ছে করলেই ধরতে পারে হাতের কারসাজি। কিন্তু ধর্মে অন্ধ হয়ে থাকলে আঙুলের ফাঁকে রাখা ছাইয়ের বড়ি কায়দা করে বের করে নিয়ে বুড়ো আঙুলে ঘষে যে ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে মানুষের মাথায়, ছাই যে খালি হাতের ওপর আকাশ থেকে পড়েনি, অথবা অদৃশ্য ভগবান এসে দিয়ে যাননি— তা দেখা যায় না। সাঁই বাবা কাশি দিলেন, আর গলা দিয়ে সোনার ডিম বেরিয়ে এলো? সোনার ডিমটা যে বাবার তোয়ালের আড়ালে ছিল, যে তোয়ালে বারবার মুখের কাছে নিয়ে কাশছিলেন, তা অন্ধ না হলে ধরা যেত। পুরস্কারের বাক্সের তলায় লুকিয়ে রাখা সোনার চেইনগুলো যে আঙুল বাঁকিয়ে নিয়ে আসছিলেন, স্বয়ং ভগবান যে তাঁর হাতে ফেলেননি চেইনগুলো, তা বিশ্বাসের অন্ধত্ব না থাকলে সবাই দেখতে পেতো। খুন ধর্ষণে ফাঁসবেন আঁচ করে হাসপাতাল বানিয়ে ফেললেন। পিঠ বাঁচাতে সমাজসেবা! সমাজসেবা কার টাকায় করেছিলেন? ওই তো মানুষের দেওয়া টাকায়। আশারাম বাপু মেয়েদের ধর্ষণ করতেন। রাম রহিম তো হারেম খুলে বসেছিলেন। এঁরা নিজেদের ভগবান ভাবেন। এত বাবা ধরা পড়ছেন, বাবাদের এত লুটপাট, খুন, ধর্ষণের খবর ফাঁস হচ্ছে— তারপরও বাবাদের ওপর বিশ্বাস মানুষের যায় না। বিশ্বাস এমনই ভয়ঙ্কর।

বিজ্ঞানে বিশ্বাস বাড়লে বাবায় বিশ্বাস কমবে। বিজ্ঞানে মানুষের বিশ্বাস বাড়ানোর কোনও চেষ্টা কেউ করছে বলে দেখিনি। টেলিভিশনে কটা চ্যানেল বিজ্ঞানের, কটা ধর্মের? ধর্মেরই তো দেখি সব! ধর্মে বিশ্বাস কমলে বাবা-ব্যবসা বন্ধ হবে। কী বলবো! ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞানী মন্দিরে ছোটেন ভগবানের কৃপা পেতে। মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করতে কত হাজার বছর আরও দরকার, জানি না।

বাঙালি মুসলমানের আদি নারী-পুরুষ হিন্দু। সম্ভবত হিন্দুর এই ‘বাবা কালচার’ থেকেই এসেছে মুসলমানের ‘পীর কালচার’। হিন্দুরা বাবা নিয়ে যে আদিখ্যেতা করে, মুসলমানরা পীর নিয়ে অনেকটা তাই করে। পীর ফার্সি শব্দ। পীর অর্থ বুড়ো লোক। কোনো কোনো সুফি যাঁরা আধ্যাত্মিক বিষয়ে শিক্ষা দিতেন, তাঁদের পীর বলা হতো। সুফি পীর মারা গেলে মাজার বানানো হতো। এখন তো ভণ্ড কিছু লোক মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে মূলধন করে পীর ব্যবসায় নেমে পড়ে। বাবাদের ভক্ত যেমন মিনিস্টার, ক্রিকেটার, কালাকার, পীরের মুরিদও তেমন। দেশের প্রেসিডেন্ট অবধি দৌড়োন পীরের অনুগ্রহ আর আশীর্বাদ পেতে। বড় বড় রাজনীতিক, ধনকুবের, আর বিখ্যাত সব মানুষ বাবা বা পীরের পায়ের ধুলো নিতে ব্যস্ত থাকেন বলে বাবা বা পীরের দাম বেড়ে আকাশে ওঠে। বাবা প্রতারণা করেন, পীরও তাই করেন। এই প্রতারকদের কবলে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু মুসলমান।

পীরে, হুজুরে ভরে গেছে বাংলাদেশ। বাঙালি মুসলমানদের নষ্ট হওয়ার পেছনে এরা অনেক বড় কারণ। এরা জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। দেশজুড়ে ওয়াজ করছে আর নারী বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। ইসলাম আল্লাহ ছাড়া আর কারো সামনে মাথা না নোয়ানোর কথা বলেছে। অথচ মুসলমানরা পীর হুজুরের পায়ে প্রতিদিনই মাথা নোয়াচ্ছে। তাদের চরণ ধোয়া পানি খাচ্ছে। অবিকল হিন্দুরা যা করে। ভক্তরা যেমন রাম রহিমকে গ্রেফতার করা হয়েছে এই খবর পেয়ে হরিয়ানার শহরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে, ভক্তরা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী নামের এক হুজুরের ফাঁসির রায় ঘোষিত হওয়ার পর একই রকম আগুন জ্বালিয়েছিল গোটা বাংলাদেশে।

যার ধর্ম যে যেভাবে খুশি পালন করবে। পীর বা বাবা বলে দেবে ধর্ম কী, সৃষ্টিকর্তাকে কীভাবে পাওয়া যায়, পীর বা বাবা জানে ভালো, তারা পথ দেখিয়ে দেবে— বাকোয়াজ সব। টাকা হাতানো বা মেয়ে হাতানো ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য তাদের নেই। এদের বাদ দিয়ে নিজের পথ নিজে খুঁজে নেওয়া ভালো। পীর বাবারা ক্ষতি ছাড়া মানুষের কোনও উপকার করে না। ধর্ম-ব্যবসাটা বন্ধ না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

            লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর