শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাহাবিদের সঙ্গে প্রিয় নবীর আনন্দ-বিনোদন

মুফতি মুহাম্মদ আল আমিন

সাহাবিদের সঙ্গে প্রিয় নবীর আনন্দ-বিনোদন

মানবতার মুক্তির দিশারী, মরুর দুলাল, দুজাহানের বাদশাহ রসুল (সা.) এর আচার-ব্যবহার ছিল অপূর্ব। সাহাবাদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অনেক গভীর। আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। সাহাবি বলা হয় এমন সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকে যিনি রসুল (সা.)-কে ইমানের সঙ্গে স্বচক্ষে দেখেছেন বা রসুল (সা.) তাকে দেখেছেন। কারণ কোনো সাহাবি এমনও ছিলেন যিনি অন্ধ। রসুলকে দেখেননি। তবে রসুল (সা.) তাকে দেখেছেন। সাহাবি শব্দের বহুবচন হলো সাহাবা। প্রত্যেক সাহাবি মনে করতেন রসুল আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। সর্বাধিক মহব্বত করেন। আমি প্রিয় নবীর সবচেয়ে বেশি প্রিয়। নবী (সা.) সাহাবাদের যেমন আদেশ-উপদেশ দিতেন, তেমনি আনন্দ-বিনোদনমূলক আচার-ব্যবহারও করতেন। কৌতুক করতেন। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, একবার নবী করীম (সা.) তাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে দুই কানবিশিষ্ট ব্যক্তি (আবু দাউদ, তিরমিজি)। এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, সব মানুষের কান দুটি। তবু ভালোবাসার আধার প্রিয়নবী স্নেহের আনাসকে ‘দুই কানবিশিষ্ট’ বলে বিনোদন করলেন। তার হৃদয়ে আনন্দ দিলেন। হজরত আনাস (রা.) আরও বলেন, নবী করীম (সা.) আমাদের সঙ্গে খুবই আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার করতেন। এমনকি তিনি একবার আমার ছোট ভাইকে বললেন, হে আবু উমাইর! তোমার ছোট বুলবুলিটি কোথায় গেল? তার একটি ছোট বুলবুলি পাখি ছিল, যা নিয়ে সে খেলা করত। পাখিটি মারা গিয়েছিল (বোখারি ও মুসলিম)। উভয় জগতের সরদার রসুলে আরাবী (সা.) কর্তৃক সামান্য বুলবুলি পাখির খবর নেওয়া শুধুই আনন্দ দেওয়ার জন্য। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একবার সাহাবিগণ বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আপনি আমাদের সঙ্গে কৌতুকপূর্ণ কথাবার্তা বলেন কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে আমি যা বলি সত্যিই বলে থাকি (তিরমিজি)। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত রয়েছে, একবার এক ব্যক্তি রসুল (সা.) এর কাছে যানবাহন হিসেবে একটি সওয়ারি চাইলে তিনি (কৌতুকছলে) বললেন, আচ্ছা আমি তোমাকে একটা উটের বাচ্চা প্রদান করব। এতে সে বলল, উটের বাচ্চা দিয়ে আমি কী করব? (অর্থাৎ আমি চেয়েছি প্রাপ্ত বয়স্ক উট, আর আপনি বলছেন উটের বাচ্চা দেবেন) জবাবে রসুল (সা.) বললেন, প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক উট তো তার মায়ের বাচ্চা (তিরমিজি, আবু দাউদ)। হজরত আনাস আরও বলেন, একবার নবী করীম (সা.) এক বৃদ্ধা মহিলাকে বললেন, কোনো বৃদ্ধা মহিলা বেহেশতে যেতে পারবে না। তখন সে বৃদ্ধা মহিলাটি জিজ্ঞেস করল কেন, তা কী কারণে? উক্ত বৃদ্ধা কোরআন পাঠ করেছিল। নবী করীম (সা.) বললেন, তুমি কি পবিত্র কোরআনে এ আয়াতটি পাঠ করনি? যার অর্থ ‘আমি তাদেরকে (অর্থাৎ স্ত্রীলোকদেরকে) বেহেশতে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করব এবং তাদেরকে (তখন) কুমারী বানাব’ (রাজিন)। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত। একবার নবী করীম (সা.) বাজারে আগমন করলেন। রসুলকে মহব্বতকারী জাহের নামে এক গ্রাম্য সাহাবি তথায় তার পণ্য বিক্রি করছিল। তখন নবী করীম (সা.) অগ্রসর হয়ে জাহেরকে তার পেছন দিক হতে জড়িয়ে ধরলেন। সে নবী করীম (সা.)-কে দেখতে পেল না; সুতরাং সে বলে উঠল, কে আপনি? আমাকে ছেড়ে দিন। অতঃপর সে চক্ষুর পাশ দিয়ে দেখল যে, তিনি নবী করীম (সা.)। তখন সে (আনন্দে) তার পিঠ নবী করীম (সা.)-এর বুকের সঙ্গে মিলিয়ে রাখল (এবং আরও বেশিক্ষণ এভাবে থাকার চেষ্টা করল)। এদিকে নবী করীম (সা.) বলতে লাগলেন, এ গোলামটিকে কে খরিদ করবে? তখন জাহের বলল, ইয়া রসুলাল্লাহ! আল্লাহর কসম, আপনি আমাকে সামান্য মূল্যের বস্তু হিসেবে পেয়েছেন কি? তখন নবী করীম (সা.) বললেন, আমার কাছে সামান্য মূল্যের বস্তু হলেও আল্লাহর কাছে তা নয় (শরহে সুন্নাহ)। হজরত নোমান ইবনে বশির (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একবার হজরত আবু বকর (রা.) নবী করীম (সা.) এর গৃহে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন, ওই সময় তিনি হজরত আয়েশা (রা.) এর উচ্চ আওয়াজ শুনতে পেলেন। অতঃপর ভিতরে প্রবেশ করেই তিনি হজরত আয়েশা (রা.)-কে ধরে তাকে চড় উঠিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, সাবধান! ভবিষ্যতে আর কখনো যেন রসুল (সা.) এর সামনে তোমাকে ওইভাবে চিৎকার করতে না দেখি। তখন নবী করীম (সা.) হজরত আবু বকর (রা.)-কে বাধা দিচ্ছিলেন। এরপর হজরত আবু বকর (রা.) রাগান্বিত অবস্থায়ই তথা বের হয়ে গেলেন। তিনি বের হয়ে যাওয়ার পর নবী করীম (সা.) হজরত আয়েশা (রা.)-কে বললেন, তুমি দেখলে তো এ ব্যক্তির হাত থেকে আমি তোমাকে কীভাবে রক্ষা করলাম? বর্ণনাকারী বলেন, এ ঘটনার পর কয়েক দিন পর্যন্ত হজরত আবু বকর (রা.) নবী করীম (সা.) এর ঘরে আসা বন্ধ রাখলেন। কিছুদিন পর হজরত আবু বকর (রা.) নবী করীম (সা.) এর গৃহে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন এবং প্রবেশ করে দেখলেন, নবী করীম (সা.) এবং হজরত আয়েশার (রা.) মধ্যে সম্প্রীতি এবং আপসের ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তখন তিনি তাদের উভয়কে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা আমাকেও তোমাদের এ আপস ও সম্প্রীতির মধ্যে শামিল করে নাও। জবাবে নবী করীম (সা.) বললেন, আমরা তাই করলাম, আমরা তাই করলাম (আবু দাউদ)। হাদিসের কিতাবে পাওয়া যায়, একবার হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-কে আনন্দ দেওয়ার জন্য নবী করীম (সা.) তার সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা দিলেন। নবীর স্বাস্থ্য ভারী হওয়ার কারণে এবং হজরত আয়েশার স্বাস্থ্য হালকা হওয়ার কারণে আয়েশা (রা.) দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়ী হলেন। কিছুদিন পর হজরত আয়েশা (রা.) এর স্বাস্থ্য ভারী হয়ে যাওয়ার পর রসুল (সা.) তার সঙ্গে আবার দৌড় প্রতিযোগিতা দিলেন এবং জয়ী হয়ে গেলেন। তখন তিনি আয়েশা (রা.)-কে বললেন, আগের প্রতিশোধ নিলাম। সাহাবাগণও মাঝে মাঝে প্রিয় নবীর সঙ্গে কৌতুক করতেন।

লেখক : খতিব, সমিতি বাজার মসজিদ, নাখালপাড়া, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর