রবিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কৃষকের প্রতি দায়বদ্ধতা

শাইখ সিরাজ

কৃষকের প্রতি দায়বদ্ধতা

পৃথিবীতে কৃষির ইতিহাস সূচিত হয় বীজের মাধ্যমে। কালক্রমে এ বীজই হয়ে উঠল মানুষের প্রকৃত সম্পদ। সেই প্রাচীনকাল থেকে কৃষক সংগ্রহ করতে চেয়েছে সবচেয়ে ভালো বীজটি। যা থেকে সে পাবে সোনার ফসল। দেবে সমৃদ্ধির নিশ্চয়তা। ভালো বীজেই ভালো ফসল এ সত্য মানুষ জানতে পারল আরও পরে। এখন আধুনিক কৃষি আর ঐতিহ্যবাহী কৃষি, সব কৃষিতেই ভালো বীজ মানেই কৃষকের লাভ আর ভালো ফসলের একমাত্র নির্দেশক।

দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে কৃষি। কৃষি উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে এর বহুমুখী বাণিজ্য বাড়ছে। কৃষির বহুমুখী উপকরণ জোগান দিতে এখন বড় বিনিয়োগ হচ্ছে কৃষি খাতে। দেশের বিশাল শিল্পগ্রুপগুলো তাদের নানা কার্যক্রমের পাশাপাশি বিনিয়োগ করছে কৃষিতে। বিস্মৃত হচ্ছে কৃষির ক্ষেত্রটি। মাঠের কৃষির পেছনে এখন বড় এক করপোরেট বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে দ্রুত ও পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছে বীজ খাত। এখন ব্যক্তি মালিকানাধীন বড় বড় কোম্পানি বিদেশ থেকে বীজ আমদানি করছে। তাদের কার্যক্রমের পরিধি শুধু বাইরে থেকে বীজ আমদানি করে বিক্রি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সরকারি নির্দেশনা মেনে এবং কৃষিপণ্যের বীজবাণিজ্যের রীতি মেনে বীজের ফলন ও উপযোগিতা নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে তারা। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বীজকেন্দ্রিক গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমেও অনুসরণ করছে সর্বাধুনিক নিয়মনীতি। বাংলাদশে এখন বিভিন্ন ফসলের বীজ আমদানি করছে শতাধিক কোম্পানি। এসব কোম্পানির দেশব্যাপী বীজের দোকান বা আউটলেট রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্যমতে, দেশে এখন বীজবাণিজ্য কয়েক হাজার কোটি টাকার। এ বাণিজ্য প্রতিদিনই প্রসারিত হচ্ছে।

সম্প্রতি পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জে এ আর মালিক সিড কোম্পানির একটি বীজ গবেষণা কেন্দ্র দেখতে গিয়েছিলাম। বীজ নিয়ে তাদের বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখে বিস্মিত হয়েছি। চল্লিশ একর জমির ওপর তারা বিশাল এক সবজি বাগান গড়ে তুলেছে, যা শুধু একটি সবজি বাগান নয়। এখানে তারা জাপানের বিখ্যাত বীজ কোম্পানি সাকাতার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাভার্ড (শেড) অবস্থায় আলু, বেগুন, পটোল, চালকুমড়া, লাউ, করলা, চিচিঙ্গা, ঢেঁড়সসহ কমপক্ষে ত্রিশটি শাকসবজির বীজের মান উন্নয়ন নিয়ে নিবিড় কাজ করছে। দেশে প্রায় অর্ধশতাব্দীকালের বীজবাণিজ্যের অভিজ্ঞতা রয়েছে এ বাংলাদেশি বীজ কোম্পানির। তারা বিভিন্ন সবজি ও ফলের ৮০টি জাতের বীজ আমদানি ও বাজারজাত করছে। বীজ আমদানির সঙ্গে জাত মূল্যায়ন ও গবেষণা পদ্ধতির একটি দীর্ঘ কর্মকাণ্ড রয়েছে তাদের।

কৃষকের চাহিদা আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই বীজ। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফসল উৎপাদন কমছে, কমছে মাটির গুণাগুণ, বাড়ছে নানারকম কীট ও রোগের আক্রমণ। বীজ কোম্পানিগুলোকে তাই কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী বীজ উৎপাদনের জন্য সংগ্রহ করতে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের তথ্য-উপাত্ত।

এ ক্ষেত্রে জলবায়ুর নানান ঘাত-প্রতিঘাত সহনশীল হাইব্রিড বীজের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। তাই সাকাতা থেকে বাংলাদেশের জলবায়ু, পানি, মাটি, খরা, বৃষ্টি সহনশীল জাতগুলো এখানে আনছে। জাপানি কোম্পানি সাকাতার বীজ আমদানি ও বাজারজাতের আগে প্রতিটি বীজের মাঠ পরীক্ষা, আবহাওয়া সহনশীলতা পরীক্ষাসহ নানা বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণের কাজটি চলে দুটি পর্যবেক্ষণ প্লটে। এক পাশে রয়েছে প্রথম ট্রায়াল (পর্যবেক্ষণ) প্লট। প্রিয় পাঠক, আমাদের দেশে যে হাইব্রিড বিশেষ জাতগুলো এখন বাজারে আছে, তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কোনটা ভালো করছে এমন বীজটা তারা এখানে ট্রায়াল করে থাকে। উৎপাদন কেমন হচ্ছে দেখে তারা সেটা পাঠিয়ে দিচ্ছে সাকাতায়। সেখানে বীজের উন্নয়ন ও উৎপাদনের পর তারা তা পাঠিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশে। এরপর তা সারা দেশে বাজারজাত হচ্ছে।

গবেষণার বিশাল এ শস্যখেত ঘুরে দেখা যায়, এখানে প্রতিটি ফসলের ভিন্ন ভিন্ন কোড রয়েছে। যা এ গবেষণাকর্মীরাও জানেন না। যাতে তারা কোনোভাবেই প্রভাবিত না হন সে কারণে অত্যন্ত সতর্কতাও অনুসরণ করা হয়। কর্মীরা শুধু গবেষণালব্ধ ফলাফল বীজের কোড অনুযায়ী পাঠায়। ডিকোডিংটা থাকে কোম্পানি অফিসে। তারা কোড অনুযায়ী ফলাফল (বীজের মান) মিলিয়ে নেয়। একটি শেডে দেখলাম বিভিন্ন জাতের মরিচ। সময় যত যাচ্ছে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন জাত। খামারে কর্মরত শ্রমিকদের কাছে প্রশ্ন করে জানা যায়, বাজারে এখন বিজলি প্লাস মরিচের বীজ খুব জনপ্রিয়। প্রতিটি গাছে ৩০০-৪০০টি মরিচ হয় এবং প্রতিটি গাছ পাঁচ থেকে ছয়বার ফলন দেয়। উল্লেখ্য, টমেটোর জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর হচ্ছে রোগজীবাণু। এর মাঝে ভয়াবহ একটি হচ্ছে ভাইরাস টিওয়াইএলসিভি আর একটি হচ্ছে ব্যাকটেরিয়াজাত রোগ। তারা এ দুই রোগ-প্রতিরোধকারী জাত উদ্ভাবন করেছে। করলার ক্ষেত্রে ৪০-৫০ গ্রাম ওজনের ১৫০টি করলা ধরবে এমন জাতের বীজও রয়েছে। গ্রীষ্মকালে পালং শাকের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। বেগুনের পর্যবেক্ষণ প্লটে গিয়ে দেখলাম কয়েকটি করে জাতের পাশাপাশি বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। শসার ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কয়েকটি জাতের ফলন এসেছে গাছভর্তি হয়ে। এক নজরে এ গোলাকার ছাউনির নিচ থেকে দেখলে অবাক হতে হয় ফলন বৈচিত্র্য দেখে। সত্যিই দেখার মতো। পাশেই করলার ছাউনি। এখানেও নানা জাতের করলা। শুধু আকার বা ফলন নয়, একেকটি সবজির বাজারজাত সুবিধার কথাও ভাবা হচ্ছে বীজ উৎপাদন পর্যায়েই। ধুন্দলের দুটি জাতের বাংলা নাম দেওয়া হয়েছে, ‘আর্তি’ ও ‘মমতা’। এ ছাড়াও রয়েছে চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা আর লাউয়ের জাতসহ আরও অনেক সবজি। বাজার ও ভোক্তা চাহিদাকে মাথায় রেখেই এখানে জাত নির্বাচন করা হচ্ছে বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী স্বপন মালিক। তিনি আরও জানালেন, বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের বাজার গবেষণা চালু থাকে। কোম্পানির গবেষণা কর্মীরা শুধু বীজ ব্যবহারকারীই নয়, এ বীজ থেকে উৎপাদিত ফল-ফসলের গুণাগুণ নিয়েও ভোক্তা পর্যায় থেকে মতামত গ্রহণ করে থাকে।

পাঠক, শুরুতেই বলেছি জাপানি কোম্পানি সাকাতার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ এ আর মালিক সিড। সাকাতার আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে তাদের এ গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ খামারে আসেন। তাদের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানেই বীজের মান নিয়ন্ত্রণসহ সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। আমি যখন গিয়েছিলাম তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাকাতা ইন্ডিয়ার মহাব্যবস্থাপক ড. প্রকাশ, সাকাতা জাপানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কোচি ইনেদা এবং এশিয়া মহাদেশের প্রধান জাপানি বিশেষজ্ঞ কাইরি ওকুইয়ামা। কথা হলো তাদের সঙ্গে।

ড. প্রকাশ জানান, এদেশে সবজি ফসলে হাইব্রিড বীজের বাজার দ্রুত বাড়ছে। দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসলের ফলন নিয়েও দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষক। এ কারণেই তারা ঝুঁকছেন হাইব্রিড বীজের দিকে। তাদের কাছে বেশি ফলন পাওয়াটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ একইভাবে জলবায়ু সহনশীল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতও তাদের প্রধান চাওয়া। তারপরও এ কথা বলতেই হবে, বাংলাদেশের খুব অল্পসংখ্যক কৃষক এখনো স্থানীয় জাতের বীজ দিয়ে সবজি উৎপাদন করছে। তবে বেশি ফলন যারা চান তারা অবশ্যই হাইব্রিড বীজই সন্ধান করেন। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো ফসলের বেশি ফলন ও কৃষকের বেশি লাভ নিশ্চিত করা। সাকাতার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কোচি ইনেদা বলেন, তারা যখন হাইব্রিড বীজ উন্নয়ন করেন তখন চিন্তা করতে হয় এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার ক্ষমতা নিয়ে। কোনো কোনো এলাকায় কিছু জাতের খুব ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে ট্রায়াল ফিল্ডে এসেও কিছু পরিবর্তন চোখে পড়ে। তখন জাত উন্নয়নে পুনরায় মনোনিবেশ করতে হয়।

বীজ নিয়ে এ গবেষণা নিঃসন্দেহে আগামী দিনের কৃষিকে সমৃদ্ধ করবে। উচ্চ ফলনশীল ফল-ফসলে ভরে উঠবে কৃষকের মাঠ। যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু একটি বিষয়ে শঙ্কা থেকে যাচ্ছে। কৃষকের মূল সম্পদ বীজ। বীজ থাকলে সেখান থেকে ফসল মিলবেই। কিন্তু এসব উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাতের বীজ কৃষক সংগ্রহ করতে পারে না। এখন বীজ সংগ্রহ করতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শরণাপন্ন হতে হয় বীজ কোম্পানির। প্রিয় পাঠক, দিনে দিনে বীজবাণিজ্যের পরিধি বেড়েই চলেছে। বিশ্বের নামিদামি কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশে। তারা তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থের পাশাপাশি এদেশের জলবায়ু, কৃষকের চাহিদা ও বাজার সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা নিয়েই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কার্যক্রম। এর মধ্যদিয়ে বিদেশি অনেক প্রযুক্তি ও কৃষি কৌশলও দেশীয় বীজ কোম্পানি থেকে শুরু করে কৃষকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। অবশ্যই এটি একটি ইতিবাচক দিক। একই সঙ্গে কৃষকের কাছে বীজ কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং কৃষকের অধিকার সংরক্ষণে কিছু বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। যাতে কোনো কোম্পানির বীজে কৃষক সামান্যতম ক্ষতির শিকার হলে ওই কোম্পানি তার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। আরও প্রত্যাশা করি কৃষিকেন্দ্রিক সব উৎকর্ষের সুফল আগে আসুক কৃষকের ঘরে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর