বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মানবতার বাংলায় ইসরায়েলি আজরাইলের ঘুরপাক

মোস্তফা কামাল

মানবতার বাংলায় ইসরায়েলি আজরাইলের ঘুরপাক

মিয়ানমারের দানবীয় ‘কিল অ্যান্ড বার্ন’ তৎপরতার বিরুদ্ধে মানবতার জয়গানের চ্যালেঞ্জে জিততে চায় বাংলাদেশ। শরণার্থীদের বিরতিহীনভাবে আশ্রয় প্রশ্নে বাংলাদেশের মানবতার এ নজির অনন্য। এমন হিম্মতের দৃষ্টান্ত নেই বিশ্বের সুপার পাওয়ার-ধনাঢ্য অনেক দেশেরও। মানবিকতায় অর্থ-সামর্থ্য নয়, মানসিকতাই মুখ্য— বাংলাদেশ তার প্রমাণ দিল আবারও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  এক্সক্লুসিভ-ইনক্লুসিভ এ কূটনৈতিক তৎপরতা আঁচ করতে সময় লেগেছে ঝানু অনেক কূটনীতিকেরও। নানা মহলের নানা মত, বিশ্লেষণ, তাগিদের মধ্যেও তিনি সমস্যাটিকে ধর্মীয় আবহে পড়তে দেননি। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের মতো পদক্ষেপে পা বাড়াননি। যাননি ধেয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পুশ ব্যাকের মতো কঠোরতায়ও। 

রোহিঙ্গারা ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্তের জিরো পয়েন্টে জড়ো হতে থাকলে বাংলাদেশের শুরুর পদক্ষেপ পরে পাল্টে যায়। বিজিবিসহ প্রশাসনের নজরদারি অল্প সময় পরেই থিতু করে আনা হয়। সংশ্লিষ্টদের কাছে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে ‘অত্যন্ত মানবিক আচরণ’ করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পৌঁছার পরই এ ব্যতিক্রম। নইলে গত কয়দিনেই পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নিত, ভাবা যায়? সমস্যা শুধু রোহিঙ্গা নামের কিছু জনগোষ্ঠীর আশ্রয় বা ভরণপোষণের নয়। এর আশপাশে অনেক ইকুয়েশন। পক্ষও বহু। কেবল বাংলাদেশ-মিয়ানমার নয়। বহুপক্ষের বহু হিসাবের অঙ্ক জমাট। ইস্যুটিতে বাংলাদেশসহ গোটা এ অঞ্চলের মানুষ, আর্থ-সামাজিক অবস্থা-অবস্থান, নিরাপত্তাসহ দেশীয়-আন্তঃদেশীয় স্থিতিশীলতা সম্পৃক্ত। ব্রিটিশ রাজত্বের জের, আঞ্চলিক-উপআঞ্চলিক হিসাব, একাত্তরের বিজয়, বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রগতিসহ আগে-পিছের নানা ঘটনার ক্যামেস্ট্রিতেই আজকের পরিস্থিতি।

এ ছাড়া বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের বন্ধুহীন দশা কে না বোঝে? স্বধর্মীয়দের কাছেও তারা মারধরের পাত্র। রোহিঙ্গা সমস্যায় ধর্মীয় সংঘাতের রং লাগালে অবস্থা এ কয়দিনেই কোথায় দাঁড়াত? প্রধানমন্ত্রী তা ভেবেছেন কূটনীতি ও বিচক্ষণতার উচ্চ মানদণ্ডে। আজকের দুনিয়ায় মানবিকতার বদলে শুধু ধর্মজোসে কারও পক্ষ নেওয়ার ভয়াবহ পরিণতির উদাহরণ ভূরি ভূরি। মিয়ানমার থেকে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে ধেয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানুষ না বলে শুধু মুসলমানিত্বে পরিচিত করানো অপরিণামদর্শী হতে বাধ্য। তা জানতে কূটনীতিক, অধ্যাপক, সমরবিদ, সাংবাদিক হওয়া জরুরি নয়। সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়াসহ কয়েকটি দেশে তেমনই হচ্ছে। গাজায় মরছে ফিলিস্তিনি নামে। মানুষ নামে নয়। তাদের কেবল মুসলিম বলতে গিয়ে মানুষ বা মানবিক পরিচয় গায়েব করে ফেলা হচ্ছে। অনেকেরই জানার কথা, এ যাবৎ প্রায় অর্ধলাখ কুর্দিশ মুসলমানকে খুন করেছে তুরস্ক। এরদোগানের হাতও মুসলমানের রক্তে মাখা। ‘নফর’দের মৃত্যুও তাদের ওপর নির‌্যাতন নিয়ে মাথা ঘামায় না আরবরা। আফগান-পাকিস্তানের মুসলিম মিল্লাতও কোনো রাও করে না। চীন-জাপানের নতুন মিত্র মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আমেরিকা হালকার ওপর ঝাপসা নিন্দা জানিয়ে বলে দিয়েছে মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে না। মুসলিম দেশগুলোর প্রাণের সংগঠন ওআইসিরও তেমন গাঝাড়া নেই রোহিঙ্গা নির‌্যাতনের ব্যাপারে। মিয়ানমারের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, সীমান্তে ভূমিমাইন বিস্ফোরণ, রোহিঙ্গাদের তাড়ানোসহ অব্যাহত রুক্ষতার মধ্যেও বাংলাদেশ সেই ফাঁদে পা দেয়নি। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মানবিকতার আর্জি মানবতার সঙ্গে কূটনীতিরও মুন্সিয়ানা। নাফ নদ পেরিয়ে আছড়েপড়া ‘রোহিঙ্গা ঢেউ’ নিয়ে সবদিক বিবেচনায় তার রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্তে বিশ্বনেতাদের অনেকেও চমকিত। উচ্ছ্বসিত প্রশংসার সঙ্গে কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতারেসও। মিয়ানমার সরকারের ওপর মৃদু-মন্দ বৈশ্বিক চাপ আসাও শুরু হয় এরপর থেকে। মানবিকতার এমন জয়গানের পরও পিছু ছাড়ছে না দানবীয়তা। বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা বিষে নীল করে উত্তপ্ত-অভিশপ্ত রাষ্ট্রে পরিণত করার নানামুখী চক্রান্ত। বাংলাদেশের ভিতর একটি ইসরায়েলি রাষ্ট্র জন্ম দেওয়ার আজরাইলি আয়োজনের শঙ্কা ঘুরপাক খাবিখাচ্ছে অনেক দিন ধরেই। ১৯৪৭-৪৮ সালে ফিলিস্তিনি এলাকায় বাধ্যতামূলকভাবে জন্ম ইসরায়েল রাষ্ট্রের। যেই সমস্যা সমাধানের কথা বলে জাতিসংঘও রাষ্ট্রটি তৈরিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই সমস্যা ফুলেফেঁপে এখন আরও তরতাজা। হাজার হাজার ফিলিস্তিনির নিজ মাতৃভূমি থেকে উত্খাত হয়ে বছরের পর বছর লেবাননসহ অন্যান্য দেশে উদ্বাস্তুর জীবন। আর মরে বেঁচে টিকে থাকাদের অবস্থা নিজ দেশে পরবাসী উদ্বাস্তুর মতো। রোহিঙ্গাদেরও কি সেই উদ্বাস্তুর জীবনের পথে বাধ্য করা হচ্ছে? আর সেই ভূগোলটি বাংলাদেশ? ফিলিস্তিনের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে সর্বহারা ইহুদিদের আশ্রয় বাগানোর প্রেক্ষিতও ছিল কিছুটা এমনই। যার জেরে আশ্রয়দাতা ফিলিস্তিনিরাই নিজগৃহে পরবাসী। আর আশ্রিত ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মদাতা। ঝরছেই ফিলিস্তিনের রক্তস্রোত। বিশ্বদরবারে এ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পূর্ণ স্বীকৃতি না থাকলেও ধর্ম, সম্প্রদায়, ভূ-কূটনৈতিক কারণে বিশ্বে তা কম ফ্যাক্টর নয়। বহির্বিশ্বে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মানই পান ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।

১৭ কোটি জনসংখ্যার ভারে নুয়ে পড়া বাংলাদেশের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আছড়ে পড়া রোহিঙ্গাদের নিয়েও টেনশন তাই অন্তহীন। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তায় প্রায়ই ছেদ ফেলছে তারা। বর্তমান সংখ্যা বাদ দিলেও লাখ ছয়েকের মতো রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজারসহ আশপাশের এলাকায় বসবাস করছে অবৈধভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরও তুলে ধরেছে বাংলাদেশের এ পরিস্থিতির কথা। ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র হিদার নোয়ার্ট বলেছেন, এ ভার বহন বাংলাদেশের জন্য একটি কঠিন।

ধর্মীয় স্বজাতি হিসেবে সেই ১৯৭৮-৭৯ থেকে বিরতিহীনভাবে এদেশে ধেয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। এক হিসাবে বলা হয়েছে, উত্তর রাখাইন রাজ্যের আট লাখ রোহিঙ্গার ৩০ শতাংশের ঠিকানা এখন বাংলাদেশে। কক্সবাজারেই নিবন্ধিত ২৯ হাজার। পলাতক চার লাখ। আর বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চম্পট দিয়েছে লক্ষাধিক। এদের নিয়ে চলছে ভয়ঙ্কর নানা তৎপরতা। স্থানীয়দের বাইরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কলকাঠি নাড়ানো হচ্ছে বিদেশ থেকেও। রয়েছে এনজিওগুলোর কিছু কারসাজিও। শুধু কক্সবাজার নয়, পার্বত্যাঞ্চলেও রোহিঙ্গার সংখ্যা কম নয়। তাদের স্থানীয় রাজনীতিতেও জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে। ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারও হতে শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারসহ আশপাশ এলাকায় বাঙালি আর রোহিঙ্গা তফাৎ করা কঠিন। তারা স্থানীয়দের মতোই আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলে। ওইসব এলাকায় শতাধিক স্কুল তৈরি করে রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলা ভাষায় শিক্ষা দিচ্ছে। বাঙালি করেই বড় করে তুলছে রোহিঙ্গা প্রজন্মকে।

ভূ-রাজনীতিসহ স্বার্থগত একাধিক কারণে রোহিঙ্গা ইস্যু হ্যান্ডেল করা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং। এর মধ্যেই ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা পরিসংখ্যানের হিসাবে পরিণত হয়েছে। কতজন এলো, কতজন রয়েছে নো-ম্যানস-ল্যান্ডে, কত লাশ দেখা গেছে নাফ নদে ভাসতে— এসব খবর তাও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আসল অঙ্ক কত? ভিতরে কী ঘটছে? সব তথ্য জানার উপায় নেই। বাংলাদেশকে ঘিরে চীন-ভারত কাছাকাছি চক্রে আবর্তিত। মিয়ানমারের কাছে রোহিঙ্গারা ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’। এ প্রশ্নে প্রতিবেশী ভারত কখনো নীরব, কখনো পরামর্শক। আর চীন বরাবরই মিয়ানমারের পক্ষে। এর বাইরে দূরদেশীয় শক্তির খেলাও কম নয়। ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা এতে আতঙ্কিত। কক্সবাজারসহ ওই অঞ্চলে নানা উসকানি ও জীবন-জীবিকার তাগিদে হেন অপরাধ ও অনৈতিক কাজ নেই যা তারা না করছে। মাদক ও সন্ত্রাস, দস্যুতা, দেহব্যবসাও বাদ নেই। এদের দিয়ে কে কী স্বার্থ হাছিল করবে সেই শঙ্কা থেকেই যায়। তাই শুধু এত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় বা খাওয়া-পরা দেওয়া নিয়ে নয়। সমস্যা অন্যখানে।

ফিলিস্তিনি শরণার্থীরা আজও তাদের রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়নি। আজও তাদের কয়েক জেনারেশন দেশে দেশে উদ্বাস্তু। ইসরায়েলের কারণে তারা নিজ ভূমিতে ফিরতে পারেনি। আবার ইসরায়েলের অব্যাহত নিপীড়নের কারণেই সশস্ত্র গ্রুপের জন্ম হয়েছিল ফিলিস্তিনিদের ভিতর। হামাস আজও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের মাঝেও একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের জন্ম হয়েছে। বলা হচ্ছে, বাইরে থেকে এদের জন্য অস্ত্র-অর্থ আসছে। তারওপর বিশ্বরাজনীতি আর কূটনীতির নানা কূটচাল তো আছেই। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আসছে এ সংক্রান্ত কিছু ভয়ানক তথ্য। সুদূর রুশ গণমাধ্যমের একটি বিশ্লেষণ খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়। রাশান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ বলছে, রোহিঙ্গা সমস্যার পেছনে রয়েছে বাইরের হস্তক্ষেপ। এর পরিচালক দিমিত্রি মসিয়াকভ জানিয়েছেন, দৃশ্যত তাতে দেশটির বাইরের বৈশ্বিক অনুঘটকদের ইন্ধন ছিল।

এমন সংকটেও প্রধানমন্ত্রী একদিকে নারী-শিশুসহ জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। আরেকদিকে তেমনই আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মহলের মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান খুঁজছেন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বৈশ্বিক সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতারেস বাংলাদেশের অবস্থানের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশ সফরে এসে মানবিকতা প্রদর্শনের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তুরস্কের ফার্স্টলেডি এমিনে এরদোগানও।  এসবের যোগফলে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। রাজনীতির মাঠে নানা দল, মত, বিরোধ থাকলেও শেখ হাসিনার কূটনীতি ও মানবিকতার এ ভারসাম্যের জয়ের অপেক্ষায় গোটা বাংলাদেশ।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সর্বশেষ খবর