বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

যার যা আছে তা নিয়েই রোহিঙ্গা ভাই-বোনদের সাহায্য করি

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

যার যা আছে তা নিয়েই রোহিঙ্গা ভাই-বোনদের সাহায্য করি

ওষুধ নিয়ে বাসায় ফিরে মুখ-হাত ধুয়ে খবরের কাগজ পড়তে বসি। কাগজের প্রধান শিরোনামে রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যা ও  নির্মম নির‌্যাতনের বীভৎসতা ফুটে উঠেছে ফিনকি ছড়িয়ে পড়া রক্তের মতো। এ খবর, এ রক্ত আমাকে স্পর্শ করল না। কাঁদাল না। একটুও ভাবাল না। অথচ এরা আমারই ভাই, বোন, বাবা কিংবা মা। কত পাষণ্ড আমি! কত নিষ্ঠুর! আমি কাগজ ভাঁজ করে রাখি। দ্রুত ঘুমাতে হবে। আজকের মতো আগামীকালও চলবে অফিস, সন্তানদের সঙ্গে খুনসুটি আর অর্ধাঙ্গীর আদেশ-নিষেধ, মান-অভিমানের পর্ব। হঠাৎ একটি দৃশ্য আমার চোখ বস্ফািরিত করে দেয়। আমার স্ত্রী মরে পড়ে আছে। আমাদের দুধের শিশুটি মায়ের বুকের ওপর গড়াগড়ি দিচ্ছে। ক্ষুধা আর পিপাসায় অসুস্থ শিশুটি মায়ের দুধ খাচ্ছে। আশ্চর্য! এক ফোঁটা দুধও পেল না আমার আদরের সোনামণিটি। আমি হাউমাউ করে কাঁদতে যাব এমন সময়  পেছন থেকে আমার গলা জড়িয়ে ধরল ছোট্ট মেয়েটি। সামনে আমার স্ত্রী বসা। বলল, তুমি এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ? এতবার ডাকছি, তুমি কি শুনতে পাওনি?

স্ত্রীর কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম। আসলে আমি একটি ফটো দেখছিলাম। কাগজের শেষ পৃষ্ঠায় ছেপেছে ফটোটি। এক রোহিঙ্গা শিশু তার মায়ের নিথর দেহের ওপর শুয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ব্লাউজ টেনে ধরে মায়ের দুধ খাওয়ার চেষ্টা করছে। শিশুটি জানে না, মমতাময়ী মা আর এ পৃথিবীতে নেই। দুই হাতে বুকে জড়িয়ে আদরের চুমো খাওয়া সেই মা এখন নিথর পড়ে আছে কেন— এ প্রশ্নের জবাব শিশুটিকে কে দেবে? আচ্ছা শিশুটি কি তার মায়ের সঙ্গে অভিমান করেছে— মা একটু আগেও তো তুমি আমায় দুধ খাইয়েছিলে। এখন কেন আমার দিকে ফিরে তাকাও না। মা! আমার অনেক ক্ষিধে পেয়েছে, ও মা ...।

আমি আমার দুধের বাচ্চাটির দিকে তাকালাম। ছবির বাচ্চাটি তো আমার সোনামণির মতোই। হায়! আজ যদি আমার সন্তানের এমন হতো? হে আল্লাহ! আপনি মজলুমের সাহায্য করুন। আমরা যারা দেখেও না দেখার মতো আছি তাদের বিবেকের জমিনে মমতাবৃক্ষ গজিয়ে দিন। যেন আমরা আমাদের সর্বস্ব নিয়ে ঘরহারা, বাড়িহারা, স্বজনহারা এসব রোহিঙ্গা মুসলমানের পাশে দাঁড়াতে পারি। যেমন দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের পূর্ববর্তী আনসাররা, সালফে সালেহিনরা।

রোহিঙ্গাদের সাহায্যের জন্য বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ছুটে আসছেন, আবার অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠনও তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এসব অবশ্যই আশার কথা এবং প্রশংসনীয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গারা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলায় আশ্রয় নিচ্ছে। তাই আমাদের দায়িত্ব এবং দায়— দুটোই অন্যদের চেয়ে হাজার গুণ বেশি। ইতিমধ্যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আমাদের দেশে এসেছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলো মানুষে গিজ গিজ করছে। সেখানে পর‌্যাপ্ত খাবার, চিকিৎসা ও পোশাকের অভাব। মানুষ তাদের সাধ্যমতো বিস্কুট, কলা, রুটি নিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ালেও এ যে প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয় তা বলাই বাহুল্য। 

রোহিঙ্গাদের প্রতি পরিকল্পনামাফিক সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। প্রতিটি মসজিদে জুমার খুতবায় রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জোর দিয়ে বলার পাশাপাশি খতিবদের উদ্যোগে একটি ত্রাণ তহবিল গঠন করে খুব দ্রুত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছানো এখন সময়ের দাবি। প্রতিটি মাদ্রাসা থেকে ত্রাণ নিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে পারলে ইসলামের নতুন যুগের সূচনা হবে।

প্রতিটি দরবার থেকে পীর-মাশায়েখদের উদ্যোগে ত্রাণ সংগ্রহ করে ছুটে যেতে হবে এখনই। মনে রাখতে হবে, আমরা যদি এসব করতে ব্যর্থ হই, আমাদের মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ যদি রোহিঙ্গাদের পাশে না দাঁড়াতে পারে তবে কাল কিয়ামতের দিন এ মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে আমাদের জাহান্নামে পাঠিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে। আসুন ভাই! আমাদের যা আছে, তাই নিয়ে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াই।  তবেই মহান আল্লাহর গায়েবি সাহায্য ও তাওফিক আসবে বেশুমার।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর