শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুনিয়া কাঁপানো সেই ঘটনা

আহমদ রফিক

দুনিয়া কাঁপানো সেই ঘটনা

রুশ বিপ্লব অর্থাৎ অক্টোবর বিপ্লব (১৯১৭) প্রত্যক্ষদর্শী মার্কিন সাংবাদিকের ভাষায় ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’। এ বিপ্লব শুধু রাশিয়ায় সমাজবিপ্লব ঘটিয়ে, সমাজতান্ত্রিক নতুন সমাজ গড়ার চেষ্টাতেই শেষ হয়নি। মার্কস-অ্যাঙ্গেলসের অর্থনৈতিক-সমাজবাদী তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ও প্রকাশ ঘটান লেনিন ও সহকর্মীরা। এর প্রভাব ঢেউ তোলে গোটা বিশ্বে, বিশেষ করে ইউরোপীয় সমাজে। বাদ যায়নি এশিয়ার অনুন্নত দেশ চীন, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশ।

বলা হয়, রুশ বিপ্লবের পেছনে দূর তাত্ত্বিক প্রেরণা ছিল  ফরাসি বিপ্লবের সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ঘোষণা, এর আবেগ ও শিক্ষা। ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ দেশে দেশে শিক্ষিত শ্রেণির মননশীল অংশে গভীর প্রভাব রেখেছিল। সেই ধারাবাহিকতায় একই শ্রেণিতে মার্কস-অ্যাঙ্গেলসের সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদী সমাজ গঠনের তত্ত্বও গভীর প্রভাব ফেলে।

দেশে দেশে এই আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে নানা নামে রাজনৈতিক সংগঠন। লক্ষ্য যদিও এক। সে লক্ষ্য প্রচলিত সমাজব্যবস্থা পাল্টে বৈষম্যহীন, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য শাসনক্ষমতা দখল। কারণ শাসনক্ষমতা হাতে না থাকলে উল্লিখিত সমাজ বদলের কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। আর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতেও দরকার পড়ে যথেষ্ট শক্তিশালী সংগঠন ও সংগ্রামের। এ ক্ষেত্রে সেই সংগ্রাম শ্রেণিসংগ্রাম। এর মূল শক্তি আদর্শনিষ্ঠ শ্রমিক শ্রেণি।

শুরুটা রাজনীতিসচেতন শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের হাত ধরে হলেও সাফল্যের জন্য দরকার হয় শ্রমজীবী শ্রেণির (শ্রমিক-কৃষকের) রাজনৈতিক সংহতি ও সংগ্রামী তত্পরতা। কৃষকবিপ্লব, শ্রমিকবিপ্লবের সাংগঠনিক তত্পরতা, নিষ্ঠা, সংগ্রামী সততা শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কঠিন কাজ সহজ করে তুলতে পারে।

তবে এ কথাও ঠিক, বিপ্লব ঘটানোর চেয়ে বিপ্লবের সুফল ধরে রাখা, সমাজের চাহিদা পূরণে ধাপের পর ধাপ পার হওয়া এবং লক্ষ্যে পৌঁছানো অনেক বেশি কঠিন। পদে পদে ভুল-ভ্রান্তি-বিচ্যুতির সম্ভাবনা থাকে। থাকে সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী শক্তির বিরোধিতা, তাদের অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব। এতসব বাধা অতিক্রম করে তবেই সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন এবং শেষ লক্ষ্য সাম্যবাদী ব্যবস্থায় পৌঁছানো।

দুই. অক্টোবর বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের প্রতিটি মানুষের বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন মেহনতি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ। অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি এবং মেধা বিকাশের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা। ভাষা-সংস্কৃতির সম্প্রদায়নির্বিশেষ চর্চার অধিকার এবং জাতিসত্তার নিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করা।

শুধু উৎপাদনের অধিকারই নয়, রাষ্ট্র পরিচালনায়ও থাকবে শ্রমিক-শ্রমজীবী শ্রেণির মুক্ত অধিকার। শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় প্রতিষ্ঠিত হবে শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব। সেই সঙ্গে থাকবে শিক্ষিত আদর্শবাদী ত্যাগী মানুষের অংশীদারিত্ব। এর মধ্যেই জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বিকশিত হতে থাকবে শ্রেণিনির্বিশেষে। থাকবে সবার জন্য সব সুবিধার দরজা খুলে দেওয়া।

ভোগবাদ নয়, সম্পদের ব্যক্তিগত একচেটিয়া অধিকার নয়, শ্রেণিভিত্তিক শাসন-শোষণ-নিপীড়ন নয়; বরং বিশেষ লক্ষ্য হবে সম্পদ-সম্পত্তির সামাজিক মালিকানা নিশ্চিত করা। উৎপাদনে প্রত্যেক নাগরিক তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে রাষ্ট্রকে সাহায্য করবে যাতে এক পর্যায়ে প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন সর্বাংশে মেটানো সম্ভব হয়। শুধু জাগতিক প্রয়োজন মেটানো নয়, বিনোদন ও সংস্কৃতিচর্চায় জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য ছিল মুক্ত চেতনার জনসংস্কৃতি গড়ে তোলা। সংস্কৃতিতে শুধু শ্রেণিবিশেষের বা উচ্চ ও মধ্যশ্রেণির অধিকার শেষ কথা নয়। অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে শুদ্ধ মানবিক বিশ্ব, মানবকল্যাণ বিশ্বের জন্য কাজে লাগানো বৃহত্তর পরিসরে রুশ বিপ্লবের আদর্শিক লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।

কবির ভাষ্যে বলা যায়, অতি সংক্ষেপে এক কথায় বলা যায়, রুশ বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ধনগরিমার ইতরতার সম্পূর্ণ অবসান ঘটানো, সংস্কৃতির মুক্ত নান্দনিক চর্চা, মানুষে মানুষে সুন্দর সহজ নির্মল সম্পর্ক সৃষ্টি। তাই বিপ্লবী শাসনে কৃষক-শ্রমিক তাদের উৎপাদনে আনন্দের সঙ্গে অংশ নিয়ে শুধু তার মৌলিক চাহিদাই মেটাচ্ছে না, সে তার মাথা থেকে ‘অসম্মানের সব বোঝা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে’ মুক্ত মানুষ, আলোকিত চিত্তের মানুষ হয়ে উঠছে।

উৎপাদনের চরিত্র হয়ে ওঠে সর্বজনীন, সমবায়ভিত্তিক রীতিনীতিতে। কারখানায় যেমন রয়েছে শ্রমিকের অধিকার, তেমন জমিতে অধিকার, কৃষক চাষির, বিশ্ব তা যৌথ মালিকানায় যৌথ খামারে শস্য তোলায়। তবে এ কথাও ঠিক, সম্পদের পুনর্বণ্টনের মতো কাজ সহজ তো নয়ই, অতীব কঠিন। কারণ দীর্ঘ সময়ের সামাজিক প্রভাব যেমন ব্যক্তিগত অধিকার নিশ্চিত করেছে তেমন মানুষের সহজাত ্বোধ বলে— এটা আমার, ওটা তোমার। এ বোধের শিকড়বাকড় উপড়ে ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়। এখানেই আদর্শনির্ভর সমাজ নির্মাণের বড় বাধা এবং প্রয়োজনীয়তা।

তিন. আজ থেকে শতবর্ষ আগে লেনিন ও তার সহযোগীরা শেষণতাড়িত, পচাগলা, রুশী সমাজের উচ্ছেদ ঘটাতে বিপ্লবের যে শিখা জ্বালেন তার মূল বিষয় ছিল শ্রেণিসংগ্রাম। শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ সেনা সদস্যের সমবায়ে এবং বুদ্ধিদীপ্ত কিছুসংখ্যক শিক্ষিত মানুষকে নিয়ে সেই শ্রেণিসংগ্রাম বিপুল ক্ষমতার অধিকারী জার সম্রাট ও তার কূটকৌশলী শক্তিমান আমলাতন্ত্রকে সমূলে উপড়ে ফেলে। গঠিত হয় বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমাজবদলের উদ্দেশ্য নিয়ে।

পতন ঘটে ৮০০ বছরের পুরনো জার শাসনের। কবির ভাষায়, ‘জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক।’ ভেসেই গেল জারতন্ত্র। পুরনো রাজ্য কাঠামো ভেঙে নতুন এক রাষ্ট্র কাঠামো আশার আলো জ্বলে গোটা বিশ্বে। বাঙালি কবির কণ্ঠে আনন্দ ঘোষণা, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর! ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়!’

বিশ্বমনীষীদের অনেকে নিপীড়িত মানবতার মুক্তির কারণে ওই একই সময়ে নজরুলের মতো করেই অভিনন্দন জানালেন রুশ বিপ্লবকে। নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি গঠনের প্রয়াসকে। যেমন ফরাসি সাহিত্যিক আনাতোল ফ্রাঁস, রমা রঁলা। রঁলা এ বিপ্লবকে চিহ্নিত করলেন ফরাসি বিপ্লবের চেয়ে মহত্তর ঘটনা হিসেবে। আর ইংরেজ ধীমান এইচ জি ওয়েল্স, জর্জ বার্নার্ড শ, বার্ট্রান্ড রাসেল প্রমুখ তাদের বক্তব্যে রুশ বিপ্লবের প্রতি মুগ্ধতা ছড়ালেন। দীর্ঘ সময় পর একই ঘটনায় অভিভূত রবীন্দ্রনাথ। রাশিয়া সফর তার কাছে মনে হয়েছে তীর্থভ্রমণ, তীর্থদর্শন।

কিন্তু চুপ করে থাকেনি সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব। ইঙ্গ-মার্কিনসহ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো নতুন সমাজতান্ত্রিক রাজ্যটিকে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লাগে। অভিজাত শ্রেণি, উচ্চবিত্ত ও সামরিক বিশিষ্টজনের সাহায্যে শুরু করা হয় প্রতিবিপ্লব। নতুন ব্যবস্থার পতন ঘটাতে শুরু করে জারভক্ত সেনাদের নিয়ে যুদ্ধ। দীর্ঘস্থায়ী এ যুদ্ধের পরিণাম কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা, অনাহার-অর্ধাহার। এরা একা কষ্ট করেনি। রুশ বিপ্লবের মূল কারিগর লেনিন ব্যক্তিগতভাবে সেই দুঃখ-কষ্টের অংশীদার হয়েছেন তার আহারে, পোশাকে। দিনে ২০ ঘণ্টা শ্রমে নিজেকে অসুস্থ করে তুলেছেন। লক্ষ্য একটাই— বিপ্লবকে বাঁচানো। নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে রক্ষা করা সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের হাত থেকে। রুশী অভিজাতদের লোভ-লালসা ও বিলাসিতার হাত থেকে।

শেষ পর্যন্ত জয় বিপ্লবের। জয় লেনিনের হাতে গড়া বলশেভিক পার্টির। এই পার্টি সদস্যদের নিষ্ঠা, শ্রম, আত্মদান বিজয় নিশ্চিত করে। করে শ্রমিক শ্রেণির সদস্যদের সর্বমাত্রিক শ্রমে ও আত্মদানে। তাদের সঙ্গী সমাজতন্ত্রপ্রেমী সৈনিক, কৃষক ও সাধারণ মেহনতি মানুষ। লেনিনের অকালমৃত্যুতে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের কাজে হাল ধরলেন স্টালিন। তার সম্পর্কে নানা সমালোচনা সত্ত্বেও দু-চার জন বিদেশি সাংবাদিক লিখেছেন : স্টালিন নব্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার প্রধান স্থপতি। বলাবাহুল্য লেনিনোত্তর যুগে।

মার্কিন সাংবাদিক আমালুইস স্ট্রং লিখেছেন : স্টালিন যুগ শুধু পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বাড়েনি, যে শক্তি হিটলারের গতি রোধ করে ছিল শুধু সেই শক্তিই গড়ে তোলেনি, মানবজাতির এক-তৃতীয়াংশ আজ যেসব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে বাস করছে, তাদের জন্য অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তুলেছে এ যুগ। ... এ যুগের দোষ-ত্রুটির কারণ ছিল অনেক।’ যেসব কারণ পরে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। এসব দীর্ঘ আলোচনার বিষয়।

চার. রুশ বিপ্লবের শতবর্ষে আজ বিশ্বের দেশে দেশে মানুষ সেই মহান বিপ্লবের মর্মবাণী ও তার মানবিক অর্জনের দিকগুলো স্মরণ করছে। বাংলাদেশও এদিক থেকে পিছিয়ে নেই। বিপ্লবের শতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে গঠিত হয়েছে জাতীয় কমিটি। লক্ষ্য ‘অক্টোবর বিপ্লবের তাত্পর্য এবং বর্তমান আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিস্থিতিতে তার প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরা’। ‘সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশের রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় কমিটির গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে : উদ্বোধনী সমাবেশ (১ অক্টোবর, ২০১৭), ৭ নভেম্বর সমাপনী সমাবেশ ও লাল পতাকা মিছিল। এ ছাড়া রয়েছে ‘শ্রমিক-কৃষক, নারী, ছাত্র, শিশু-কিশোর, পোশাজীবী সংস্কৃতি-চলচ্চিত্রকর্মী ও লেখকদের উদ্যোগে মাসব্যাপী আলোচনা সভা, প্রদর্শনী, গান, নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এসবের লক্ষ্য দেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে রুশ বিপ্লবের আদর্শিক মর্মবাণী আবার জেগে উঠুক। তাদের উদ্বুদ্ধ করুক, উদ্দীপ্ত করুক নতুন করে এ দেশে সমাজবদলের ও সর্বপ্রকার শোষণ অবসানের ঝাণ্ডাটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে হাত লাগাতে। সবার মনে একটিই কথা : বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।

লেখক : ভাষাসংগ্রামী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর