মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নবাব সিরাজউদ্দৌলা

নবাব আলী আব্বাসউদ্দৌলা

নবাব সিরাজউদ্দৌলা

১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ২৯০তম জন্মদিন। বীর দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব। বিশ্বাসঘাতকতায় পলাশীর যুদ্ধে তার পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রায় ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। সিরাজউদ্দৌলা তার নানা নবাব আলিবর্দী খানের  উত্তরাধিকার হিসেবে সাড়ে ২৮ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালে বাংলার নবাবের আসনে বসেন। প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের বিশ্বাস ঘাতকতায় ২৩ জুন, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে লর্ড রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাহিনীর কাছে পরাজিত হন। ক্লাইভের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসন ভার গ্রহণ করে।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম ১৭২৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। তিনি ছিলেন বাংলার নবাব আলিবর্দী খানের নাতি। আলিবর্দী খানের কোনো পুত্র ছিল না। তার ছিল তিন কন্যা। তিন কন্যাকেই তিনি নিজের বড় ভাই হাজি আহমদের তিন পুত্র নওয়াজিশ মুহাম্মদের সঙ্গে বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের, সাইয়েদ আহম্মদের সঙ্গে মেজ মেয়ে এবং জায়েন উদ্দিন আহমদের সঙ্গে ছোট মেয়ে আমিনা বেগমের বিয়ে দেন।

 

আমিনা বেগমের তিন পুত্র ও দুই কন্যা। পুত্ররা হলেন মির্জা মোহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা, ইকরামউদ্দৌলা ও মির্জা মেহেদী। আলিবর্দী খান যখন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, তখন তার তৃতীয় কন্যা আমিনা বেগমের গর্ভে মির্জা মোহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয়। এ কারণে তিনি সিরাজের জন্মকে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে আনন্দের আতিশয্যে নবজাতককে পোষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। সিরাজ তার নানার কাছে ছিল খুবই আদরের, যেহেতু তার কোনো পুত্র ছিল না। তিনি মাতামহের স্নেহ-ভালোবাসায় বড় হতে থাকেন। আলিবর্দী খান মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গেলে সিরাজ তার সঙ্গী হন।

আলিবর্দী যুবরাজ সিরাজউদ্দৌলাকে তরুণ বয়সেই পাটনার গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেন। তার বয়স অল্প ছিল বলে রাজা জানকীরামকে রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়। আলিবর্দী খান দরবারে স্নেহভাজন দৌহিত্রকে পাশে বসিয়ে ঘোষণা দেন, আমার পরে সিরাজউদ্দৌলাই বাংলা বিহার উড়িষ্যার মসনদে আরোহণ করবে। ইতিহাসে এই ঘটনাকে সিরাজউদ্দৌলার যুবরাজ হিসেবে অভিষেক বলে অবিহিত করা হয়েছে। এ সময়ে সিরাজউদ্দৌলা বয়সে তরুণ ছিলেন।

সিরাজকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করার ঘটনা তার আত্মীয়বর্গের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। অনেকেই তার বিরোধিতা শুরু করেন। সিরাজউদ্দৌলা মসনদে বসেই প্রশাসনে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন। মীরজাফরকে সেনাবাহিনীর প্রধান বখশির পদ থেকে সরিয়ে মীর মর্দ্দানকে সেখানে নিয়োগ দেন। এছাড়া মোহন লালকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করা হয়।

এরপর সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের কলকাতায় অবস্থিত কাশিমবাজার কুঠির ব্যাপারে মনযোগী হন। কারণ সিরাজউদ্দৌলা তাদের এদেশে কেবল বণিক ছাড়া আর কিছু ভাবেননি। এ কারণে ১৭৫৬ সালের ২৯ মে কাশিম বাজার কুঠি অবরোধ করা হয়। ফলে ইংরেজরা নবাবের হাতে যুদ্ধাস্ত্র তুলে দিয়ে মিথ্যা মুচলিকার মাধ্যমে এ যাত্রায় মুক্তি পায়। কলকাতার নাম বদল করে নবাব আলীবর্দী খানের নামানুসারে ‘আলী নগর’ রাখা হয়।

এ ঘটনার পর ইংরেজরা আরও নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। তারা জগৎশেঠের মাধ্যমে মীর জাফরকে মসনদে বসানোর চূড়ান্ত পরিকল্পনা করে ফেলে।   পরিকল্পনায় আরও যোগ দেন রাজা রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ, রাজবল­ভ, ঘসেটি বেগম, মীরন, মীর কাশিম, ইয়ার লতিফ খান প্রমুখ। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ১৭৫৭ সালের ৫ জুন মীর জাফরের একটি গোপন চুক্তি সম্পাদিত হয়, যার ফসল ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ।

চুক্তি সম্পাদনের পরই রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর প্রান্তরে সৈন্য সমাবেশ ঘটান। সিরাজউদ্দৌলাও তার সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। সিরাজউদ্দৌলা কিছু বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে রাজধানীতে ফিরে যান, নতুন সৈন্য সংগ্রহ করে বাংলাকে উদ্ধারের জন্য। কিন্তু বিধিবাম। ২৯ জুন বীর দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে প্রিয়তমা স্ত্রী বেগম লুৎফুন্নিসা ও একমাত্র কন্যা সন্তান উম্মে জোহরাসহ আটক করে বাংলার বেইমান বিশ্বাসঘাতকরা। এর পর ২ জুলাই মীর জাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে মুহাম্মদি বেগ সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে। উল্লে­খ্য, অনাথ মুহাম্মদি বেগ আলিবর্দী খানের স্ত্রী শরফুন্নিসার ঘরে লালিত পালিত হয়েছিলেন এবং প্রচুর ধনসম্পদ দান করে তিনি তাকে বিত্তশালী করেছিলেন।

আর এভাবেই বীর দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যও অস্তমিত হয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সততা, দেশপ্রেম, আদর্শ, চেতনা, ভালোবাসা আজও বাংলার দেশপ্রেমী প্রতিটি হৃদয়কে অনুপ্রাণিত করে। তাই তো বাংলার প্রতিটি দেশপ্রেমী মানুষের স্বপ্নের নায়ক... ‘সিরাজউদ্দৌলা’।

লেখক : নবাব সিরাজউদ্দৌলার নবম বংশধর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর