বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

জানোয়ার ইয়াহিয়া-টিক্কা, নিষ্ঠুর হিলাইংয়ের পাশে পরাজিত সু চি

পীর হাবিবুর রহমান

জানোয়ার ইয়াহিয়া-টিক্কা, নিষ্ঠুর হিলাইংয়ের পাশে পরাজিত সু চি

ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে জগিবখ্যাত মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক, সমরনায়ক, দার্শনিকরা আসেন। মানব সভ্যতার ইতিহাস তাদের অমরত্ব দেয়। আপন মহিমায় তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং আদর্শ হিসেবে মানব হৃদয়ে বাস করেন। প্রজন্ম তাদের অনুসরণ করে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই তিনি থাকুন না কেন, দুনিয়ার আরেক প্রান্তে তার উত্তরসূরিরা তাকে জীবনের আদর্শ বলে গ্রহণ করেন।  ঠিক তেমনি ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন গতিপথে কিছু কিছু মানবতাবিরোধী, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, খুনি, ঘাতক বা কসাইয়ের আবির্ভাব ঘটে যুগে যুগে। মানব সভ্যতার ইতিহাস ঘৃণা, লজ্জা, অপমানের সঙ্গে তাদের মহানায়কদের উল্টোপিঠে সভ্যতাবিরোধী, মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধী হিসেবে খলনায়কের তালিকায় বন্দী করে রাখে।

কীর্তিমান, জগৎ আলো করা মহামানবদের যেমন অবনত মস্তকে স্মরণ করে, সেখানে গভীর ভক্তি আর প্রেম নিঃশর্তভাবে হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়। তেমনি এসব মানব সভ্যতাবিরোধী, মানুষ হত্যার অভিযোগে, শিশু হত্যার অভিযোগে, নারী ধর্ষণের অভিযোগে, জ্বালাও-পোড়াও, উত্খাতের পোড়ামাটি নীতি গ্রহণকারী নিষ্ঠুর শাসক থেকে সমর নায়কদের কুৎসিত, বীভৎস ছবিতে থুতু দেয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। তাদের করুণ মৃত্যুর শত শত বছর পার হলেও মানব জাতির ইতিহাস থেকে ঘেন্না ও ক্ষমাহীন সমালোচনা, তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ কখনো মুক্তি দেয়নি। মানবতাবাদী নেতারা যেমন, মানুষেরা যেমন, মনীষীরা যেমন মানুষের মাথার তাজ হয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, কাল থেকে কাল অমরত্ব নিয়ে বেঁচে থাকেন, তেমনি মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী, নিষ্ঠুর ঘাতকেরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, কাল থেকে কাল, মানব সভ্যতার ইতিহাসে ডেভিল বা শয়তানের প্রতিচ্ছবি হয়ে নিন্দিত হতে থাকে। এদের কবরে কুকুরও যায় না। কিন্তু মানবতাবাদীদের কবরে মানুষই নয়, পশুপাখিরাও অশ্রু বিসর্জন করে। ইতিহাসের শিক্ষা দুই ধারায় ধাবিত। এক ধারায় মানব কল্যাণ, মানুষের মুক্তি, মানুষের অধিকার, মানুষের শান্তি ও স্বাধীন আবাসভূমিতে জীবনধারণের নিশ্চয়তা বিধান করেন বা মানব কল্যাণের জন্য জীবন যৌবন উৎসর্গ করেন ভোগ-বিলাসিতাহীন কঠিন আত্মত্যাগের মহিমায়— এরাই হলেন মহাকাব্যের নায়ক।

মানব সভ্যতার ইতিহাসকে মোটা দাগে চোখের সামনে চিত্রায়িত করলে দেখা যায়, হূদয়হীন, নিষ্ঠুর শাসকেরা দখলদারিত্বের মনোভাব নিয়ে যুগে যুগে যতবার কখনো যুদ্ধ, কখনো বা বিনাযুদ্ধে, নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছেন তাদের করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। জীবনও গেছে, ইতিহাসও তাদের ক্ষমা করেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্ববাসীর সামনে মানব সভ্যতার অভিশাপ হিসেবে জার্মান একনায়ক এডলফ হিটলারকে একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী, খুনি শাসক হিসেবে চিহ্নিতই করেনি, প্রজন্মের পর প্রজন্ম চরম ঘৃণা ও নিন্দার সঙ্গে নাকের নিচে শোভিত এক টুকরো গোঁফের দিকে থুতু ছুড়ে। তার সহযাত্রীদের এখনো সভ্য দুনিয়া ক্ষমা করে না, ইতিহাস ক্ষমা করা দূরে থাক। ইতালির মুসোলিনিকেও ইতিহাসের যাত্রাপথে একই পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।

আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানকে গণহত্যার খলনায়কই নয়, দানবের চেহারায় চিত্রিত করেছে। এদেশের মানুষের কাছে পটুয়া কামরুল হাসানের পোস্টারে এখনো ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নয়, সেনাশাসক নয়, সমর নায়ক নয়; লম্পট, মাতাল, জানোয়ার হিসেবে চিহ্নিত। এ জানোয়ারকে ইতিহাস ক্ষমা করেনি। ঘৃণা, ক্ষোভ, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে স্মরণ রেখেছে। তার পরিণতিও সুখকর হয়নি জীবনে। করুণ মৃত্যুর পর ইতিহাস তাকে নিয়ত হাতুড়িপেটা করে যাচ্ছে। তার কোনো ক্ষমা নেই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে তার প্রভু ইয়াহিয়া খান ও তাদের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের খলনায়ক জুলফিকার আলী ভুট্টোর নীলনকশায় যে গণহত্যা চালিয়েছিল, যেভাবে নারীদের ধর্ষণ করেছে, স্বাধীনতার প্রসব বেদনায় কাতর বাংলাদেশে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়েছে, অসহায় শিশু, নিরস্ত্র বৃদ্ধদের সঙ্গে মানুষ হত্যার চরম বর্বরতা দেখিয়েছে। তাদের শুধু পরাজিতই হতে হয়নি, একটি অসভ্য রাষ্ট্রের খুনি ও কসাই হিসেবে ইতিহাস তাদের নিন্দার খাতায় তুলে রেখেছে। জীবনে বরমাল্য জুটেনি তাদের, মরণে জুটেছে চরম ঘৃণা আর ঘৃণা। এতক্ষণ এত কথা লেখার যাত্রাপথ পাঠকেরা হৃদয় উপলব্ধি করেছেন আজকের মিয়ানমার গোটা বিশ্বের কাছে দীর্ঘ সামরিক শাসনকবলিত মানুষের অধিকার হরণকারী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত। যুগের পর যুগ এ সামরিক শাসকরা ধারাবাহিকভাবে মানুষের সব গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে নিজেরা ভোগ-বিলাস ও ক্ষমতার দম্ভে নিজেদের এক সুখের স্বর্গ রচনা করেছে। গণতান্ত্রিক সভ্য দুনিয়া থেকে মিয়ানমারের চেহারা আলাদা। শান্তিতে নোবেলজয়ী বার্মার গণআন্দোলনের মহান নেত্রী অং সান সু চিকে তারা দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ, অবরুদ্ধ করে রেখেছে। বার বার গণতন্ত্রের আকুতি নিয়ে জেগে ওঠা সু চির অনুসারীদের বুলেটের জোরে দমন করেছে, গণরায় বাতিল করেছে।

অক্সফোর্ড পড়ুয়া সু চি যখন লুঙ্গির ওপরে বার্মিজ থামি পরে বাইসাইকেল চালিয়ে যেতেন, শত তরুণের রোমান্টিক হৃদয় তখন শিহরিত হয়েছে। সেই অনিন্দ্য সুন্দরী সু চির খোঁপায় শোভিত ফুল ছেড়ে দিতে হয়েছিল এ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে। ভালোবেসে বিয়ে করা বিদেশি স্বামীকে মৃত্যুর সময়ও দেখতে পারেননি। এ মিয়ানমারের খুনি, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন শাসকদের পৃথিবীর মানুষের চেয়ে সবচেয়ে বেশি জানেন, বোঝেন নোবেল বিজয়ী সু চি। বিদেশি বিয়ে করার কারণে জনরায় তার সঙ্গে থাকার পরও এই সু চিকে নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত সেনাশাসকরা তার হাতে ক্ষমতা দিতে চায়নি বলে সংবিধান পরিবর্তন করেছে। মার্শাল ল নিয়ন্ত্রিত, মানুষের অধিকারহীন রাষ্ট্র মিয়ানমারের ভোটে সু চির দল বিজয়ী হলেও তাকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি, উপদেষ্টা নামের পুতুল করে বসিয়েছে।

রাজনীতিবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে রাজনীতির দৃশ্যপট পর্যবেক্ষণের সুবাদে যতটুকু বুঝতে পারি আজকের রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রশ্নবিদ্ধ, সমালোচিত মিয়ানমারের সামরিক জান্তার হাতের পুতুল হিসেবে নোবেল বিজয়ী সু চি যতই সমালোচিত হন না কেন, গণতন্ত্রের নেত্রী হিসেবে, মানবতাবাদী হিসেবে তার হৃদয়েও রক্তক্ষরণ ঘটছে। যিনি জীবনের পুরো যৌবন বার্মার গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের অধিকারের জন্য উৎসর্গ করেছেন, এত নির্যাতন, অপমান সহ্য করেছেন; আজকের গণহত্যা তার সইবার কথা নয়। ক্ষমতার জন্য আপসকামিতা আর কৌশলই হোক সু চি যেন অসহায়। গণহত্যার বিষয়টি এড়িয়ে কূটনৈতিক কৌশলে দেওয়া বক্তব্যে সু চি বলেছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার হবে। বাংলাদেশে যারা এসেছে তাদের পরিচিতি দেখে ফিরিয়ে নেওয়া হবে, সব ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। কুখ্যাত সেনাপ্রধানের মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা বক্তব্যের দুই দিন পর দেওয়া ভাষণে সু চি তার অতীত গৌরবকে ধূলোয় না মিশিয়ে সামরিক জান্তার সঙ্গে আপস করে চললেও ভাষণে বিশ্বমানবতার আর্তনাদকে ধারণ লালন করে ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়কে গিয়ে দেখতেও বলেছেন। এখন আমরা দেখতে চাই কতটা গণহত্যার বিচার হয়, শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে তাদের নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত করা হয়। আমরা চাই সু চি বিশ্ব মানবতার কাছে শান্তির কন্যা হয়েই অর্জিত মর্যাদা নিয়ে বাঁচুন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান মিন অং হিলাইং বিশ্বজুড়ে আরাকান রোহিঙ্গাদের গণহত্যা ঘিরে তার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্ব মানবতার যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সেটি আমলে নিচ্ছেন না। জাতিগত দাঙ্গা বলে অতীতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অত্যাচার, নির্যাতন চালিয়েছে, ভিটেমাটি ছাড়া করেছে। এবার সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে তাদের বিরুদ্ধে বর্বর গণহত্যাই চালানো হয়নি, নির্বিচারে নারী ধর্ষণ হচ্ছে। ভিটেমাটি থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। স্বজনের সারি সারি বীভৎস, রক্তাক্ত লাশ ফেলে রেখে প্রাণভয়ে সবাই দেশছাড়া হয়েছে। অজানার পথে নৌকায় চড়ে জলে ভেসেছে। নৌকাডুবিতে অনেকের সলিল সমাধি হয়েছে।

নাফ নদের এপারে আমাদের টেকনাফ, ওপারে মিয়ানমার। নাফের জলে সিরিয়ার আয়লানের মতো যে শিশুর লাশ ভেসে উঠেছে, বিশ্বের মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষদের হৃদয় স্পর্শ করেছে। শিশুর পিঠে শিশুর অজানা পথ হাঁটার চিত্র আমাদের অশ্রুসজল করেছে। নিথর শিশুর কপালে শেষ চুম্বন দেওয়া ক্রন্দনরত মায়ের ছবিখানি মানবিক হৃদয়কে দেশে দেশে জাগিয়েছে। একাত্তর আমাদের শিখিয়েছে যুদ্ধ করে জিততে হয়। যুদ্ধ করে স্বাধীন হতে হয়। যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়। একাত্তর আমাদের আরও শিখিয়েছে, আমাদের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে গোটা জাতি যখন আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে স্বাধীনতার মন্ত্রমুগ্ধে এক মোহনায় মিলিত, ঠিক তখন রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত জাতির ওপর ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে যে গণহত্যা ও অগ্নিসংযোগ শুরু করেছিল; সেই সময় মহান শেখ মুজিবের দূরদর্শী চিন্তার রোডম্যাপে ভারতের গণতন্ত্রের মহান নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় ও খাবার দিয়েছিলেন। আমরা সেদিন মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম। ভারতের জনগণ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সেনাবাহিনী আমাদের ট্রেনিং দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী অস্ত্র দিয়েছেন, ট্রেনিং দিয়েছেন। আমাদের জন্য শুধু বিশ্বজনমতই গড়েননি, জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করেছেন। বিশ্ব মোড়লরা সেদিন আমাদের হানাদার বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে পরাস্ত করতে পারেনি। বীরত্ব ও মানবিকতা জন্মের সঙ্গে স্বাধীন বাঙালি জাতি অস্তিমজ্জায় আত্মস্থ করেছে। এ পর্যন্ত প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। নাগরিকত্ব দিয়ে নিজের ভূমিতে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মুজিবকন্যার এ সাহস ও নেতৃত্বকে বিশ্বনেতারা সাধুবাদ জানিয়েছেন। আবেগ, অনুভূতি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ এ ইস্যুতে মানবিক হৃদয় নিয়ে তাকে সমর্থন জানিয়েছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম অসহায় রোহিঙ্গা শিশুদের বুকে জড়িয়ে ক্রন্দনরত শেখ হাসিনার ছবি দেখে একজন মানবিক মা বা মানবতার জননী বলে আখ্যায়িত করেছে।

মিয়ানমার কথা শোনে না। বাংলাদেশের সীমানায় তাদের হেলিকপ্টার ও ড্রোন আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। এ ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করেছে, কৈফিয়ৎ চেয়েছে। অত্যাচারী রাষ্ট্রনায়কদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি অস্বীকার করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। চীন, রাশিয়া মিয়ানমারের এ অভিযানকে সমর্থন দিয়ে মানবিক মানুষের কাছে নিষ্ঠুর শাসকের চরিত্র উন্মোচিত করেছে।

ক্ষমতাধর চীন, ভারত, রাশিয়া মিয়ানমার সরকারের পাশেই দাঁড়িয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে অবস্থান নিয়েছেন তাতে এ ক্ষমতাধর বন্ধুদের পাশে পাননি। এ গণহত্যা, রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে তিনটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র প্রতিবাদ দূরে থাক শাসকের পাশেই দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ইস্যুতে বিশ্বজনমত গড়ে তুলছেন। জাতিসংঘে তা নিয়ে শক্তিশালী ভাষণ দিচ্ছেন। এবারের মতো দুনিয়ার কাছে অজানা মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অতীতে কখনো পড়েনি। নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মত যেটুকু প্রস্তাবই নিক না কেন, তাতে চীন ভেটো দেয়নি। অতীতে ভেটো দিয়েছে। সার্ক ভঙ্গুর, আসিয়ান অভিন্ন সুরে কথা বলে, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া এ গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এ ইস্যু নিয়ে ভারত, চীন ও রাশিয়া সফর করতে পারেন।

কবির হৃদয় নিয়ে নির্মলেন্দু গুণ রোহিঙ্গাদের জন্য যুদ্ধে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। একাত্তরে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে পরীক্ষিত মহান বন্ধু ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, সহযোগিতা দিয়েছে; হঠকারী ইয়াহিয়া খান ২৬ নভেম্বর সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করার ঘোষণা দিয়ে মদ আর নারীতে ডুবে ছিলেন। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ভারতের সৈনিকরা আমাদের জন্য যুদ্ধ করেছে, রক্ত দিয়েছে। ভারত সেই থেকে আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। বন্ধুর সঙ্গে দেনদরবার হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অপরাধীদের ফাঁসি নিয়ে যে এরদোগান ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন, আর্তনাদ করেছেন, বেহায়ার মতো তিনিও আমাদের টেলিফোন করেছেন। তার পত্নী রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে এসে কান্নাকাটি করেছেন। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ইরানের সামরিক বাহিনীর প্রধানকে টেলিফোন করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীন সফরে গিয়ে মিয়ানমার হয়ে দেশে ফিরেছিলেন। মিয়ানমার শাসকদের এ অভিযানকে সমর্থন দিলেও বাংলাদেশের বন্ধুত্বকে অস্বীকার করার সুযোগ পাননি। বিবেচনায় নিতে হয়েছে, ত্রাণ পাঠিয়েছেন। ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা তার মানবিক হৃদয় নিয়ে কূটনীতির ভাষা রপ্ত রেখে শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

আমাদের পানি দেন আর না দেন, মমতাহীন মমতাও বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানরা আশ্রয় নিলে তিনি ফিরিয়ে দেবেন না। বিজেপি সরকারের সঙ্গে এ ইস্যুতে তিনি নেই। নরেন্দ্র মোদির সামনেও নীতিগত জায়গায় সুর পাল্টানোর প্রশ্ন সামনে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আজকের বিশ্ব রাজনীতিতে বিশ্ববরেণ্য নেতাদের পাশে দাঁড়ানো বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অমিত সাহস নিয়ে মিয়ানমার শাসকদের গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলবেন। এখানে আমরা দেশের মানুষ তার সঙ্গে, বিশ্ববিবেক তার পাশে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস, কানাডাই নয়; মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের রোহিঙ্গা গণহত্যার চিত্র দেখে প্রতিবাদমুখর হয়েছে। মিয়ানমার চায় আরাকানে শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলবে। তাদের মিত্র চীনও বেকায়দায় পড়েছে। সামরিক জান্তারা মিয়ানমারকে যুগের পর যুগ দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলেও এবার রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত গণহত্যা ও বাংলাদেশের ভূমিকার কারণে তাদের আসল চেহারা জেনে গেছে।

কফি আনান কমিশনের রিপোর্টে ঢাকার সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শরণার্থী ফিরিয়ে নিয়ে মিয়ানমারকে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এ কমিশন গঠনের নেপথ্যে সু চির ভূমিকা ছিল। কিন্তু রিপোর্ট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গণহত্যা চালায়। সেনাবাহিনী আর উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা বার বার রোহিঙ্গাদের নিষ্ঠুর আক্রমণ চালিয়ে অহিংস ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের রক্তে রঞ্জিত মিয়ানমার সেনাপ্রধানের মিথ্যাচারের হাত এসেছে বাংলাদেশের দিকে। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশে। এরা খুনি? ও মিথ্যুক। এদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর মানবতাবাদী মানুষের ঐক্য অনিবার্য। পায়ে পড়ে তারা ঝগড়া বাড়াতে চায়। আমরা চাই শান্তি, আমরা চাই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে তাদের আবাসভূমিকে নিরাপত্তা দান। বিশ্ব বিবেক এটা চায়। এ ইস্যুতে গোটা বাংলাদেশ শেখ হাসিনার পাশে, অভিন্ন অবস্থানে। এ নিয়ে আমাদের রাজনীতির বা কাদা ছোড়াছুড়ির কোনো সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না, শান্তি ও কূটনীতির লড়াইয়ে শেখ হাসিনা মিয়ানমার শাসকদের পরাস্ত করতে চান। মিয়ানমার মানুষ হত্যার বিনিময়ে কলকারখানা গড়ে তুলতে আরাকানের মানুষশূন্য মাটি চায়। শেখ হাসিনা চান, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মভিটায় ফিরিয়ে নিক। এখানে আমরা মাথানত করতে দাঁড়াইনি। প্রশ্ন উঠেছে, একাত্তরের পরাজিত সেনাশাসন কবলিত জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই রোহিঙ্গাদের নিয়ে খেলছে। কে কোথায় খেলছে, সেটি দেখার দরকার নেই। মানবতার লড়াইয়ে নিষ্ঠুর ঘাতক আর ষড়যন্ত্রের কালো হাত মানবতার শক্তি জেগে উঠলে সেটি গুঁড়িয়ে যাবে।

মদ্যপ, লম্পট পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান তার দেশের প্রখ্যাত গায়িকা নূরজাহান, চিত্রনায়িকা তারানা, পুলিশ কর্তার স্ত্রী নূর বেগম, মিস দুরানী ও কালো সুন্দরী বা ব্ল্যাক ডায়মন্ড খ্যাত আকলিমা আক্তার থেকে অনেককে নিয়েই তার হেরেম বা রংমহল বানিয়েছিলেন। সেখানে যুদ্ধের করুণ পরিণতি বা পরাজয়ের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে জেনারেল পীরজাদাও তার পিস্তলের মুখোমুখি হয়েছেন।

আজকের মিয়ানমারের সেনাপ্রধান যার নেতৃত্ব ও একচ্ছত্র কর্তৃত্বে গণহত্যা চলছে, যিনি বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের মুখেও আরাকানে সেনা অভিযান অব্যাহত রাখার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন, সেই সামরিক জান্তা মিন অং হিলাইং নিউজ উইকের ভাষ্যমতে মদ আর নারীতে আসক্ত। নিউজ উইক বলেছে, তার ছয়জন ইরানি ও পশতুতু সুন্দরী প্রেমিকা রয়েছেন, যাদের প্রেমে তিনি মগ্ন থাকেন, শরাবে ডুবে থাকেন। তার কাছে আজ প্রশ্ন, ইয়াহিয়া খানের কালো সুন্দরী তার চোখ অন্ধ করেছিল। শরাব তাকে বুঁদ করে রেখেছিল। আর মিন অং হিলাইংয়ের ইরানি সুন্দরী তার চোখ বন্ধ করে রেখেছে। শরাব তাকে ডুবিয়েছে। মানবতার বিরুদ্ধে কোনো শক্তির বিজয় সম্ভব নয়। দস্যু হওয়া যায়, খুনি হওয়া যায়, নিষ্ঠুর যুদ্ধাপরাধী হওয়া যায় কিন্তু প্রেমিক হওয়া যায় না। চোখ অন্ধ থাকলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না। একাত্তরে আমরা যুদ্ধ চেয়েছিলাম, যুদ্ধে জয়ী হয়েছি। ভারত আমাদের আশ্রয় ও সাহায্য দিয়েছে। বিশ্ব মোড়লদের পরাজয়ের গ্লানি নিতে হয়েছে। সু চিকে আজ নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার সময় এসেছে।  পুতুল সরকারের উপদেষ্টা থাকবেন নাকি শান্তিকন্যা হয়ে অমরত্ব নেবেন? মিন অং হিলাইংয়ের সামনে প্রশ্ন, নিষ্ঠুর হিটলার, ইয়াহিয়া, টিক্কাখানের মতো আরাকানের কসাই হবেন; নাকি রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমিতে ফিরিয়ে নেবেন? আমরা যুদ্ধে যাব না; কিন্তু কূটনীতি ও বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লড়াইয়ে জয়ী হব।  আমাদের জন্ম বিজয়ের। এ বিজয় অপ্রতিরোধ্য।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর