বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুর্গোৎসবের সেই দিনগুলো

তপন কুমার ঘোষ

দুর্গোৎসবের সেই দিনগুলো

দুয়ারে কড়া নাড়ছে পূজা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।

ধর্মীয় উৎসবগুলো আমরা খণ্ডিত হয়ে উদযাপন করি।  কিন্তু সামাজিক উৎসবকে কেন্দ্র করে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই একত্রিত হই। দুর্গোৎসবের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পর্ব বাদ দিলে অন্য সব আয়োজনে সব সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি লক্ষণীয়। তাই দুর্গোৎসব একই সঙ্গে ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। পূজা এলেই শৈশব-কৈশোরের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। নড়াইলের সেই জমিদারবাড়ি, রূপগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বাঁধাঘাট, সুপ্রাচীন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ, চিত্রা নদীতে জোয়ার-ভাটা এমনই কত স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে!  উচ্চশিক্ষার জন্য সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে আমার ঢাকায় আসা। জীবিকার প্রয়োজনে এখন রাজধানীর বাসিন্দা হলেও বছরে দুই-একবার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয়। নড়াইলের কালিয়া উপজেলার সেই নিভৃত গ্রাম সুমেরুখোলা এখন আর অজপাড়াগাঁ নয়। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা রাস্তা। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। ছবির মতো সুন্দর নদীর দুই পাড়ের সবুজ ঘন বৃক্ষরাজি। জেলা পরিষদের বদৌলতে গ্রামের খেয়াঘাট এখন শানবাঁধানো। আমাদের ছোটবেলায় হাঁটু সমান কাঁদা মাড়িয়ে খেয়া নৌকায় উঠতে হতো। শানবাঁধানো ঘাট দিয়ে খেয়া পারাপার এখন অনেক স্বস্তির ব্যাপার। সেপ্টেম্বর মাসের ১৯ তারিখ ছিল মহালয়া। চণ্ডিপাঠের মধ্যদিয়ে দেবী দুর্গাকে এদিন মর্ত্যে আবাহন জানানো হয়েছে। ২৬ তারিখ ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় দেবীর বোধন। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে পূর্জা-অর্চনা শেষে ৩০ তারিখ দশমীতে প্রতিমা নিরঞ্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হবে পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসব। মহালয়ার প্রসঙ্গ উঠলে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের নাম উচ্চারণ করতেই হবে। প্রতিবছর মহালয়ার দিন প্রত্যুষে আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হতো চণ্ডিপাঠের অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। অনুষ্ঠানটি দুই বাংলার মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল। তখনকার দিনে গ্রামের মানুষের বিনোদনের মাধ্যম বলতে একমাত্র রেডিও। রেডিওতে চণ্ডিপাঠ শুরু হলে আমাদের ঘুম ভেঙে যেত। আকাশ-বাতাস মুখরিত করে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র মহাশয় পাঠ করে চলেছেন, ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে জেগে উঠেছে আলোক মঞ্জরি... ’।

গ্রামের পূজায় চাকচিক্য কম ছিল। কিন্তু আনন্দের কমতি ছিল না। প্রতিদিন নতুন জামাকাপড় পরে সেজেগুজে বড় বোনদের হাত ধরে প্রতিমা দর্শনে বেরিয়ে পড়তাম। পেটমোটা গণেশ, কলাবৌ আর অসুর নজর কাড়ত। দুপুরে বাড়ি ফিরে কয়টা প্রতিমা দেখা হলো, কোন প্রতিমা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে, সাজ ভালো হয়েছে কোন প্রতিমার— এসব বৃত্তান্ত দিতে হতো মায়ের কাছে। পূজা এলে ঘরে ঘরে মুড়কি আর নাড়ুু বানানোর ধুম পড়ে যেত। বাছাই করা নারিকেল দিয়ে বানানো সুস্বাদু নাড়ু মুখে দিলেই মিলিয়ে যেত। পূজা স্পেশাল। অষ্টমী পূজায় মণ্ডপে খিচুড়ি ভোগ বিতরণ করা হতো। স্বাদই আলাদা। যেন অমৃত! অষ্টমীতে আমাদের বাড়িতে বিশেষ খাবার-দাবারের আয়োজন হতো। লুচি, বেগুনভাজা, সুজির হালুয়া, ছোলার ডাল, মিষ্টি কুমড়ার নিরামিষ, চাটনি আর পায়েস। খাওয়া-দাওয়ার চেয়ে দল বেঁধে ঘোরাঘুরিতে ছিল আমাদের আনন্দ। নবমীতে চালকুমড়া আর পাঁঠাবলি দেওয়া হতো সিকদার বাড়ির পূজায়।

পূজার কয়দিন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে গ্রামোফোন রেকর্ডে বাজানো হতো জনপ্রিয় বাংলা গান। এটাকে বলা হতো কলের গান। ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাশোলপুর কেপি ইনস্টিটিউশনের মাঠে ফিবছর যাত্রার আসর বসত। ঐতিহাসিক কাহিনী নিয়ে যাত্রাপালা হতো। এ সময় ছিঁচকে চোরের উপদ্রব বেড়ে যেত।

শহরের পূজায় চাকচিক্য থাকায় গ্রামের মানুষেরা শহরে যেতেন পূজা দেখতে। আমার প্রাণের শহর নড়াইল। নড়াইল তখন মহকুমা শহর। জেলা হয়েছে অনেক পরে ১৯৮৪ সালে। সুপ্রাচীন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কলেজের অদূরে রূপগঞ্জের ঐতিহাসিক বাঁধাঘাট পূজামণ্ডপে দিনভর দর্শনার্থীদের আনাগোনা। নড়াইলের ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়ির সর্বমঙ্গলা কালীমন্দিরে দুর্গাপূজা হতো। হাটবাড়িয়ার নিশ্চিহ্নপ্রায় জমিদার বাড়ির মণ্ডপেও পূজার আয়োজন করা হতো। জমিদাররা দেশান্তরী হলেও স্থানীয়রা চাঁদা তুলে বারোয়ারী পূজার আয়োজন করতেন। দশমীর দিন সকাল থেকেই বদলে যেত ঢাকের বোল। বাজনায় বিষাদের সুর। অপরাহ্নে রূপগঞ্জের বাঁধাঘাটে শহরের সব প্রতিমা এনে জড়ো করা হতো। ধুনচিনৃত্য আর সিঁদুর খেলার মধ্যদিয়ে দেবীকে বিদায় জানানো হতো। সন্ধ্যার পর জমে উঠত ঢাকের লড়াই। রাত গভীর হলে প্রতিমাগুলো একে একে নৌকায় তুলে মাঝ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হতো। ভাসানোর দিন গুরুজনদের প্রণাম করলে আড়ং খরচা বাবদ হাতে একটা সিকি বা আধুলি গুঁজে দিতেন। ওটা ছিল আনা, সিকি, আধুলির যুগ। ষোল আনায় এক টাকা। এক টাকার বিনিময়ে অনেক কিছু পাওয়া যেত- চকচকে মার্বেল, গুলতি, লাটিম, খেলনা পিস্তল। দশমীর দিন স্থানীয় সিঙ্গাশোলপুর বাজারে বিরাট মেলা বসত। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। যে বছর পাটের ভালো দাম পাওয়া যেত সে বছর মেলায় বিকিকিনি খুব ভালো হতো। ভিড়ের চাপে মেলায় ঢোকাই যেত না। মেলায় গিয়ে খোলা খাবার কিনে খাওয়া বারণ ছিল। কিন্তু কে শুনে কার বারণ! সদ্য ভাজা পাপড় আর গরম জিলাপির লোভ কি আর ওই বয়সে সামলানো যায়? মেলায় গিয়ে কিছু পয়সা খরচ করে বাকি পয়সা জমিয়ে রাখতাম। এ বছর বন্যা এবং রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে ঈদ এবং দুর্গোৎসবের আনন্দ অনেকটাই ম্লান। অসুর তথা অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে দুর্গাপূজার থিম বা চেতনা। দেশে দেশে অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এরই প্রেক্ষাপটে দেবী দুর্গার আরাধনা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা।  ভালো থাকবেন সবাই।

লেখক : সাবেক ডিএমডি, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

 

সর্বশেষ খবর