বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

কর্মকৌশল ও ব্যবস্থাপনাই বড় চ্যালেঞ্জ

আমীর খসরু

কর্মকৌশল ও ব্যবস্থাপনাই বড় চ্যালেঞ্জ

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ২৫ আগস্ট থেকে এ অবধি চার লাখেরও অনেক বেশি হলেও স্থানীয় প্রশাসন এবং ব্যক্তিবর্গ জানিয়েছেন, প্রতিদিন যেভাবে রোহিঙ্গা আশ্রয় প্রার্থীরা বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন তাতে এই সংখ্যা আরও অনেকগুণ বেশি হবে।  আমি নিজেও এই দফায় পেশাগত দায়িত্ব পালনে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফসহ ওই এলাকার বিভিন্ন স্থানে গিয়েছি এবং অবস্থান করেছি কয়েক দিন। ১৯৭৮ সালে শুরু হওয়া এ সমস্যাটির পরে এ পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকটের খবরাখবর সংগ্রহের জন্য ওই এলাকায় যেতে হয়েছে কম করে হলেও ১০-১২ বার। অন্যবারের সঙ্গে তুলনায় এবারের সংকট এবং সমস্যাটি অনেক বিশাল, ভয়াবহ এবং তার চেয়েও বেশি চ্যালেঞ্জের।

মোটামুটি ৪০ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষের কারণে যেদিকেই চোখ যায়— সড়কে, পাহাড়ে, জঙ্গলে সর্বত্র মানুষ আর মানুষ। আর এদের প্রায় সবাই রোহিঙ্গা শরণার্থী। এতটুকু জায়গা ফাঁকা নেই। আমার কাছে মনে হয়েছে এই এক ভিন্ন টেকনাফ, ভিন্ন উখিয়া, ভিন্ন এক জনবসতি। এও মনে হয়েছে, এ এলাকাটি কি রাখাইনের কোনো অঞ্চল, না বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটি ভিন্ন জনবসতি।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপরে অত্যাচার-নির্যাতনের কথা আর এদেশে এসে দুঃখ-দুর্দশার মুখোমুখি হওয়ার ঘটনাবলি পুনরাবৃত্তি করে সময়ক্ষেপণের কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে এ সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিস্তর জেনে গেছেন পাঠকরা এবং অন্যরা। তবে এতটুকু বলব, যা দেখছেন, দেখেছেন; যা শুনছেন বা শুনেছেন— তা চলমান দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, সংকট আর সমস্যার সামান্য একটি চিত্র মাত্র এবং বিশাল হিমবাহের খুবই সামান্য একটি অংশ। পুরোটা বুঝতে গেলে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা বা করানো কঠিন। এ এক নিদারুণ কঠিন-কঠোর সময় পার করছেন লাখ লাখ রোহিঙ্গা। বলা হয়ে থাকে, শুধু রোহিঙ্গা মুসলমানরাই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু কুতুপালংয়ের নাথপাড়া মন্দির এলাকার একটি অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে আমি নিজেই দেখেছি, হিন্দু সম্প্রদায়ের ছয় শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশুকে গাদাগাদি করে খুবই ছোট একটি মুরগির খামারে আশ্রয় নিতে।

মুরগির খামারকে তড়িঘড়ি করে আশ্রয় কেন্দ্র বানানো হয়। তারা জানিয়েছেন, তাদের তথ্যমতে, হিন্দু সম্প্রদায়েরই ৮৬ জন পুরুষকে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৭৮ সাল থেকে দফায় দফায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু এত দিনেও এ সম্পর্কে বাংলাদেশের স্থায়ী কোনো কর্মপরিকল্পনা বা কর্মপদ্ধতি গৃহীত হয়নি। কোনো সরকারই এটা করেনি। এডহক ভিত্তিতে বা একেকবার ঘটনা ঘটেছে, আবার অতীতকে সম্পূর্ণ ভুলে নতুন করে শুরু করা হয়েছে, নেওয়া হয়েছে নিত্যনতুন ব্যবস্থা। বর্তমানে যে অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা বা এতগুলো মানুষ আসার ফলে সৃষ্ট বিশাল সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতার কারণটি কিন্তু এখানেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন বা বর্তমান সরকারের নীতি হচ্ছে- সব রোহিঙ্গা আশ্রয় প্রার্থীকে একস্থানে রেখে দেওয়া। একস্থানে রাখার জন্য যে কর্মকৌশল থাকতে হয় তা কোথাও এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। যে কোনো দেশের শরণার্থী শারীরিক, মানসিক ও অন্যান্য বিপর্যস্ততার কারণে ‘ডেসপারেট’ হতে বাধ্য। তারা খাদ্য-বাসস্থানসহ নিত্যব্যবহার্য ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির জন্য দিগ্বিদিক ছুটবেনই, নিয়ম-শৃঙ্খলা তাদের জন্য কোনো বিষয় নয়— এটাই বাস্তবতা। একস্থানে রাখার জন্য প্রথমেই তাদের ত্রাণ ও জীবন রক্ষাকারী দ্রব্যাদি দিয়ে একস্থানে থাকার মানসিকতা তৈরি করতে হয়— যা এক্ষেত্রে করা হয়নি। শরণার্থী আসার পরেই তাদের মনে এই মানসিকতার জন্ম দিতে হয় যে, এই স্থানেই তারা সব কিছু পাবেন এবং তাদের জীবন রক্ষা পাবে। দ্বিতীয়ত, প্রথমে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে যে নীতি গ্রহণ ও ঘোষণা করা হয়, তা মাত্র দুই দিনের মধ্যেই পাল্টে যায়। কাজেই মাঠপর্যায়ে যারা দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাদের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। নিবন্ধন করে পরে ত্রাণ— এই নীতিতে রোহিঙ্গাদের একই স্থানে রাখা যাবে না, যাচ্ছে না— এটা হচ্ছে ওই এলাকাটি সরেজমিন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা। কোন স্থানটিতে শরণার্থীদের রাখা হবে তাও তাত্ক্ষণিকভাবে নির্ধারণ করা যায়নি। কাজেই যেসব এলাকায় রোহিঙ্গারা সাধারণত আশ্রয় নেয় তার বাইরেও অর্থাৎ হোয়াইকং, শামলাপুরসহ বিশাল এক এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছেন রোহিঙ্গারা, গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বসতি। গত অক্টোবর থেকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে যখন ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল, তখনো প্রায় একই পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল। বিভিন্ন দেশের শরণার্থী সংকট সমাধানের দীর্ঘ আলোচনা বাদ দিয়েও যদি শুধুমাত্র মধ্য ১৯৮০-এর বা ওই সময়ের পাকিস্তানে আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার কথাই বিবেচনা করা হয় তাহলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আমি ১৯৮৭ সালে আফগান যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহের জন্য পাকিস্তানের পেশোয়ার হয়ে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিলাম। তখন দেখেছি কীভাবে এবং কোন কর্মপদ্ধতিতে আফগান শরণার্থীদের একস্থানে রাখার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু এতসবের পরেও শরণার্থী আফগানদের ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। তারা পাকিস্তানময় ছড়িয়ে পড়েছে এবং ফলাফল কী হয়েছে তা সবারই জানা।

কারও প্রতি সমালোচনার বিষয় নয়, ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া বিশাল সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে আমাদের মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে ওপরতলার কর্তাব্যক্তিরা পর্যন্ত অসহায়ভাবে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। এসব সংকটে এর কোনো সুযোগ নেই।

সাধারণত শরণার্থী সংকট নিরসনে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবিক সহায়তা সংস্থাকে প্রথম থেকেই মাঠপর্যায়ে কাজে লাগানো হয় এবং সরকার ও ওইসব প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করে থাকে। আর এভাবেই সংকট মোকাবিলা সম্ভব। কিন্তু জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেমন ইউএনএইচসিআর, আইওএমসহ বিভিন্ন সংস্থা গত বছরের অক্টোবর সংকটের অনেক আগে থেকেই শরণার্থীদের জন্য মাঠপর্যায়ে সরাসরি কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এ সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডকে সরকার খুবই সীমিত করে রেখেছিল। ‘এমার্জেন্সি রেসপন্স’ বলে যে কথাটি আছে তার সক্ষমতা বা এক্সপার্টিজ তাদের আছে। কিন্তু এ সংস্থাগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে গত চার দিন আগে সব জরুরি সহায়তার কাজ করতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে যত ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েছেই।

সংক্ষেপে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতার দু-একটি উদাহরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই। কারণ এ সম্পর্কে শিগগিরই বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে। এ বিষয় মনে রাখতে হবে যে, একটি দেশের কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয় সেই দেশটির নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ, কৌশল ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ এবং বলয়ভুক্তিসহ নানা বিবেচনায়। ভারত বা চীন আমাদের স্বার্থ দেখবে বা সংকট থেকে উত্তরণ করিয়ে দেবে— এটা যারা ভেবেছেন তারা হয় কূটনীতি বোঝেন না অথবা নিদারুণভাবে অনভিজ্ঞ। মিয়ানমারে চীনের স্বার্থ বা ওই দেশটির সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ওপরেই ওই সব দেশের নীতি কৌশল নির্ভর করবে; বাংলাদেশের স্বার্থ আদৌ রক্ষিত হলো কী হলো না, তা তাদের বিচার্য বিষয় নয়— এটাই কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির নিয়ম এবং এটিই স্বাভাবিক। কাজেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মিয়ানমার সফর নিয়ে আশাবাদী হওয়ার তো কোনো কারণ ছিল না। আরেকটি দিকে বাংলাদেশের রেসপন্স বা তাত্ক্ষণিক কার্যক্রম ও প্রতিক্রিয়া মিয়ানমারের চেয়ে পিছিয়ে ছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। তা হচ্ছে- মিয়ানমার খুব সহজেই পুরো রোহিঙ্গা সংকটটিকে জঙ্গি ও উগ্রবাদের সঙ্গে মিলিয়ে তাত্ক্ষণিক ও তড়িঘড়ি করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ মেসেজটি দিয়েছে যে, পুরো বিষয়টিই জঙ্গি ও উগ্রবাদ নির্মূলের অংশ। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রথমাধিকার বক্তৃতা-বিবৃতিতে তার প্রতিফলনও ছিল। কিন্তু এর পাল্টা বক্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যা বলা উচিত ছিল অর্থাৎ এআরএসএ যদি এসব কর্মকাণ্ড করেও থাকে, তার জন্য হাজার হাজার মানুষকে হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়াসহ পোড়ামাটিনীতি গ্রহণ এবং লাখ লাখ মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে কেন? বাংলাদেশ এসব বলেছে, তবে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।  কূটনীতিতে সঠিক সময় ও স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশ বোধকরি এটি অনুধাবনে বরাবরের মতো এবারও ব্যর্থ হয়েছে।

যাই হোক, এখনো সময় আছে— একদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, অন্যদিকে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য যা যা উদ্যোগ প্রয়োজনীয় তা গ্রহণ করতে হবে।

            লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর