শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলাদেশি হাজীদের দুর্ভোগ

শাইখ সিরাজ

বাংলাদেশি হাজীদের দুর্ভোগ

ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হজ। সামর্থ্য থাকলে জীবনে অন্তত একবার হজব্রত পালনের আকাঙ্ক্ষা সব ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরই থাকে। কারণ কাবাকে লক্ষ্য করেই তার ইবাদত। সেই কাবা ঘর বা বায়তুল্লাহ বা হারাম শরিফ একবার স্বচক্ষে দেখার মধ্যে থাকে সারা জীবনের প্রতীক্ষা। প্রতি বছর হজ মৌসুমে টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকা দেখে সবাই অনুধাবন করেন বাঙালি মুসলমানের কাছে হজের আবেদন কতখানি। বিশেষ করে স্বল্প আয়ী গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে হজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র আর মহিমান্বিত কোনো সফর আর নেই। সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে জীবনের শেষ বয়সে এসে তারা হজে যাওয়ার সুযোগ লাভ করেন। সেই বাল্যবেলা থেকে কল্পনার দৃশ্যপটে তারা এঁকে আসছেন কাবা, মুজদালিফা, আরাফার ময়দান, জামারাহ। তারা কল্পনা করে আসছেন প্রিয় নবী রসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিচরণ ক্ষেত্রগুলো। হজে যাওয়ার পরিকল্পনার মধ্যে তারা চোখ বুজে এসব জায়গাই দেখতে পান। অনুভব করেন অন্যরকম এক পবিত্রতা। তাই তাদের কোনো খেদ থাকে না। কষ্ট থাকে না। আমরা টেলিভিশনে হজযাত্রীদের আশকোনা ক্যাম্পে দিনের পর দিন অপেক্ষার চিত্র দেখি। কখনো অনেক কষ্টের ঘটনাও থাকে। বাড়ি থেকে আত্মীয়-পরিজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে তারা হজক্যাম্পে কঠিন সময় কাটান। তাদের এজেন্সি মালিকরা যেভাবে বোঝান, তারা সেভাবে বোঝেন। হাজীদের হজফ্লাইট যেদিন বলা হয়, তারা সেদিন যেতে পারেন না। এমনকি তার পরে কেটে যায় ১০-২০ দিন। কারও কারও এক মাস বা ৪০ দিন। তারা তখন হজ এজেন্সির মর্জির অধীনে থাকেন। এজেন্সি তাদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো টাকা আদায় করে তাদের কষ্টের মধ্যে রেখে বেশি লাভ করার চিন্তা করে। আর হাজীরা মনে করেন, আল্লাহর ওয়াস্তে হজে বেরিয়েছি। যত কষ্টই হোক মুখ বুজে সহ্য করাই হবে সঠিক কাজ। হজে যাওয়ার আগে এজেন্সির আয়োজিত ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে প্রথমেই বলে দেওয়া হয়, হজে গিয়ে যত কষ্টই হোক মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। নয় তো হজের ফজিলত নষ্ট হয়ে যায়। এ কথা অক্ষরে অক্ষরে মানতে গিয়ে এজেন্সি যত অনিয়মই করুক, খাবার না দিয়ে উপোস রাখলেও হাজীরা তা সহ্য করবেন, এমনকি সে কথা কাউকে বলবেনও না। অনেক হাজীকে নানা জটিলতায় হজক্যাম্প থেকে ফিরে যেতে হয়। তারা তাও মেনে নেন, এবার হলো না হয়তো পরেরবার হবে। এর পরও প্রতিবাদ করেন না। আমরা টেলিভিশনের পর্দায় এসব দৃশ্যের কিছুটা দেখতে পাই। কিন্তু কখনো কেউ দেখতে পাই না দেশ থেকে যাওয়ার পর সৌদি আরবে হাজীদের দিনযাপনের চিত্রগুলো। তাদের অমানবিক কষ্টের কথা কখনো কোথাও উঠে আসে না। তারা নিজেরাও কখনো বলেন না। কিন্তু যে দুর্ভোগ ও ভোগান্তির শিকার তাদের হতে হয় তা তাদের মোটেও প্রাপ্য নয়। পৃথিবীর কোনো দেশের হাজী বাঙালি হাজীর মতো এমন যন্ত্রণা, দুর্ভোগ ও বিশৃঙ্খলার শিকার হন কিনা জানা নেই। সেই দুর্ভোগের সামান্য অংশ মনে করেই আজ লিখতে বসেছি।

আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি, ২০০৩ সালে আমার সপরিবারে ওমরাহ পালনের সুযোগ হয়। এরপর ২০০৫ সালে পবিত্র হজ পালন করি। আমার হজ পালনের ক্ষেত্রেও তখন ওই কল্পনাগুলোকে মিলিয়ে নেওয়ার ব্যাপার ছিল। তারপর তখন তুলনামূলক তরুণ বয়স, অনেক কিছু সম্পর্কেই স্পষ্ট ধারণা ছিল না। অনুভূতিও এখনকার মতো প্রগাঢ় ছিল না। তখন লোকসংখ্যা তুলনামূলক কম ও পরিবেশের ভিন্নতা থাকায় বায়তুল্লাহ, মদিনা শরিফসহ পবিত্র প্রসিদ্ধ জায়গাগুলোয় বিচরণ করে অন্যরকম এক প্রাপ্তি অনুভব করেছি। এর পরও একাধিকবার ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে গিয়েছি। মক্কা শরিফ বা মক্কা শহরের পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করেছি। পবিত্র কাবাকে ঘিরে হাজীদের অবস্থান, আরাম-আয়েশ ও সময় যাপনের জন্য সৌদি সরকারের বিশাল আয়োজন দেখে অবাক হয়েছি। আর বার বারই মনে হয়েছে হজ গরিব মানুষের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এবার হজে যাওয়ার পেছনে অন্যতম এক লক্ষ্য ছিল জেনে-বুঝে হজব্রত পালন করা। এ ক্ষেত্রে উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু আমাদের খিলগাঁও মসজিদের খতিব তরুণ আলেম মাওলানা ফয়জুল্লাহ। তিনি সপরিবারে যাচ্ছেন জেনে আমিও উৎসাহী হলাম। হজের প্রায় সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও মাওলানা ফয়জুল্লাহ চেষ্টা করে আমার ও আমার স্ত্রীর নাম তিনি যে এজেন্সির মাধ্যমে যাচ্ছেন সেখানে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে দিলেন। হজ উপলক্ষে তিনি তিন-চার সপ্তাহ ধরে মসজিদে বিশেষ বয়ান করেন। বিশেষ করে হজের নিয়ম-কানুন। কোথায় কোথায় দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করলে রব্বুল আলামিন প্রার্থনা কবুল করেন। যে বিষয়গুলো সাধারণ মুসল্লিদের অনেকটা অজানা। মনে হয়েছে তার সঙ্গে হজে যেতে পারলে অনেক ভালো হতো। অনেক শুদ্ধ ও সঠিক নিয়মে হজ পালন করা যাবে। আমরা এজেন্সির প্যাকেজ অনুযায়ী জনপ্রতি ৫ লাখ ১০ হাজার টাকায় রাজি হলাম। মক্কায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা কাবার কাছেই হবে, আর মদিনায় হবে মসজিদে নববির পাশেই। অনেকেই জানেন, সাধারণ হজযাত্রীদের প্যাকেজ দুই-আড়াই লাখ থেকে শুরু থেকে ৩ লাখ ২০ হাজার বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। এজেন্সিকে এই টাকা দিয়ে যারা হজের রেজিস্ট্রেশন করান তাদের অধিকাংশেরই থাকার ব্যবস্থা হয় মক্কার কাকিয়া বা আজিজিয়া এলাকায়। যারা প্রথম দিকে যান তারা মক্কার আশপাশের হোটেলে থাকার সুযোগ পান। কিন্তু কাকিয়া বা আজিজিয়া থেকে হারাম শরিফের দূরত্ব ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার। কাবা শরিফে নিয়মিত নামাজ পড়াটা প্রাণের আরাধ্য হলেও এত দূর পার করে তা সম্ভব হয় না। মুফতি ফয়জুল্লাহ যেহেতু সাধারণ প্যাকেজে যাচ্ছেন; আমি জেনেশুনেই ওই প্যাকেজের কর্মসূচিগুলো গ্রহণ করেছি। কিন্তু টাকা পরিশোধ করেছি ৫ লাখ ১০ হাজার। যেহেতু কাকিয়ায় থাকতে রাজি হলেন, আমরাও রাজি হলাম। কারণ হজে মুফতির সঙ্গটি আমার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া কাকিয়ায় থাকায় আমার লাভই হয়েছে। আমি সেখানে না থাকলে হাজীদের এই দুর্ভোগ ও দুর্দশা কাছ থেকে দেখতে ও উপলব্ধি করতে পারতাম না।

হজে যাওয়ার পর আমাকে দেখে কাকিয়ার হাজীরা অনেকটা অবাক। তারা বলতে চান, আমার তো মক্কার খুব কাছাকাছি থাকার কথা। জমজম টাওয়ার বা মক্কা হিলটনে। তাদের আমি বললাম, ‘আমি জেনেশুনেই কাকিয়ায় এসেছি।’ কিন্তু সত্যি বলতে, শুধু কাকিয়ায় অবস্থানের কারণে আমার ভাগ্যে হারাম শরিফে ফরজ ও বিদায়ী তাওয়াফ, সাই ও সাফা-মারওয়া ছাড়া আর একটিবারও কাবা শরিফে যাওয়ার সুযোগ জোটেনি। কাকিয়া বা আজিজিয়ায় যারা ওঠেন তাদের পক্ষে ওয়াক্ত নামাজ পড়তে কাবায় আসা সম্ভব হয় না, কারণ হজের সময় রাস্তায় থাকে চরম যানজট। অনেক দূর থেকেই গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। সেখান থেকে হেঁটে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত আসা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ কারণে কালো গিলাফ ঘেরা আল্লাহর ঘর কাবা দর্শন দু-এক বার হলেও মুসল্লিদের তৃপ্তি মেটে না। আক্ষেপ আর আফসোস নিয়েই রওনা হতে হয় মিনার উদ্দেশে।

প্রতি পদে পদে অনিয়ম আর অসুবিধা রয়েছে হাজীদের। যেসব কষ্টের কথা বলার মতো নয়। যেমন কাকিয়ায় আমাদের ট্রাভেল এজেন্টের ব্যবস্থাপনায় খাবার-দাবারেও ছিল চরম অনিয়ম। সকালের নাস্তা আসতে প্রায়ই ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বেজে যেত। একদিন বেলা ১১টায় রুটি-কলা খেয়ে নাস্তা সারতে হয়েছে। অথচ সবাই জানেন, সৌদি আরবে হাজীদের খাবারের কোনো সংকট থাকে না। পৃথিবীতে আরবরা খাবার অপচয়ও করে সবচেয়ে বেশি। আমরাও এর আগে দেখেছি হাজীদের জন্য ফল, জুস, রুটিসহ নানারকম খাবার বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আসছে। অথচ কাকিয়ায় বসে দেখলাম অর্ধপেটে-খালি পেটে হজব্রত পালন করছেন দেশ থেকে যাওয়া হাজীরা। এমন অব্যবস্থাপনার কথা ভাবাও যায় না। প্রায়ই লক্ষ্য করতাম বৃদ্ধ হাজীরা মহাসড়কের পাশে রুক্ষ পাহাড়ে হতাশ বসে আছেন। তাদের চোখেমুখে অনেক আকুতি। পৃথিবী ও সংসারের মায়া ছেড়ে হজে এসেছেন। চারদিকে ধু-ধু শূন্যতা। আশপাশে দোকানপাট পর্যন্ত নেই যেখান থেকে কিছু কিনে খাওয়া যাবে। জীবনকে কষ্ট দিয়ে ইবাদতের প্রতি কীভাবে মনোযোগ রেখেছেন তারা? আর এজেন্সি তো প্রথমেই মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছে কষ্ট সহ্য করতে হবে, কাউকে কিছু বলা যাবে না।

ভোগান্তির দ্বিতীয় পালা মিনায়। মিনায় লাখ লাখ তাঁবু। একেকটি তাঁবুতে ৫০-৬০ জন মানুষ। নিম্নমানের খাবার ব্যবস্থা। অন্য দেশের তাঁবুগুলো সমতলে হলেও বাংলাদেশের তাঁবুগুলো পাহাড়ের উঁচুতে। যেখান থেকে চাইলেও নিচে নামা যায় না। আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে মিনা থেকে আরাফার ময়দানে যেতে মুয়াল্লিমের গাড়ির শিডিউল হেরফের হবেই। কিন্তু এবার দেখলাম গাড়ি আসার কথা যদি থাকে সন্ধ্যায় সে গাড়ি আসে পরদিন ভোরবেলা। ফজরের নামাজের পর গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। অন্য হাজীদের গাড়ি আসে, তারা উঠে যান আমাদের গাড়ি আর আসে না। অপেক্ষা করে করে অবশেষে হেঁটে আরাফার ময়দানের উদ্দেশে রওনা হলাম। সূর্যের তাপ বাড়ছে। রীতিমতো ৪৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা। হাইওয়েতে দীর্ঘ পথ হাঁটার পর ভাড়া বাস পেলাম। তখন বাসগুলো যে ভাড়া হাঁকে সে ভাড়া মিটিয়ে দেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। যেখানে সকাল ৭টা-৮টায় আরাফার ময়দানে পৌঁছানোর কথা, আমরা পৌঁছলাম ১২টা-সাড়ে ১২টায়। সেখানেও তাঁবু আর তাঁবু। ২০০৩ সালে ওমরায় গিয়ে যে বিস্তীর্ণ পাহাড়, মসজিদে নামিরার আদি চেহারা দেখেছিলাম, এবার কিছুই পেলাম না। আরাফার ময়দান বলতে হাজীরা হাশরের ময়দানের মতো কল্পনা করেন। যেখানে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে কেঁদে কেঁদে মোনাজাত করে বুক ভাসানোর কথা। কান্না না এলে কান্নার ভাব ফুটিয়ে তোলার কথা বলা আছে। বিস্তীর্ণ ময়দানে আল্লাহর জমিনে নিজেকে ক্ষুদ্র একটি মানুষ ভেবে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনার সেই উপলব্ধি হাজীদের হলো না। আরাফার ময়দান মানে তাঁবু আর তাঁবু। তাঁবুর মধ্যেই হাজীরা আল্লাহর কাছে হাত তুলেছেন। গাদাগাদি মানুষ একজনের পাশে আরেকজন। এখানে না আসে কান্না, না আসে মনোযোগ। এই হুড়োহুড়ি আর অব্যবস্থাপনায় অনেক হাজীই আমার কাছে আক্ষেপ করে জানিয়েছেন তাদের কষ্টের কথা। আমি নিজেও উপলব্ধি করেছি বিষয়গুলো।

জোহর-আসর আদায় করে সূর্যাস্তের আগেই রওনা হলাম মুজদালিফার উদ্দেশে। মুজদালিফায় এসে মাগরিব ও ইশা একসঙ্গে আদায় করতে হয়। এখানে রাতযাপন করে ফজরের নামাজ আদায় করে জামারার উদ্দেশে রওনা হতে হয়। মুজদালিফার চিত্রও আর আগের মতো নেই। একটির পর একটি ফ্লাইওভার উঠে গেছে। নিচে মানুষ আর মানুষ। অগণিত মানুষ দুই টুকরো সাদা কাপড় পরা সবাই মহান আল্লাহর কাছে সমর্পিত। এখানে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই, উঁচু-নিচুর পার্থক্য নেই। সবাই এক কাতারে। একজন হাজীকে দেখলাম অঝরে কেঁদে প্রাণভরে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন। তাকে দেখে যেন পূর্বপুরুষের কাছে শোনা হজের ইবাদতের আকুতির দৃশ্যটি দেখতে পেলাম। পরপর তিন দিন জামারায় শয়তানের উদ্দেশে পাথর নিক্ষেপের পর হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রসুল (সা.)-এর শহর পবিত্র মদিনায় রওনা হলাম। এর আগে কত শত সমস্যা আর দুর্ভোগ যে পোহাতে হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। যেখানে মুয়াল্লিমদের গাড়ি দেওয়ার কথা, সেখানে গাড়ি পাইনি। অথচ সব হাজীর কাছ থেকে প্রতিটি খাতের কথা উল্লেখ করে টাকা আদায় করা হয়েছে। কিন্তু যেখানে যে খাবার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা, তা পাইনি। কেবল বাংলাদেশের হাজীরাই হজের প্রতিটি ধাপে সীমাহীন কষ্ট সহ্য করেন, কারণ হজ নিয়ে আমাদের দেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা যেমন রয়েছে, একইভাবে রয়েছে আমাদের দেশের এজেন্টদের অতিমাত্রায় ব্যবসায়ী মনোভাব, অদক্ষতা আর দুর্নীতি।

সোনার মদিনায় পৌঁছে অন্যরকম এক প্রশান্তি। রসুল (সা.)-এর প্রিয় শহর তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র, তাঁর রওজা, তাঁর প্রিয় খলিফাদের রওজা, জান্নাতুল বাকি, রিয়াজুল জান্নাহ এই জায়গাগুলোয় এসে মন অন্যরকম হয়ে যায়। আট দিন এই শহরে থেকে নিয়ম করে মসজিদে নববিতে ফজর থেকে জোহর আবার আসর থেকে ইশা পর্যন্ত অবস্থান করে অসংখ্য বাঙালি হাজীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। নামাজ ও ইবাদতের ফাঁকে হাজীরা এগিয়ে আসেন। সবার অনেক অভিযোগ-অনুযোগ। সবাই যেন আমাকে দেখে কিছুটা ভরসা পান। তাদের অসুবিধার অভিযোগগুলো বলতে পেরে কিছুটা হালকা হন। তাদের সবারই কথা, হজ কবুলের মালিক আল্লাহ কিন্তু হজে পবিত্র মক্কা-মদিনায় এসে যেভাবে ইবাদতে মশগুল হওয়ার কথা তা হতে পারিনি শুধু অব্যবস্থাপনার কারণে। সবার কথা শুনে আমারও খারাপ লাগে। শুধু মনে হয়, দিন দিন মক্কা-মদিনার অবকাঠামোর যেমন পরিবর্তন ঘটছে একইভাবে পরিবর্তন ঘটছে অনেক কিছুর। ধর্মপ্রাণ মুসলমানের দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে হজের এই আসরে যে অবস্থানে থাকার কথা, সে অবস্থানে নেই বরং বাংলাদেশ সবচেয়ে উপেক্ষিত, সবচেয়ে বঞ্চিত ও শ্রেণিবিভাজনে সবচেয়ে নিচে পড়ে গেছে। এর দায় অন্য কারও নয়, আমাদের।

পাঠক! হজে গিয়ে আমার এই পাওয়া-না পাওয়া বিষয়গুলো আমি বড় করে দেখছি না। আমি সজ্ঞানে জেনে-বুঝেই আমার প্রিয় খতিব মাওলানা ফয়জুল্লার সঙ্গে হজে গিয়েছি। আমি অনেক কিছু পেয়েছিও। কিন্তু আমার কষ্ট ও আক্ষেপ অন্য হাজীদের জন্য। যাদের কাছে সৌদি আরব পাড়ি জমানো মানে এক অজানা জনপদে যাওয়া। দেশে সীমাহীন দুর্ভোগের দিন পেরিয়ে সৌদি আরব পৌঁছে যাওয়ার পর তারা আর কষ্টের কথা চিন্তা করেন না। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তাদের দুর্ভোগ ও কষ্টের কথা বলে শেষ করা যাবে না। অথচ পৃথিবীর কোনো দেশের হাজীদেরই এই দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। দেখেছি মক্কা-মদিনায় বসবাসরত ভারত ও পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মকে শুধু হাজীদের সেবা করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হয়। তাদের দূতাবাস সৌদি সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজটি করে। তারা স্ব স্ব দেশের হাজীদের জন্য সব ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। আবার মদিনায় বসে লন্ডন-আমেরিকা থেকে আগত বাংলাদেশি হাজীদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। দেখেছি তারা যে অর্থ ব্যয় করে হজে এসেছেন তা আমার প্যাকেজের অর্থের তুলনায় কম। অথচ তারা যে সুযোগ-সুবিধা পান ও স্বচ্ছন্দে ইবাদত করতে পারেন, বাংলাদেশি হাজীরা তা কল্পনাও করতে পারেন না। পাঠক! আমার কাজের কারণেই অনেকে আমাকে চেনেন-জানেন। আমার ক্ষেত্রেই যদি এত দুর্ভোগ ও অসুবিধার ঘটনা ঘটে তাহলে গ্রাম বাংলা থেকে যেসব হাজী জীবনে প্রথম বিদেশে পা বাড়ান, তাদের অভিজ্ঞতা কেমন হয় আপনারাই হিসাব করুন। বার বার ভেবেছি এই লেখাটিতে যে এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছি তার নামটা তুলে ধরব কিনা। কিন্তু নীতি-নৈতিকতার জায়গা থেকে মনে হয়েছে শুধু একটি এজেন্সিকে চিহ্নিত করে এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। আমার এজেন্সিসহ যে এজেন্সির মালিকই লেখাটি পড়ছেন, তারা স্ব স্ব অবস্থান থেকে তাদের অতিবাণিজ্যিক ও দায়িত্বহীন অবস্থানটি একবার স্মরণ করুন। তাতেও আমার এই প্রয়াস কিছুটা সার্থক হবে।

প্রতি বছর হজের মৌসুমে অনেক অব্যবস্থাপনার কথাই ওঠে। অনেকেই অনেক অভিযোগ করেন। ধর্ম মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, হজ এজেন্টের সংগঠন সবাই বিষয়গুলোকে মৌসুমি ঝামেলা হিসেবে গ্রহণ করেন। দিন পেরিয়ে গেলে ভুলে যান। কিন্তু ভুলে যেতে যেতে সমস্যাগুলো এত গুরুতর হয়ে উঠছে যে, হজ আমাদের জন্য দিনের পর দিন হয়ে উঠছে অনেক কঠিন ও দুর্ভোগের। অসংখ্য হাজীর প্রাণের চাওয়া— এ বিষয়ে সরকার এখনই দৃষ্টি দিক। হজের শৃঙ্খলা স্থাপনে একটি দৃষ্টান্ত গড়ে তুলুক।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

সর্বশেষ খবর