রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গায় মুসলমানিত্ব : মনুষ্যত্বে খরা, ছাগলের বাম্পার ফলন

মোস্তফা কামাল

রোহিঙ্গায় মুসলমানিত্ব : মনুষ্যত্বে খরা, ছাগলের বাম্পার ফলন

কেবল মুসলমানের ওপর আঘাত বলেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রতিবাদী কিছু লোক। মানুষ মরছে বলে ব্যথিত নন তারা। তাদের কাতার একেবারে ছোট নয়। এই সাচ্চা মুসলমানগণ কি জানেন, মিয়ানমার থেকে প্রাণে বাঁচতে নাফ নদ পেরিয়ে আরও কিছু প্রাণীও আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে? সংখ্যায় হাজারের কাছাকাছি। ওদের মুসলমানিত্ব নেই। জাতে হিন্দু। একদিকে রোহিঙ্গা, আরেকদিকে হিন্দু। তবে তো তারা মানুষের ধারে-কাছেও নয়। কী দশা মুসলমানিত্ব আর মনুষ্যত্বে? চিন্তা-মানসিকতার এই দৈন্যে হার মানছে মনুষ্যত্ব। জয়ী হচ্ছে পশুত্ব। ঘটছে বিস্তারও। দুষ্কর হয়ে পড়েছে মানুষ খুঁজে পাওয়া। মানুষ কে? কোথায়? খুঁজতে গেলে খটকা এসে যায় আপনা আপনি।

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা প্রাণীগুলো মানুষ নয়, রোহিঙ্গা। ভেসে আসা দেহগুলো লাশ। মানুষ নয়। তাদের হত্যাকারী-ধাওয়াকারীরাও মানুষ নয়। তারা মগ-ঠগ। মগ, মগের মুল্লুক- নেতিবাচক বাগধারা হলেও অভিধান তাদের মানুষই বলে। বাংলা একাডেমি এর অর্থ লিখেছে— ১. ব্রহ্মদেশ বা আরাকান রাজ্য। ২. অরাজক রাষ্ট্র, যে রাজ্যে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত নয়, যেখানে যথেচ্ছাচার হয়।

আদি বার্মা আর আধুনিক মিয়ানমারের নাগরিকরা ঐতিহাসিকভাবেই বর্বর, নিষ্ঠুর। মানুষের গলায় দড়ি বাঁধা, হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া রাখাইনদের ঐতিহ্য। এরপরও মানুষ বটে। সেই সূত্রে মানুষ তো মিয়ানমারের অং সান সু চিও। মানুষ বলেই তো গণতন্ত্রের নেত্রী। শান্তিতে নোবেল জয়ী। কিন্তু মানুষকে কচুকাটা করা কি মনুষ্যত্বের নমুনা? না-কি গুণে-মানে মানব উতরে মহামানবের কাণ্ড? নইলে শোনা কথার এত সত্যতা কেন? এক সময় মগের মুল্লুকের কথা মানুষ শুনেছে। এখন দেখছে মগরা ঠগও। হিংস্রতার সঙ্গে চাতুরী-মিথ্যাচারেও সেরা।

‘জোর যার মুলুক তার’— এ বাগধারার মগদের বধ করা ইতিহাসে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ’র অন্যতম মহৎ কীর্তি হিসেবে স্বীকৃত। ১৬৬৪ সালে বাংলার শাসনভার হাতে নিয়েই তিনি টপ প্রায়োরিটিতে প্রথম নজর দেন এই ইতর টাইপের জলদস্যুদের দমনে। এদের বিরুদ্ধে তার অভিযান শুরু হয় ১৬৬৫ সালে। ১৬৬৬-তে চট্টগ্রাম জয়ের মাধ্যমে শায়েস্তা খাঁ সমূলে অবসান ঘটান অর্ধশতাব্দীজুড়ে চলে আসা মগের মুল্লুকের। মগদের কাছে নিজেরা ছাড়া আর কেউ মানুষের আওতাভুক্ত নয়। সেই ছিলছিলা হালের মুসলমানিত্বে মানুষ নির্ণয়ের ভাবভঙ্গিতেও। যে ভাবধারায় সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়ায় মারা পড়া জীবগুলো শুধুই মুসলমান। ভারতে গরু আন্দোলনে হতাহতরাও মানুষ নয়। তাদের কিছু মুসলমান। কিছু হিন্দু। প্যালেস্টাইন-গাজায় মরছে ফিলিস্তিনি। কখনো কখনো প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের এত জনগণও কি মানুষ? গত বছর কয়েক ধরে আগুনে পুড়িয়ে, গ্রেনেডে, গুলিতে, জবাই করে হত্যার শিকাররা কি মানুষভুক্ত? ওরা জঙ্গি, শিবির, ব্লগার, নাস্তিক। নাসিরনগর-রামু-গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন জায়গায় নিপীড়িতরা? তারা হিন্দু, বৌদ্ধ, সাঁওতাল। এমনকি মাঠে-ময়দানে বা নিজেদের লড়াইয়ে ক্ষমতাসীন দলের হতাহতরাও মানুষের আওতামুক্ত। এক বাক্যে বলে দেওয়া হচ্ছে ওগুলো লীগ। আওয়ামী, যুব, ছাত্রসহ বিভিন্ন লীগ। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যাসহ বীভৎস কাণ্ডের হোতারাই বা কি? এরা ধর্ষক। অথবা পুরুষ। গা-গতরে মানুষের মতো। আর হত্যা-ধর্ষণের শিকাররা নারী, মহিলা, তরুণী, যুবতী। তনু, মিতু, রূপাসহ নানান নাম তাদের।

তা হলে মানুষ কে? কোথায়? মানুষ বলব কাকে? মানুষ নির্ণয়ের মানদণ্ড কী? সেই এখতিয়ারই বা কার? এসব প্রশ্ন কূলকিনারাহীন। তবে ফয়সালা রয়েছে আমাদের গল্প, কাব্য, গানসহ সাহিত্যের নানা পর্বে। মানুষ, মানবতা বিষয়ে হাওলাত করা যায় কাজী নজরুলের কবিতা। দেওয়া যায় তার বিখ্যাত কাণ্ডারী কবিতার উদ্ধৃতি—

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’

নজরুলের মানুষ কবিতায়ও রয়েছে এ সংক্রান্ত ইস্পাত সত্য কথা—

‘মূর্খেরা সব শোনো

মানুষ এনেছে গ্রন্থ

গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’

বিদ্যমান অবস্থায় ক্রিয়া-কর্ম, বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ খুঁজে পেতে কষ্ট হলেও হাল ছাড়েননি সাধক মানুষ লালন শাহ। চারদিকে মানুষের পর মানুষই দেখেছিলেন এই স্বভাব কবি। তিনি বলে গেছেন—

‘যথা যাই মানুষ দেখি

মানুষ দেখে জুড়াই আঁখি।’

আবার বলেছেন—

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’

নানা উপমায় মানুষ ঠিক করে গেছেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। ‘মানুষ কে?’— কবিতার তিনটি স্তবকেই তিনি দিয়েছেন মানুষের বিষদ বর্ণনা। প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ায় এর প্রথম স্তবক এবং দ্বিতীয়-তৃতীয় স্তবকের অন্তত শেষাংশ উল্লেখ করার লোভ সামলানোর মতো নয়।

নিয়ত মানসধামে একরূপ ভাব

জগতের সুখ-দুখে সুখ দুখ লাভ।

পরপীড়া পরিহার, পূর্ণ পরিতোষ

সদানন্দে পরিপূর্ণ স্বভাবের কোষ।

নাহি চায় আপনার পরিবার সুখ

রাজ্যের কুশলকার্যে সদা হাস্যমুখ।

কেবল পরের হিতে প্রেম লাভ যার

মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?

..............................

সকলে সমান মিত্র শত্রু নাহি যার।

মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?

..............................

অমৃত নিঃসৃত হয় প্রতি বাক্যে যার

মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?

 

এরপরও বাস্তবতায় উল্টাচক্র। মানুষ শনাক্ত করা কঠিনেরও কঠিন। মুসলমানিত্বে মানুষ নির্ণয়ের ব্যাধিগ্রস্তরা ভুলেই যান ইসলাম ধর্মে মানুষকে বলা হয় জীবকুলের সেরা। সৃষ্টির সেরা জীব। আরবি তরজমায় আশরাফুল মাখলুকাত। হিংসায় উন্মত্ত-রক্তঝরা পৃথিবীতে বাংলার মধ্যযুগের অমুসলিম কবি চণ্ডীদাস তো বলেই গেছেন— ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’

আমরা কি আছি সেই জায়গায়? ধর্ম, কাব্য, মানবতা কোথাও? এতে মনুষ্যত্বের খরা মোড় নিয়েছে মঙ্গার দিকে। বহু আগেই প্রমাণদৃষ্টে তা ধরা পড়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কলমে। বিখ্যাত ‘বঙ্গমাতা’ কবিতায় তিনি সাত কোটি বাঙালিকে মানুষ হিসেবে গড়ে না তোলায় দায়ী করেছেন মুগ্ধ জননীকে। একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যায় কবিতাটিতে—

পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে

মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।

হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে

চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।

দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান

খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।

পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে

বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালো ছেলে করে।

প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে

সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।

শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে

দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।

সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী

রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।

কবিগুরুর কবিতার মর্মার্থ আজও অস্বীকারের সুযোগ নেই। অবশ্য ভুল ধরা যায় সংখ্যাতত্ত্বে। কারণ আমাদের জনসংখ্যা এখন সাত কোটি ছাড়িয়ে বিশ কোটি ছুঁই ছুঁই। কিন্তু মনুষ্যত্বের সংখ্যা ও মানের তথ্য-সাবুদ বড় দুর্বল। মানব সম্পদ উন্নয়নে অব্যাহতভাবে পেছাচ্ছে বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সূচকে ১৩০টি দেশের মধ্যে আমরা এখন ১১১তম অবস্থানে। প্রাপ্ত নম্বর বড়ই দুর্বল। ফেল নিয়েই টানাটানি। গত বছরও অবস্থা এত নাজুক ছিল না। গত বছর ছিল ১০৪তম। দুই বছর আগে ২০১৫ সালে ছিল ৯৯তম অবস্থানে। এই সূচকে শ্রীলঙ্কা-নেপালও বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে। ১৩ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল হিউম্যান ক্যাপিটাল রিপোর্ট-২০১৭-তে প্রকাশ হয়েছে এ তথ্য।

মানব সম্পদ উন্নয়নের এ করুণ দশার মধ্যেও ছাগলে আমাদের গোল্ডেন জিপিএ। ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে অব্যাহতভাবে শীর্ষত্ব ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। অবস্থান চতুর্থ স্থানে। ছাগলামির নিত্য উন্নতি হলেও ছাগলের বাম্পার ফলনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। প্রচারও নেই। এতে স্বীকৃতিটি পড়ে রয়েছে অজান্তে, আড়ালে, অবহেলার তলানিতে। প্রায় এক যুগ ধরে ছাগল বিষয়ে কাজ করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা-এফএও এবং আন্তর্জাতিক আণবিক গবেষণা কেন্দ্র-আইএইএ। সংস্থা দুটির মূল্যায়নে এসেছে পিলে চমকানো এ তথ্য। তারা জেনেছে বাংলাদেশে এখন ছাগলের সংখ্যা কমছে কম আড়াই কোটি। দেশের প্রায় এক কোটি লোক ছাগল পালন করে। একক কোনো প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে এটা একটা রেকর্ড। এ অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে ছাগল উৎপাদনে ভবিষ্যতে ফোর্থ পজিশন থেকে ফার্স্ট-সেকেন্ড পজিশন কঠিন হওয়ার নয়।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট

 বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সর্বশেষ খবর