সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

যে সত্য জানা হলো না!

দিলরুবা শরমিন

যে সত্য জানা হলো না!

দৌলতদিয়া ঘাটে যখন পৌঁছলাম, তখন অভিজ্ঞতার সূর্য মধ্য আকাশে। ঢাকা থেকে একক যাত্রা। উদ্দেশ্য সহজ। এনজিওগুলোর পক্ষে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করা। অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কিছু নেই বললেই চলে। সুইজারল্যান্ড রেডক্রসের পক্ষ থেকে এইচআইভি এইডস পজিটিভ হোল্ডারদের সমস্যাগুলো জানা, সেই সব তৎকালীন সরকারকে জানানো আর বাংলাদেশ রেডক্রস ও স্থানীয় এনজিওগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে একটা কাজ শুরু করে দিয়ে যাওয়াই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। নিজের মনের ক্ষীণ আশা ছিল যদি সুযোগ থাকে তাদের মৌলিক অধিকার কী কী লঙ্ঘন হচ্ছে সেটা জেনে নিয়ে কিছু একটা করা।

গনগনে দুপুরে ঘাটে নেমে সেখানে পৌঁছানোর জন্য পথে একে-ওকে যৌনপল্লীতে যাওয়ার সঠিক পথটি কোন দিকে জিজ্ঞাসা করতেই কারও কারও চিকন চাহনি আর রহস্যময় হাসি মিশ্রিত মুখ দেখে বিব্রত-বিরক্ত বা বিস্মিত হইনি। এসব কিছুর প্রস্তুতি নিয়েই আমার সেখানে যাওয়া। আবার কারও তাকানোতে নব্য আনন্দের ঝিলিকও দেখেছি। যত প্রস্তুতিই থাক, সেখানে পৌঁছে যাওয়ার পর সেই বয়সে একটুও কি থমকে যাইনি? গিয়েছিলাম!

স্যাঁতসেঁতে বসতিতে যত না প্রাপ্তবয়স্ক নারী যৌনকর্মী তার চেয়ে বেশি কিশোরী-সদ্য তরুণী। দু-চারজন মধ্যবয়স্ক। বেশ কিছুসংখ্যক পুরুষ। যাদের যৌনপল্লী নিয়ন্ত্রক বা কর্তাব্যক্তি বলেই মনে হলো। প্রথমে তাদের কাছেই আমার পরিচয়, আসার উদ্দেশ্য খোলসা করে বলতে হলো। কারণ সরকারি পর্যায় থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে জানানোর পরও ওই এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তাব্যক্তি তো তারাই। আমার ভিজিটিং কার্ডের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তারা একচিলতে উঠোনের এক কোণে মাদুর পেতে আমাকে বসতে দিল। মুরুব্বি শ্রেণির সুস্বাস্থ্যের অধিকারী পানখাদক দু-চারজন তাদের ঘরানার নারীদের ডাকলেন। তাদের কাছে আমার দ্বিতীয় দফার ইন্টারভিউয়ের সময় এক ভদ্রমহিলা আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘তা আপনার তো বিয়ে হবে না। আপনি খারাপপাড়ায় আইছেন।’ কত বাস্তব প্রশ্ন আজ বুঝি। আমরা যারা কাজের প্রতি পরম ভালোবাসা নিয়ে এসব ঝুঁকির সঙ্গে দিনরাত মোকাবিলা করি আসলেই আমরা জানি প্রশ্নটির গভীরতা। 

সেই ভদ্র মহিলাদের আবার আমাকে আসার উদ্দেশ্য, কাজের বিষয়ে সবিস্তারে বলার পর তারা অসংখ্য প্রশ্ন করলেন যার সব উত্তর আমার দেওয়া সম্ভব ছিল না বা যা দিয়েছিলাম সেই সব আজ আর বলাও যাবে না।

 ভ্রমণ পথে পানিটুকুও খাওয়া হয়নি এই কথা মনে পড়াতেই পিপাসা বেড়ে গেল। ওদের কাছে পানি চাইতেই উপস্থিত নারী-পুরুষ মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। বুঝলাম ইতস্তত বোধ করছেন। দু-চারজন শিশু যে কোনো সময়ে আমার ঠিক পেছনেই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল সেটা টের পেলাম অবোধ এক শিশু যখন আমাকে প্রশ্ন করে বসল, ‘তুমি কি আমাদের গেলাসে পানি খাবা?’ চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের আগামী— যারা এই ছোট্ট বয়সে জেনে গেছে ‘আমরা’ আর ‘তোমরা’।

এরপর একে একে ভিড় বাড়তে লাগল। সারা রাত জেগে থাকা সদ্য ঘুম থেকে জেগে ওঠা নারী। অনেক পুরুষের শরীরের ক্লান্তি দূর করা ক্লান্ত নারীকুল। কেউ দাঁত ব্রাশ করতে করতে সেই উঠোন বৈঠকে কী কথা হচ্ছে- তা শুনতে দাঁড়িয়ে গেল, কেউবা কাপড় হাতে গোসল করতে যাওয়ার আগে হঠাৎ অচেনা একজনকে দেখে দাঁড়িয়েছে। কেউ বা ঘাটের হাটে যাবে বাজার সওদা করতে। কারও মুখে বিস্ময়। কেউ বিরক্ত। কারও বা চোখে সন্দেহ!!! বছর তিরিশের এক যুবক আলোচনা জমে উঠতে না উঠতেই আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল। বোঝার চেষ্টা- আমার আসল মতলব কী? এত মিঠা মিঠা কথা কেন? তাদের দেখিয়ে আসলে আমি কত টাকা ফায়দা লুটে নেব? তাকে কত ভাগ দেব???

এ রকম বৈরী আবহাওয়ার মাঝ দিয়েই কাজ শুরু করেছিলাম দৌলতদিয়া ঘাটের যৌনপল্লীর একঝাঁক মানুষের সঙ্গে। যে স্মৃতি আজও আমার হৃদিমাজারে লেগে আছে। আমার বেদনাদায়ক ভালো লাগা। সেদিন আবার যখন ফিরে এলাম সেই উঠোন বৈঠকে তখন বেলা মন্দ না। ওদের সবারই খাবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তারাও উসখুস করছে। আমিও প্রচণ্ড ক্ষুধারত, কিন্তু কাকে বলব সেটা? কে খাওয়াবে। কোথায় খেতে যাব? আমি কিনে খেলে তারা মনে কষ্ট পাবে। আমার ঝোলার মাঝে যেসব শুকনা খাবার আছে, সেটা বের করা সম্ভব না তাহলে ভেদাভেদটা আরও স্পষ্ট হবে। তাহলে উপায়???

ব্যবস্থা সেই যুবকই করে দিল। এক অপরূপ লাবণ্যময়ী (বছর ১৭-১৮ হবে হয়তো) একটি মেয়েকে নির্দেশ দিল আমার খাবারের আয়োজন করতে। ভেঙে গেল সভা। বিকালে আবার দেখা হবে এই কথার পর যে যার মতো ঘরে চলে গেল, আমি গেলাম সেই মেয়েটির সঙ্গে একটা ছোট্ট খুপড়িতে। একজনের পক্ষে বসা বা শোয়াই কষ্টের তার ওপর আমি এক বিশাল বোঝা। ভ্যাপসা গরম-আলো-বাতাসহীন মাটির স্যাঁতসেঁতে খুপরি যেন আমার একমাত্র ভরসা বলেই মনে হলো।

বিকালটা আর তেমন বসা হলো না। যতটুকু কথা হলো তার মাঝে আমি থাকব কয়দিন? খাব কি? এসব নিয়েই বেশি প্রশ্ন আসল কাজের প্রতি কারও তেমন মনোযোগ তখনো আকর্ষণ করতে পারিনি। সেটা আশাও করিনি। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে না পারলে কাজ করব কি? আমি তাদের সঙ্গেই সময় কাটাতে চাই এই ইচ্ছা তাদের জানাতেই আবারও একে-অপরের দিকে তাকাতাকি। খুব স্বাভাবিক। কার ভালো লাগে এই উটকো ঝামেলা? ওদের নিত্যদিনের জীবনযাপনের ব্যাঘাত ঘটানো!!! তারপরও সেই পেশাদার নেতা গোছের ছেলেটাই বরাদ্দ ও বন্দোবস্ত করে দিল সেই লাবণ্যলতার ঘরটিই আমার অস্থায়ী ঠিকানা।

সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সব তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। কেউ আমাকে পরামর্শ  দিল  লুকিয়ে পড়তে। কেউ বা কিছুটা সময় শহরের দিকে চলে যেতে। আমার নিজস্ব কিছু ভাবার বা বলার কিছু ছিল না। ওদের এলাকা ওদের মতোই চলতে হবে। আমার আশ্রয়দাতা মেয়েটি মুরুব্বি শ্রেণির এক মহিলাকে জানিয়ে দিল, আজ সে কোনো কাজ করবে না, তার ঘরে যেন কাউকে না পাঠানো হয়। তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠা মাঝবয়সী ভদ্র মহিলা একটু পর ঠাণ্ডা হয়ে গেল, যখন বুঝল তার আজকের বরাদ্দ বন্ধ থাকবে না। এমনকি সেই নেতা শ্রেণির যুবক ও খুশি বরাদ্দের ঘাটতি নয়, বরং বাড়তি পাওনা পাবে।

কিছুটা ইতস্তত সেই লাবণ্যলতা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল তার মাটির মেঝেতে বিছানো একটা মোটা কাঁথার ওপর ধূলিমলিন চাদর পরিবর্তন করার জন্য। আমার শোবার বালিশ নিয়েও তার চিন্তা এরকম হাজারো চিন্তার মাঝে তার একটা আত্মতৃপ্তিমূলক হাসি আমি দেখলাম যে, ‘আজ তার কাজ নেই।’ আহ কি না পরম শান্তি সেদিন মেয়েটি অনুভব করেছিল!!!

পাশে বসে গল্প করতে করতে দেখলাম পুঁইশাক কেবল হাত দিয়েই কত দ্রুত রান্নার উপযুক্ত করে ফেলা যায়। কত দ্রুত চাল, ডাল আর পুঁইশাক মিশিয়েই অসাধারণ সুস্বাদু খিচুড়ি রান্না হয়। গরম গরম সেই খাবারের সঙ্গে বিনয়, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থাকলে খেতে কত মজাই না লাগে!

ঘর থেকে তো আর বের হওয়াই যাবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সব ‘ক্লায়েন্ট’ বিদায় না নেবে বা যার যার ঘরে ঢুকে পড়বে। তাই গল্পই সম্বল আমার। কথা বলতে বলতে জানতে ইচ্ছে হলো, কীভাবে এখানে এলো এই অপরূপ লাবণ্যময়ী মেয়েটি? কেমন কাটে তার সময়?  কেমন আয় হয়, কেমনইবা খরচ? এরকম কথার একটু সুর ধরিয়ে দিতেই মেয়েটি গরগর করে বলে দিতে লাগল এতদিন ধরে জমিয়ে রাখা তার না বলা কথা।

অনুজ্জ্বল আলোয় তার মুখের আভা ছোট্ট এই ঘরটাকে আলোকময় করে দিতে থাকল। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনলাম কেবল মা মারা যাওয়াতেই এই মেয়েটির বাবা তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে এই ঘাটে বেচে দিয়েছে। বাবা??? বাবা!!!

এই ঘাটের কেনা-বেচা বেশ অন্যরকম। যে কেউ ইচ্ছে করলেই এখানে এসে ব্যবসা ফেঁদে বসতে পারবেন না। তার জন্য তাকে শক্ত সমর্থ নেতা গোছের কাউকে বিয়ে করতে হবে। যার কোনো দলিল থাকবে না, কিন্তু সবাই জানবে এর মালিক কে। এই রকম একেকটা শক্ত সমর্থ পুরুষের অধীনে অনেক যৌনকর্মী আছেন যাদের ক্ষমতা নেই তার স্বামীর (?) কথার বাইরে যাওয়ার। এই মেয়েটির পল্লীস্বামী সেই নেতা গোছের ছেলেটি। তার মুখেই শুনছিলাম বৈধ পল্লী হওয়ার পরও পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় নেতা, মাতবরদের ‘মাসিক বখরা’ দেওয়ার কথা। এমনকি মাঝে মাঝে তাদেরও মনোরঞ্জন করতে হয় বৈকি! মেয়েছেলের শরীর গণিমতেরই তো মাল!

অদ্ভুত স্বাধীনতা! তিন দিন থাকলাম এক অন্যরকম জগতে। সেখানে কিছু বেসরকারি সংস্থা কাজ করে শিক্ষা-স্বাস্থ্য নিয়ে। যদিও সেখানে নিরাপদ যৌনাচরণের কোনো বালাই নেই। গর্ভনিরোধের ব্যবস্থা থাকলেও ব্যবহার নেই। নেই নিরাপদ খাবার পানি। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। নেই পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য শরীর বেচাকেনা ছাড়া আর কোনো বিনোদন। ওরা তখনো কেউ ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেনি। ওদের শবের সৎকার হয় নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে। ওদের নিজস্ব কোনো ধর্মাচরণের ব্যবস্থা নেই। কিছুই না থাকার পরও ফি বছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সব ব্যবস্থাই আছে।

আজ জানি না তাদের অগ্রগতি কতটুকু, তবে শুনেছি আজ তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, তাদের ধর্ম পালনের ব্যবস্থা আছে, তাদের মাঝে কেউ মারা গেলে যার যার ধর্ম মতেই সৎকার হয়, তারা ধর্মীয় উৎসব পালন করেন, মায়ের নাম সব জায়গায় থাকতেই হবে এই নিয়ম করায় অনেকেই সুবিধাবোধ করছেন। আমাদের সেদিনের সেই প্রতিবেদন আসলেই সরকার মহলের কেউ পড়েছিল কিনা জানি না। তবে আজ যখন শুনি, খোঁজ পাই দিন বদলেছে তাদেরও যা আসলে আমরা চেয়েছিলাম তখন ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে, আরও ভালো লাগত যদি শুনতাম তারা সবাই ‘মুক্ত-স্বাধীন-বন্ধনহীন।’ যা হওয়ার নয়।

আজও সেই অপরূপা মেয়েটিকে খুঁজি। যার সঙ্গে তিন দিন তিন রাত কেটেছে। যে মা হতে চেয়েছিল। সংসার চেয়েছিল। স্বামী সে যত গরিবই হোক, তাকেই মেনে নিতে চেয়েছিল। কিছু টাকা জমিয়ে তার পল্লী স্বামীকে বিদায় দিয়ে ভিন গ্রামে চলে যেতে চেয়েছিল। কি জানি তার স্বপ্ন অপূরণই রয়ে গেল কিনা? নাকি আজ বুঝি সে কয়েক বাচ্চার মা। যাদের পরিচয় কেবল ওই পল্লী অথবা মা হতে গিয়ে মারা গিয়েছে মেয়েটি? কি জানি!!!

লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর