বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আবুল বারকাত : জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

অধ্যাপক সুভাস কুমার সেনগুপ্ত

আবুল বারকাত : জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

স্বপ্নময় এক মানুষ।  সুঠাম, একহারা স্নিগ্ধ, সৌম্য, বুদ্ধিদীপ্ত। দেশ ও বিশ্বমানবতার জন্য উৎসর্গিত, আত্মমগ্ন এক ব্যক্তিত্ব। তার প্রতি কর্মে ও ভাবনায় মূল চরিত্র মানুষ, মানুষের কল্যাণ। যে আদর্শ জেনে ও মেনে মানুষ হয়ে ওঠে ‘মানুষ’, ‘প্রাণময় মানুষ’ সেটি তার মাঝে অপরিমেয়। সমাজ-বাস্তব বিনির্মাণে যেসব অন্তরায় পথ আগলে দাঁড়ায়, থমকে যায় সমাজ-মানুষের অগ্রগতি সেটাই স্পষ্ট করে দেখিয়ে, চিনিয়ে দেন— উপলব্ধি করতে শেখান এই ‘সুসংস্কৃত’, ‘ঋদ্ধ মানুষটি’। তিনি আমাদের মনস্বী শিক্ষক, অধ্যাপক আবুল বারকাত।

ঐতিহ্যমণ্ডিত ও সুশিক্ষিত এক পরিবারে তার জন্ম কুষ্টিয়ায়, ১৯৫৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। বাবা প্রয়াত ডা. আবুল কাশেম ও মা প্রয়াত নুরুন্নাহারের তৃতীয় সন্তান তিনি। কুষ্টিয়া জেলা স্কুল থেকে এসএসসি (১৯৭০) এবং কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমান প্রথম বিভাগে এইচএসসি (১৯৭৩)। বাংলাদেশ সরকারের মেধাবৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ১৯৭৩-এ মস্কো যান। মস্কো ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমি (প্লেখানভ ইনস্টিটিউট) থেকে বাণিজ্য অর্থনীতিতে বিশেষায়নসহ অর্থনীতি বিষয়ে এমএসসি (১৯৭৮)। সব বিষয়ে সর্বোচ্চ গ্রেড নিয়ে এতে অনার্সসহ প্রথম হয়েছিলেন। একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে বিশেষায়নসহ অর্থনীতি শাস্ত্রে লাভ করেন পিএইচডি ডিগ্রি (১৯৮২)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৮২ সালের ১০ আগস্ট। এভাবে পর্যায়ক্রমে অধ্যাপক; এ বিভাগের অন্যতম সফল চেয়ারম্যান (২০০৯-২০১২)। ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জাপান স্টাডি সেন্টার’-এর পরিচালক (২০১২ থেকে এ পর্যন্ত)।

শিক্ষা-ভাবনায় এখন তিনি পথিকৃৎ। মেধা, মনন, কর্মসংস্কৃতি, ‘একলব্যের’ মতো সনিষ্ঠ-সাধনা ও অদম্য জ্ঞান-স্পৃহা তাকে আকাশছোঁয়া যশ এনে দিয়েছে। দেশে, আন্তর্জাতিক পরিসরে তিনি সুপণ্ডিত ব্যক্তিত্ব, পলিটিক্যাল ইকোনমির এক অবিসংবাদী ‘Master of masters’- সেটিই তার বিশিষ্ট পরিচয়।

বারকাতের মতো প্রতিভাদীপ্তের কাছে ‘area of specialisation’ বলে কিছু নেই। তিনি বলেন, জ্ঞান-তৃষ্ণা মানুষকে জ্ঞানের যে-কোনো প্রশাখাতেই অবাধ বিচরণের ছাড়পত্র দেয় এবং বিষয়কে নতুন করে চিনতে শেখায়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খ্যাতি কুড়িয়েছেন চিন্তা-চেতনা ও গবেষণার বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : উন্নয়ন ও মানব উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি; দারিদ্র্য-বৈষম্য-বঞ্চনা; জমি, কৃষি সংস্কার; ভূমি মামলা; অর্পিত সম্পত্তি; অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি; মৌলবাদের অর্থনীতি; কালো টাকার অর্থনীতি; শিল্পায়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি; ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী; অর্থনীতি-রাজনীতির দুর্বৃৃত্তায়ন; শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও শিশু দারিদ্র্য; সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী; স্যানিটেশন; আর্সেনিক দূষণমুক্ত পানি; ব্যাংকিং ও মুদ্রানীতি; রাজস্বনীতি; কর্মসংস্থান; সুশাসন; বিশ্বায়ন ও বিশ্বায়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি; শাসনতন্ত্র ও উন্নয়ন দর্শন; উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি অর্থায়ন; নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার গবেষণা দেশে-বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষণা গ্রন্থ ছাড়াও তার রয়েছে অনধিক ৬০০টি গবেষণা কর্ম। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের কমপক্ষে ৭০টি দেশে আমন্ত্রিত হয়েছেন, পরিভ্রমণ করেছেন। অগুনতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে, সম্মেলনে মূল বক্তা হিসেবে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। তিনি গড়ে তুলেছেন ‘মুক্তবুদ্ধি’ প্রকাশনা। সমাজবিজ্ঞানে মৌলিক উচ্চমানের গবেষণা কর্মের জন্য তিনি পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ গবেষণা অ্যাওয়ার্ড ‘ইব্রাহিম মেমোরিয়াল গোল্ড মেডেল’ (১৯৯৯-২০০০; এবং ২০০৪-২০০৫)। এ ছাড়াও পেয়েছেন অর্থনীতি বিজ্ঞানে মার্কেন্টাইল ব্যাংক স্বর্ণপদক। তার ভাষাগত ব্যুৎপত্তি ঈর্ষণীয়। বাংলা, ইংরেজি ও রুশ ভাষায় কথা বলেন, লেখেন চমৎকার।

তিনি দেশ-বিদেশে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। টানা চারবার (২০০০-২০০৮) বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এবং দুবার (২০১০-২০১৪) নির্বাচিত সভাপতি; বর্তমানে এ সমিতির নির্বাচিত সদস্য (২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত)।

জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান (২০০৯-২০১৪) হিসেবে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকের জন্য স্বল্পমেয়াদি সুদমুক্ত ঋণ প্রবর্তন, ব্যাংকের মুনাফা সর্বোচ্চকরণের পাশাপাশি অস্থায়ী কর্মচারীদের চাকরি স্থায়ীকরণ ইত্যাদি তার অন্যতম কর্মকাণ্ড। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ঋণ ব্যবস্থার উৎকের্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অপরিসীম। বারকাত নিজের উদ্যোগে, কঠোর পরিশ্রমে গড়েছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার’, যা তার স্বপ্নের ও সাধনার। ছোটভাই চিকিৎসক ড. এ কে এম মুনিরকে নিয়ে যৌথভাবে গড়ে তুলেছেন ‘মানব শক্তি উন্নয়ন কেন্দ্র’। আর্সেনিকমুক্ত পানির জন্য সনো ফিল্টার উদ্ভাবন ও বিনামূল্যে দরিদ্র, সাধারণ মানুষের মধ্যে তা বিতরণ তার অসামান্য কীর্তি। সামাজিক দায়বদ্ধতা ও কর্তব্যবোধের ক্ষেত্রে তিনি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শান্তি ও প্রগতির পক্ষে আজন্ম সংগ্রামী এই মানুষটি সাধারণ জনগণের কল্যাণে গড়ে তুলেছেন ‘আবুল বারকাত পিস অ্যান্ড প্রোগ্রেস ফাউন্ডেশন’।

বারকাতের প্রথম ও সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন সফল, যশস্বী শিক্ষক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক; ঋদ্ধ গবেষক; স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক। শুধু তাই নয়, তিনি মননশীল লেখক; তার সব সৃষ্টি, সব লেখার প্রতি পাঠকের অসীম আগ্রহ। শুধু সাধারণ নয়, সিরিয়াস পাঠকের জন্যও চার দশক ধরে লিখছেন, যা তাকে সাধারণ মান্যতায় পৌঁছে দিয়েছে। ‘আই হ্যাভ বিগান অ্যান এন্ডলেস পোয়েম, অফ নো নোন ক্যাটাগরি...অল অ্যাবাউট এভরিথিং, একটি চিঠিতে জেমস জয়েসকে লিখেছিলেন কবি এজরা পাউন্ড ১৯১৭ সালে তার বিখ্যাত ‘দ্য ক্যান্টোস’ প্রসঙ্গে। বারকাতও সেভাবেই অর্থনীতির পাশাপাশি ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতি, দর্শন, মানববিজ্ঞান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন অফুরান, এখনো লিখছেন নিরলসভাবে। উত্সুক পাঠকের সমগ্র মননকে আলোড়িত করার মতো তার সৃষ্টিধর্মী, অনুপমেয় লেখা, গবেষণাকর্ম অজস্র।

বারকাতের ভাবনার নিউক্লিয়াস ‘মানুষ’, প্রিয় বিষয়, আগ্রহের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র হলো জমি-জলা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য। দারিদ্র্য ও বৈষম্যের পলিটিক্যাল ইকোনমির গভীরে তার মতো চর্চা এদেশে করতে পারেন, পেরেছেন কজন? অতি সাধারণ মানুষ-মুটে, মজুর, কৃষাণ-কৃষাণী এমনকি পথের ভিখিরির সঙ্গেও তিনি অবলীলায় মিশে যান, কথা বলেন অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে। ক্ষুধার্ত, নিরন্ন ও আশ্রয়হীন মানুষকে কাছে টানেন পরম মমতায়। বারকাত এভাবেই ছুঁয়ে যেতে চেয়েছেন চিন্তার বিষয়বস্তুকে; অর্থনীতি, রাজনীতি, দেশ ও সমাজ নিয়ে তার বিচিত্র, অখণ্ড ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে নিজের নানা লেখায়, গ্রন্থে, অবিনাশী বক্তব্যে। তার সব কাজ, লেখা, চিন্তা ও মনন পরিচিত জীবনবৃত্ত ছেড়ে ছুঁয়ে যায় সামগ্রিক মানবজীবন।

বারকাতের দৃষ্টিকোণ এখন অনেক পরিণত, প্রসারিত। তার ক্যানভাসে চিত্রিত মানুষেরা কখনো বস্তির অন্ধকার জীবনে অভ্যস্ত, কখনোবা নিরন্ন-ভূমিহীন, প্রান্তীয়, ভূমির অধিকার নিয়ে লড়াকু আদিবাসী, কখনো রাস্তায় নেমে আসা আন্দোলনরত, স্লোগানমুখর পোশাককর্মী, চা-বাগানের উপেক্ষিত নারী শ্রমিক, নিভৃত কোনো বারবণিতা পল্লীর অপাপবিদ্ধা অসহায় শিশু-কিশোরী-নারী ‘ধ্রুপদী’ কিংবা বিপন্ন-বঞ্চিত, দলিত শ্রেণি। দেয়ালে সেই শেওলা ধরা-হাড়-পাঁজর ঘরবাড়ি ও এঁদো পুকুর পাড়ে যাদের বাস, সেই ছবি তিনি সযত্নে আঁকেন তার চেতনার ক্যানভাসে, সমাজ-দর্শন-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি নিয়ে লেখায়-বলায়, নিরলস গবেষণায় কত অনায়াস ভঙ্গিতে— বাস্তব দৃষ্টান্তে, উপমায়। সেই অর্থে, তিনি শুধু গবেষকই নন, এক সার্থক সমাজশিল্পীও।

এ চিরচেনা সমাজের আর দশজনের মতো ‘বারকাত’ এখন শুধু কোনো ব্যক্তি-মানুষের নাম নয়, প্রতীতির আলোয় তিনি এখন অন্যতর, সর্বজনীন। কল্যাণময় দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই তিনি আজ পরিশীলিত সত্যের, মানবতার মূর্ত প্রতীক। তার মতে, আদিবাসীদের মূলধারায় আনতে হবে। তিনি এদেশের আদিবাসীর ভূমি-অধিকার নিয়ে মানবিক কথা বলেন, লিখেন, গবেষণা করেন। ভূমির এ জ্যামিতিক পথে চলতে চলতে তিনি কুড়িয়ে নেন তাদের নিজস্ব অর্থনীতি, তুলে নেন সমাজ, সংগ্রহ করেন সংস্কৃতি, বেছে নেন রাজনীতি, মেলে ধরেন এক সমৃদ্ধ ইতিহাস।

আজকে এ দেশের সমাজ-অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বাস্তবতায় হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ‘অর্পিত সম্পত্তি’, কিংবা অন্যত্র ‘খাসজমি’, ‘ভূমি মামলার রাজনৈতিক অর্থনীতি’ প্রসঙ্গে বারকাতের যুগান্তকারী গবেষণাকর্ম আমাদের ভাবনার জগেক সমৃদ্ধ, এনলাইটেন্ড করে, সত্য ও বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে শেখায়।

‘মৌলবাদের অর্থনীতি’ বিষয়ে তার সাম্প্রতিক গবেষণাকর্ম, নিরপেক্ষভাবে বলা যায়, শুধু এ শতকে নয়, আগামী কয়েক শতকেও আমাদের চিন্তার জগেক আচ্ছন্ন করে রাখবে। চলমান এ গবেষণায় তার প্রতিস্পর্ধী জিজ্ঞাসার মানবিক অন্বেষণে এ নতুনতর চিন্তার উন্মেষ মৌলবাদের ভয়াবহতা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে তোলে। মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ নিয়ে তার সাম্প্রতিক লেখাগুলো অন্য অর্থে, বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের উেসর সন্ধানে এক বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণী প্রয়াস। বারকাতের অজস্র মননশীল গবেষণায়, উপস্থাপিত ধারণায় ‘মাস্টার কনসেপ্ট’ হলো ‘ফ্রিডম মেডিয়েটেড ডেভেলপমেন্ট’, ‘দারিদ্র্য’ ও ‘বৈষম্য’। শিশু-নারী-পুরুষ, এমনকি পরিণত মানুষকেও এ ঘুণেধরা সমাজ-সভ্যতা ও রাষ্ট্রের অনভিপ্রেত স্রোতের বিপরীতে এনে দাঁড় করিয়েছেন, সাহসী হতে প্রেরণা জুগিয়েছেন তিনি। ক্ষুধার রাজনীতি, ক্ষুধা দিয়ে স্বার্থনিবৃত্তি এসবই ভাবিত করে তাকে।

স্বদেশ ভাবনায় বারকাত এদেশে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। কাস্ট্রো, চে’, মার্টিন লুথার, গান্ধী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক সূর্যসেন, প্রীতিলতা, বিনয়-বাদল-দীনেশ-ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকীসহ অনেকের সুমহান আত্মত্যাগ এবং একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রাম তার স্বদেশ ভাবনাকে পরিপুষ্ট করেছিল। এককালে শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, চিন্তায় ও মননে বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা তাকে অনুপ্রাণিত করে। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দর্শন তিনি পড়েছেন, উপলব্ধি করেছেন। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-রামমোহন রায়, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বোস প্রমুখের জীবনাদর্শে আপ্লুত হয়েছেন, পড়েছেন আইনস্টাইন-সত্যেন বোসের কোয়ান্টাম তত্ত্ব, ঋষি অরবিন্দের এপিক ‘সাবিত্রী’। বারকাতের জ্ঞান-ঐশ্বর্য, গৌরব সেখানেই।

আশৈশব সমাজ-সচেতন বারকাত অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন, সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। দেশ সা্বাধীন হবে, এই স্বপ্ন ছিল তার। দেশের প্রতি অপরিসীম মমতা, সাধারণ মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও নতুন সমাজ নির্মাণের ভাবনা এ মেধাবী মানুষটিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছিল।

সমাজ ও সংস্কৃতির নিবিড় অন্তর্লোকের উজ্জ্বল অনুসন্ধানে যারা নিরলস ব্যাপৃত, সেসব বিরল ব্যক্তিত্বের মধ্যে বারকাত অন্যতম। স্থৈর্যে-ধৈর্যে-প্রজ্ঞায় অনেক পরিণত এখন তিনি; আদর্শ অন্যের, নব প্রজন্মের। নিজের প্রতিটি লেখায়, কথায় সময়ের স্বর এবং সময়ের ভিতর কথা বা অন্তঃস্বরের বুনোট খোঁজেন লেখক-গবেষক বারকাত। বোধ করি, এভাবেই একসময় তিনি হয়ে উঠবেন অনন্যসাধারণ, আমাদের গৌরবময় উত্তরাধিকার।

রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠার কোনো অভিপ্রায় নেই। রাজনীতি নয়, তার সব অ্যামবিশন ‘মানুষ’-কে ঘিরে। কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রশ্নাতীত। তাকে নিয়ে সাধারণ মানুষের, নতুন প্রজন্মের কৌতূহল অপরিসীম। বিদগ্ধ অধ্যাপক বারকাত অন্তত তিন দশক ধরে বাঙালির সুস্থ শিল্পবোধ ও সাংস্কৃতিক চেতনার সহমর্মী। এ অসুস্থ, রুগ্ণ, সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির পরিচিত বৃত্তের বাইরে তিনি নিজেই এক আশ্চর্য প্রতিরোধ। বলতে দ্বিধা নেই, পূর্ণতায়, অনুধ্যানে এক আশ্চর্য দ্যুতিময় বারকাতের চেতনার ‘ক্রিয়েটিভ সার্কিট’। তার গবেষককৃতী কতটা ঋদ্ধ, সুসংস্কৃত করবে আমাদের, সময়ই তা বলে দেবে। বারকাতের জীবন, কর্ম ও তার সমকাল নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, আগামীতেও লিখবেন। এর কোনটি শেষ গ্রাহ্য ও প্রণিধানযোগ্য সময় বলে দেবে।

সজ্জন, জ্ঞানদীপ্ত বারকাত আমাদের অভিভাবক, পথপ্রদর্শক। আমাদের কাছে, তরুণ প্রজন্মের সামনে তিনি এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত, এ জন্যই যে, তার ভাণ্ডারে রয়েছে চার দশক ধরে অর্জিত এক বিপুল কর্ম-সংস্কৃতি— যা অনেকের কাছে ঈর্ষণীয়, আবার বহুজনের অনুসরণীয়।  এদেশে একুশ শতকের বাঙালি তার যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠুক, সেটিই সবার প্রত্যাশা তার এ শুভ জন্মদিনে। তাকে  শ্রদ্ধাঞ্জলি, অভিষিক্ত হোন তিনি আমাদের হিরণ্ময় ভালোবাসায়, দীর্ঘ জীবনের মঙ্গলময়তায়।

লেখক : সিনিয়র রিসার্চ কনসালটেন্ট, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর