শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

শারদীয় উৎসব উপলক্ষে প্রয়োজনীয় কিছু কথা

নকুল চন্দ্র সাহা

শারদীয় উৎসব উপলক্ষে প্রয়োজনীয় কিছু কথা

এক সাগর রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের যুক্তিসংগত কারণেই কোনো সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো, বহু কাঙ্ক্ষিত আশা-স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত হওয়ায় নানামুখী সমস্যার সাগরে তারা হাবুডুবু খাচ্ছে। তাই সংগত কারণেই এখন সময় এসেছে, তাদের সমস্যাগুলো আজ জোরালো ও স্পষ্টভাবে জাতির সামনে তুলে ধরা। এ ব্যাপারে অবশ্য হিন্দু সংগঠনগুলো মোটামুটিভাবে একই চিন্তাধারায় আবর্তিত হচ্ছে বলে মনে হয়। সেই আলোকে আমি উদ্ভূত মূল কিছু সমস্যার ওপর আলোকপাত করব। এ নিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কিছু বিচ্ছিন্ন মন্তব্য নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করতে চাই।

প্রয়াত একজন হিন্দু ভদ্রলোক। একটি বেসরকারি সংস্থায় বেশ কয়েক হাজার টাকার বেতনে একজন বড় চাকরিজীবী ছিলেন। চাকরির সুবাদে বাড়ি-গাড়ির সুবিধাও তার ছিল। এক অনুষ্ঠানে তার কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত আসন সম্পর্কিত ইদানীং যেসব কথাবার্তা হচ্ছে সে ব্যাপারে কী ভাবছেন? কথা শুনেই ভদ্রলোক একেবারে আঁতকে উঠলেন। অনেকটা চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। ভ্রূ কুঁচকে বলে ফেললেন, ‘বলেন কী! এটা নিঃসন্দেহে একটি প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা। আমরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। এখানে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু প্রশ্ন কেন আসে? মূল স্রোতের সঙ্গে মিলেমিশে না থাকলে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। কাজেই এসব কথা কখনো মুখে আনবেন না।’ ওই সময়ের আরেকজন নামিদামি হিন্দু নেতা। নামডাক তার কম ছিল না। পত্র-পত্রিকায় তার ছবি-বক্তৃতাও ছাপা হতো। সংসদ সদস্যও ছিলেন। পেশা ছিল কিন্তু সেই পেশায় তেমন নিয়োজিত ছিলেন না। তবুও তিনি ভালো ছিলেন, সুখেই ছিলেন। বাড়ি-গাড়িসহ অনেক সহায়-সম্পত্তির মালিকও ছিলেন। আমার উত্থাপিত প্রশ্নটি নিয়ে তিনিও অনেকটা ক্ষেপেই গেলেন। আরেক ধাপ এগিয়ে বলে ফেললেন, ‘এসব মৌলবাদী চিন্তাভাবনা।’ গণতান্ত্রিক শক্তিকে দুর্বল করে স্বাধীনতার চেতনাকে ভোঁতা করার একটা ষড়যন্ত্র মাত্র। তৎকালীন সরকারপন্থি স্বঘোষিত আরেকজন হিন্দু নেতার কথা। দু-এক জন হিন্দু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রমোশন হওয়ার জন্য খুশিতে গদগদ হয়ে যা বললেন তার অর্থ দাঁড়ায়— হিন্দু সম্প্রদায়ের সব সমস্যারই বুঝি সমাধান হয়ে গেছে। উপরোল্লিখিত আজ্ঞাবহ, স্বার্থপর তিনজন ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনায় আমার যতটুকু বোধগম্য হয়েছে তা হলো, দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের মূল সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই বললেই চলে, বরং আপত্তি আছে। কারণ তারা ভালো আছেন, আবার কেউ আছেন বিভিন্ন মোহে আচ্ছন্ন হয়ে। কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হলো, লাখ লাখ ভুক্তভোগী লোকের মধ্যে হাতে গোনা দু-এক জন হিন্দুর কথা বাদ দিলে বাদবাকি হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের বহুমুখী সমস্যার কোনো সমাধান না হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ, হতাশা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও অব্যক্ত যন্ত্রণা-বেদনার মাঝ দিয়ে কালাতিক্রম করছেন। এমনকি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেক সদস্য পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের সমস্যাগুলো সমাধানে আন্তরিকতা ও প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করে আসছেন।

আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মূল সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যা দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সমস্যা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন নয়। কিন্তু সমস্যার বৈশিষ্ট্যগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। অমানবিক, সাম্প্রদায়িক অর্পিত সম্পত্তি আইনের কথা ধরা যাক। এই আইনকে ইতিমধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা কালো আইন হিসেবে অভিহিত করেছেন। এর ফলে সৃষ্ট সমস্যাটা অর্থনৈতিক। আবার অর্থনৈতিক সংকটাপন্ন এ দেশে সামাজিক কিছু সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে আজ কয়েক লাখ হিন্দু পরিবার এই আইনের জাঁতাকলে পিষ্ট। প্রায় ৩০ লক্ষাধিক একর সম্পত্তি আজ অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তির তালিকাভুক্ত। এ সমস্যা আজকে সৃষ্টি হয়নি। এর সূচনা প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান সরকারের আমলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে হলেও, কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা-উত্তর ক্ষমতাসীন বিভিন্ন সরকারের সময়েও এই অভিশপ্ত আইনের থাবা থেকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় রেহাই পায়নি। অগণতান্ত্রিক পাকিস্তানি সরকারের প্রণীত আইন ও অনুসৃত নীতির ধারাবাহিকতাই এখনো প্রকারান্তরে রক্ষা করা হচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগের সুযোগও অবহেলা-অবজ্ঞার শিকার হয়ে আসছে সেই আমল থেকে। বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও সংসদে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্বের কথা সব আমলে বলা হচ্ছে। কিন্তু কোথাও হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে করা হয়নি, অর্থাৎ হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব একেবারেই অনুপস্থিত। অবশ্য এসব প্রশ্ন উত্থাপিত হতো না যদি এসব জায়গা থেকে তাদের সমস্যা সংকট, সুখ-দুঃখের কথা জোরালোভাবে তুলে ধরা হতো।

এবার আমি অর্পিত সম্পত্তি আইন নিয়ে আলোচনার গভীরে যেতে চাই। অর্পিত সম্পত্তি আইনটি হচ্ছে পাকিস্তান আমলে সৃষ্ট ‘শত্রু সম্পত্তি অর্ডিন্যান্সের’ আইনগত রূপ। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তথাকথিত পাক সরকার এই জঘন্য কাজটি করে। ৬ সেপ্টেম্বর জারি করা হয় ‘ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস-১৯৬৫’। এরই সঙ্গে জারি হয় ‘শত্রু সম্পত্তি আদেশ-১৯৬৫’। পরে জরুরি আইন, ডিফেন্স অব পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স ও ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস প্রত্যাহূত হলেও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শত্রু সম্পত্তি আদেশ প্রত্যাহার করা থেকে পাকিস্তান সরকার বিরত থাকে এবং আদেশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার অশুভ উদ্দেশ্যে ১৯৬৯ সালে জারি করা হয় ‘শত্রু সম্পত্তি অর্ডিন্যান্স-১’।

এরপর ১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশমাতৃকার গগনে উদিত হয় স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পরে দেশের অনেক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটলেও, অমানবিক ও সাম্প্রদায়িক শত্রু সম্পত্তি অর্ডিন্যান্সের কোনো পরিবর্তন হয়নি। অথচ আশা করা গিয়েছিল, পাকিস্তান আমলের হতভাগ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাগ্যে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এ প্রত্যাশার পেছনে অবশ্য যুক্তিসংগত কারণ ছিল। ’৬৫ সালের যুদ্ধের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অংশে বসবাসরত হিন্দু জনগোষ্ঠী বিশেষ এক রাজনৈতিক দলকে তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ও আশা-ভরসার স্থল হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে। হিন্দুদের ব্যাপক সমর্থনে ওই দলটি ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হলো। অথচ কী আশ্চর্য! যারা এ দলটিকে বিজয়মাল্য উপহার দিল, তাদের সম্প্রদায়ের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট দলের হয়ে সংখ্যানুপাতে বিজয়ী হতে পারল না। ৩০০ আসনের সংসদ নির্বাচনে ১২-১৩ জনের বেশি হিন্দু প্রার্থী মনোনয়নও পায়নি কোনোবার। অথচ জনসংখ্যা অনুপাতে কমপক্ষে ৩০-৪০ জন হিন্দু প্রার্থীর মনোনয়ন পাওয়ার কথা। অন্যান্য ক্ষেত্রেও একই চিত্র। স্বাধীনতার পর শত্রু সম্পত্তি অর্ডিন্যান্সটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা না হয়ে ’৭২ সালে তা পুনরুজ্জীবিত হয়। ’৭৪ সালে তা ধারণ করে এক ভয়াবহ রূপ। ১ জুলাই শত্রু সম্পত্তি অর্ডিন্যান্সটিকে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে সংসদে পাস করিয়ে নেওয়া হয়। সংসদে ছাড়া এ ব্যবস্থা রহিত করার সব দ্বার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই কালো আইনের জাঁতাকলে পিষ্ট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম অংশ। হিন্দু জনগোষ্ঠী স্বার্থান্বেষী মহলের লোভ-লালসা আর তহসিল অফিসের একশ্রেণির অসাধু কর্মচারীর লাল কালির আঁচড়ে হারাচ্ছে তাদের পৈতৃক সম্পত্তি এমনকি পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি। শত্রু সম্পত্তির তালিকাভুক্ত প্রায় ৩০ লাখ একর জমিজমা অর্পিত সম্পত্তি আইনের নামে বহাল রাখা হয়। বর্তমানে অর্পিত সম্পত্তি আইনে তালিকাভুক্ত সম্পত্তির মধ্য থেকে ‘খ’ তফসিলভুক্ত সম্পত্তি অবমুক্তির আইন পাস হলেও তার সুফল পেতে ভুক্তভোগীরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হিমশিম খাচ্ছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাস্তব কারণে অনগ্রসর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ খুবই সীমিত। তাদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকা বাঞ্ছনীয়। আমাদের সংবিধানও এমন অবস্থা অনুমোদন করে। সংবিধানে ২৯ ধারায় ৩ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নাগরিকের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে তাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন হতে এই অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকার কোনো কিছু রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করবে না।’ আমার ধারণা, সংরক্ষিত আসন প্রবর্তন, অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল ও রমনা কালীমন্দির উদ্ধারে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সমর্থন এবং সহযোগিতাদানে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ও এগিয়ে আসবে। বাধা আসবেই। এই বাধা কেবল মৌলবাদবিশ্বাসী সদস্যদের মধ্য থেকে নয়, হিন্দুদের মধ্যে উপরোল্লিখিত ও আলোচিত মুষ্টিমেয়, সুবিধাভোগী, স্বার্থবাজ ও মোহাবিষ্ট কিছু ব্যক্তি স্বার্থহানির ভয়ে বিরোধিতা করবে। সমগ্র হিন্দু সমাজ ও সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থহীন বিবেকবান অংশের সমর্থনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওই তিনটি দাবি অদূর ভবিষ্যতে আদায় হবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : আহ্বায়ক : শ্রীকৃষ্ণ সেবা সংঘ।

সর্বশেষ খবর