রবিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রবীণদের সঙ্গে নিয়েই হোক আমাদের অগ্রযাত্রা

ড. এ এস এম আতীকুর রহমান

প্রবীণদের সঙ্গে নিয়েই হোক আমাদের অগ্রযাত্রা

জাতিসংঘের আহ্বানে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর ১ অক্টোবর বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় এবং গুরুত্বের সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ বছর ২৭তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে—Stepping into the Future : Tapping the Talents, Contributions and Participation of Older Persons in Society.  অর্থাৎ, বিশ্ববাসীর একান্ত স্বার্থে ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় প্রবীণজনের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, নৈপুণ্য এবং অবদানের গুরুত্ব দেওয়া এবং উন্নয়ন উদ্যোগে তাদের জড়িত করা খুবই জরুরি। এক কথায়, আগামীর পথে, প্রবীণের সঙ্গে। অধিকার এবং মর্যাদার ভিত্তিতে বিশ্ববাসীর সবাইকে নিয়ে বাসযোগ্য বিশ্বসমাজ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যেই জাতিসংঘের এই উদাত্ত আহ্বান। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই প্রতিপাদ্যের মাহাত্ম্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

দুনিয়াজুড়ে প্রবীণ (৬০ বা তদূর্ধ্ব বছর বয়সী) জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ১৯৯০ সালের ৫০ কোটি বিশ্ব-প্রবীণ জনসংখ্যা ২০১৫ সালে বেড়ে হয়েছে ৯০ কোটি। ২০৩০ এদের সংখ্যা হবে ১৪০ কোটি এবং ২০৫০ সালে ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে! বাংলাদেশে বর্তমানে বসবাস করছেন প্রায় ১.৪০ কোটি প্রবীণ। ২০২৫, ২০৫০ এবং ২০৬১ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে প্রায় ২ কোটি, ৪.৫ কোটি এবং ৫.৫ কোটিতে! কিন্তু ক্রমবর্ধমান বার্ধক্য মোকাবিলা করার মতো দরকারি প্রস্তুতি যেমন বাংলাদেশের নেই, তেমনি বাংলাদেশিরাও তাদের ব্যক্তিগত বার্ধক্য মোকাবিলায় প্রস্তুত নয়। এশীয়, ভারতীয়, মুসলিম এবং বাঙালি সংস্কৃতির সংমিশ্রণে, পরিবারে রেখে মুরব্বিদের দেখভাল করাই আমাদের রীতি। কিন্তু বাস্তব নানা কারণে এর মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটছে।

আমাদের প্রবীণরা আজ ভালো নেই। তাদের অনেকে নিজেদের বাড়িতেই বিভিন্ন নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের সম্মুখীন। সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে প্রবীণদের প্রতি দুর্ব্যবহার ও নির্যাতনের মাত্রাও বেড়ে চলেছে। বিষয়টি আজ একটি বৈশ্বিক সামাজিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। অবাক ব্যাপার হলো, প্রবীণদের সঙ্গে হরহামেশা সংঘটিত হওয়া এ ধরনের দুর্ব্যবহার বা নিপীড়নকে সমাজের অন্যরা মামুলি, গুরুত্বহীন, ব্যক্তিগত এবং এমনকি নিয়তির স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করেন! এ ব্যাপারে সবার সতর্ক হওয়া খুবই প্রয়োজন।

দেশের বিরাট আকারের প্রবীণদের বাস্তব কল্যাণ বিধানে প্রবীণদরদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ, অবদান এবং সাফল্য অত্যন্ত উজ্জ্বল। ১৯৯৭ সালে যুগান্তকারী বয়স্কভাতা কর্মসূচি প্রচলন, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ ও পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯/৬০ করা, পেনশন সুবিধা সম্প্রসারণ, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের মাধ্যমে প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে অনুদান বৃদ্ধি করাসহ প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠনের উদ্যোগ প্রবীণ কল্যাণ কাজে তার দূরদর্শী পদক্ষেপ। 

দেশের চলমান শিক্ষা পাঠ্যসূচি, গণমাধ্যম কর্মসূচি কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসূচিতে বার্ধক্য ও প্রবীণকল্যাণ বিষয়ে নেই তেমন কোনো সাড়াশব্দ। সময় থাকতে এখনই আমাদের সাবধান এবং উদ্যোগী হওয়া জরুরি। কেননা বার্ধক্য হচ্ছে প্রতিটি মানুষের অবধারিত সমস্যা। আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ। তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রবীণদের দেখভাল করতে হবে আর নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। দয়া-দাক্ষিণ্য বা করুণার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া-পাওয়ার সমাধান করা প্রয়োজন। এ জন্য দরকার গণসচেতনতা। আর এই গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রবীণদের প্রতি অবহেলা, অযত্ন, দুর্ব্যবহার আর নির্যাতনের ঘটনা এবং সবার করণীয় বিষয়গুলো দেশের সব শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে এবং গণমাধ্যম কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে প্রবীণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হবে। বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের প্রবীণদের তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন— তরুণ-প্রবীণ (৬০-৭০ বছর বয়সী), মধ্যম-প্রবীণ (৭০-৮০ বছর বয়সী) এবং অতি-প্রবীণদের (৮০ বা তদূর্ধ্ব বছর বয়সী)। এদের অবস্থা, সমস্যা, চাহিদা, সামর্থ্য ইত্যাদি আলাদা-আলাদাভাবে বিবেচনা করে সে অনুযায়ী তাদের প্রতি যত্নবান হতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশিদের গড় আয়ু প্রায় ৭১ বছর আর অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯ বছর। সাধারণত প্রবীণদের অথর্ব বা মূল্যহীন বলে অবহেলা না করে দেশের বিরাটসংখ্যক জ্ঞানী, দক্ষ এবং অভিজ্ঞ প্রবীণদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন। বয়স্ক বলে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা না করে দেশের ছোট-বড় নানা ধরনের সেবাদান কাজে নিয়োজিত প্রবীণদের কাছ থেকে সেবা গ্রহণ করা যেতে পারে। সামর্থ্যবান প্রবীণদের জন্য সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা, সাহচর্য, স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তাপূর্ণ বিভিন্ন ধরনের প্রবীণনিবাস ও প্রবীণ সেবাকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে বিরাটসংখ্যক প্রবীণের বাসস্থান চিন্তা দূর হবে। প্রবীণ নারী, অটিস্টিক, প্রতিবন্ধী, অসুস্থ, হতদরিদ্র, আদিবাসী এবং সমাজবিচ্ছিন্ন প্রবীণদের অবস্থা ও চাহিদা বিশেষভাবে বিবেচনায় এনে সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগে নিরাপদ আবাসন তৈরি এবং লাগসই সেবার ব্যবস্থা করা বর্তমানে জরুরি হয়ে পড়েছে।

পীড়াদায়ক আচরণ করা থেকে বিরত রেখে প্রবীণদের পারিবারিক আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংশ্লিষ্ট রাখা যেতে পারে। বয়সের ভারে রোগে-শোকে আক্রান্ত প্রবীণকে কষ্টসাধ্য উপার্জন কাজে নিয়োজিত করা যেমন, সম্পদ ও বাড়িঘর পাহারা দেওয়া, বাজার করা, রান্না করা, শিশুদের দেখভাল ও স্কুলে আনা-নেওয়া করা ইত্যাদি সাংসারিক কাজে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্দয়ভাবে ব্যবহার করা কোনোক্রমে সমীচীন নয়। জীবিত প্রবীণ পিতা-মাতার কাছ থেকে জোরজবরদস্তি করে তাদের নিজস্ব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে অনৈতিক এবং অমানবিক আচরণ। এমনকি দেনমোহরের অর্থসহ প্রবীণ মা-বোনের প্রাপ্য উত্তরাধিকার সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য মানবিক আচরণ নয়। এসব কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা।

প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া, প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য, খাদ্য, পোশাক ইত্যাদি সরবরাহ করা এবং কাঙ্ক্ষিত সঙ্গ দেওয়া জরুরি। বাড়ির বারান্দায়, চিলেকোঠায়, খুপরিঘর বা গোয়ালঘরে তাদের রাখার কথা চিন্তা না করে বরং স্টোররুম, বেবিরুম, সার্ভেন্টস রুম তৈরির আগে প্রতিটি বাসা/ফ্ল্যাটে পিতা-মাতার জন্য প্যারেন্টস রুমের ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। গণসেবা প্রাপ্তিতে, নানা স্থানে চলাচলে, সড়ক পারাপারে, যানবাহনের আসন পেতে এবং বিপদাপন্ন প্রবীণের যে কোনো সহায়তায় বলিষ্ঠ ও ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রবীণদের প্রতি অন্যায় আচরণ সংঘটিত হতে দেখলে তাত্ক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ করতে হবে এবং প্রতিবিধানের জোরালো ব্যবস্থা নিতে হবে।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন প্রবীণদের কল্যাণে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু অর্থ, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ, শিক্ষা, তথ্য, ধর্ম, স্থানীয় সরকার, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়গুলোকে বার্ধক্য কল্যাণ বিষয়ে দায়িত্বশীল এবং সক্রিয় করা এখন সময়ের দাবি। দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর নানা দিকের ওপর নিয়মিত গবেষণা কাজ পরিচালনা করে একটি জাতীয় ডাটাবেজ তৈরি করা প্রয়োজন। এ ছাড়া, জাতিসংঘে প্রবীণবিষয়ক স্বতন্ত্র একটি বিশেষায়িত সংস্থা গঠন করার জন্য সরকারকে প্রস্তাবনা দিতে হবে। প্রবীণকল্যাণ বিষয়ক স্বতন্ত্র একটি মন্ত্রণালয় স্থাপন করা এবং প্রণয়নাধীন প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইন পাস করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য প্রবীণবান্ধব বর্তমান সরকারের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। পাশাপাশি, প্রবীণ নারী, প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক, সমাজ বিচ্ছিন্ন ইত্যাদি শ্রেণির প্রবীণদের জন্য বিশেষ সেবা ব্যবস্থার আয়োজন করা খুবই প্রয়োজন। সচ্ছল প্রবীণদের জন্য সুবাসযোগ্য আবাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে আবাসন শিল্প এবং বার্ধক্য বীমা চালুর জন্য অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হতে অনুরোধ জানাচ্ছি।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উত্কর্ষে এসেও বিশ্ব সমাজে মানুষ যেন শান্তিতে নেই, স্বস্তিতে নেই, সুরক্ষায় নেই! বিশ্ববাসীর গৌরবোজ্জ্বল পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বস্ততা, অধিকার, পরমতসহিষ্ণুতা, ধৈর্য-সহ্য ইত্যাদি মানবিক গুণাবলী ক্রমশ যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে! সার্বভৌমত্ব, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের কথা উচ্চারণ করলেও লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, প্রতিবন্ধিতা, অবস্থান ইত্যাদিই যেন সদা-সর্বত্র ক্ষমতাবানদের বিবেচ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে! এতে করে প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, দুস্থ নারী ও শিশু, সংখ্যালঘু আর হতদরিদ্ররা ক্রমেই ভীষণ অসহায় এবং অতি ঝুঁকিতে পতিত হচ্ছেন।  অবস্থার উন্নয়নে সুদীর্ঘ দিনের নির্মোহ অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রবীণরাই আমাদের পথের দিশা দেখাতে পারেন।  সঙ্গত যুক্তিতে বলা হয়, ‘প্রবীণের যুক্তি আর নবীনের শক্তি, এই দুয়ে মিলে সমাজের মুক্তি’।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মহাসচিব, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ।

সর্বশেষ খবর