মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আমরা কবে আমাদের সম্মানের দিকে নজর দেব

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

আমরা কবে আমাদের সম্মানের দিকে নজর দেব

মাত্র দুুই দিন হলো চ্যানেল আই ১৯-এ পা দিল, সাবালক হলো। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে চ্যানেলের এক মহাবিপ্লব ঘটে গেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রসারে দেশের মানুষ যেমন অলিগলিতে কোথায় কী ঘটছে খুব সহজে সচিত্র প্রতিবেদন দেখতে পাচ্ছে, আবার চ্যানেলের কারণে কিছু কিছু লোক আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। আগে জমিদাররা লাঠিয়াল পুষত। এখন ক্ষমতাবান সম্পদশালীদের লাঠিয়াল পুষতে হয় না। ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট মিডিয়ার বর্ম থাকলেই চলে। এর পরও সাধারণ মানুষ মিডিয়ার দ্বারা উপকৃত হয়। ইংরেজ সাংবাদিক সায়মন ড্রিংকে ১৬ ডিসেম্বর, ’৭১ তেজগাঁও বিমানবন্দরে প্রথম দেখেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের ওপর খবরাখবর প্রচার করে তিনি খুব নাম করেছেন। আমার টাঙ্গাইলের বাড়িতেও বেশ কয়েকবার গেছেন। ঢাকার বাবর রোডে যখন উঠি তখন তিনি বাবর রোডেও এসেছেন। বিটিভির সম্প্রচার সুবিধা নিয়ে সারা দেশে একুশে টিভি এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল। যদিও পরে আর সে সুবিধা তারা পায়নি।

হঠাৎই একদিন শুনলাম একুশে টিভির চেয়ারম্যান আবদুস সালাম। সালামের বাবা করিম মাস্টার টাঙ্গাইল সদরের শাহজানী স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। একেবারে ভাঙাচোরা, বেড়া ছাড়া টিনের ঘরের স্কুল। টাঙ্গাইলের মূল ভূখণ্ড থেকে ৪-৫ মাইল যমুনা নদীর ভিতরে। খুবই দুর্গম। যে কারণে মেজর মাইনুদ্দিনের নেতৃত্বে সেখানে কাদেরিয়া বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প করা হয়েছিল। তাতে টাঙ্গাইলের পশ্চিম এবং সিরাজগঞ্জ, পাবনার পূর্বাঞ্চলের যুবকরা ভারতে না নিয়ে সেখানেই প্রশিক্ষণ নিয়েছে। সেই সময় জনাব করিম মাস্টার শাহজানী ইউনিয়ন কাদেরিয়া বাহিনীর স্বেচ্ছাসেবক কমান্ডার ছিলেন। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন। তখন সালাম ফাইভ-সিক্সের ছাত্র। স্বাধীনতার পর আমার বাড়ির আশপাশ দিয়ে হাফপ্যান্ট পরে লোহার চাকা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করত। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধে বিদেশ-বিভূঁইয়ে অনেক দিন কেটে যায়। দেশে ফিরে শুনলাম সালাম জার্মানি গিয়ে সেখানে এক মেয়েকে বিয়ে করে বেশ বড়সড় ধনী হয়েছে। শ্রমিকনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা হবিবুর রহমান হবি মিয়ার ছেলে লুত্ফর রহমান খান আজাদ। দেখতে-শুনতে ভালো। সেও জার্মানি গিয়েছিল। সেও এক জার্মান মেয়ে বিয়ে করে বেশ টাকা-পয়সার মুখ দেখেছে। সালামের চেয়ে লুত্ফর দু-তিন বছরের বড় হবে। প্রথম দিকে আমার বাসায় থেকেই সে ঢাকা কলেজে পড়ত। অনেক সময় পার হয়ে গেছে। অনেক কিছুই অনেকের মনে নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার কেন যেন কিছুই ভুলতে পারি না। না বঙ্গবন্ধুকে, না তার খুনিদের। কীভাবে কীভাবে সায়মন ড্রিং একুশে টিভি স্থাপন করেছিলেন। তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল কিনা জানি না। কুয়োর ব্যাঙ জাহাজের খবর রাখি না, তাই ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। হঠাৎই একদিন শুনলাম সালাম একুশে টিভির চেয়ারম্যান বা মালিক। বিএনপির সময় চ্যানেলটা বন্ধ এবং বিটিভির চুক্তি বাতিল করে দিয়েছিল। হঠাৎই একদিন বিশাল মার্সিডিজে সালাম এসে হাজির। তার আগে সালামের বাপ-দাদার পরিচয় জানতাম না। আর স্বাধীনতার পর অনেক টাকা রোজগারের আশায় সালামের বাবা খুলনায় গিয়েছিলেন। সেখানে অনেক টাকা রোজগারও করেছিলেন, আরেকটা বিয়ে করে সেখানেই ঘর-সংসার করেছিলেন। যে কারণে সালামদের সঙ্গে আর তেমন যোগাযোগ ছিল না। সালামের কাছে যখন তার বাবার পরিচয় পেলাম খুবই ভালো লেগেছিল। কারণ লোকটি ভালো ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অনেক ভালো কাজ করেছিলেন। সালামের জন্য কী করতে পারি। তার ধারণা আমি সব পারি। ইটিভি বন্ধ করে অবাধ তথ্যপ্রাপ্তি থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা হচ্ছে— এ বিষয়ে দু-তিন বার জনগুরুত্বপূর্ণ ৭১ বিধিতে নোটিস দিয়েছিলাম। মনে হয় একবার গৃহীতও হয়েছিল। অন্য দুবারও মাননীয় স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার আলোচনার সুযোগ দিয়েছিলেন। কোর্ট-কাচারির জন্য প্রবীণ আইনবিদ অন্যতম সংবিধানপ্রণেতা ড. কামাল হোসেনের সাহায্য দরকার। সে ব্যবস্থাও করেছিলাম। তারপর যথারীতি একসময় অন্যদের মতো নির্বিঘ্নে একুশে টিভি চলছিল। তারপর দু-এক বার দেখা হয়েছে। ভাবে মনে হয়েছে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার ওপর কোনো সভা থাকলে তারও উপরে তার স্থান। আমার প্রিয় বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার আপন ভাইয়ের বড় ভাই। অতিরিক্ত কোনো কিছুই আমার কাছে ভালো লাগে না। তাই সালামের ব্যাপারেও ভালো লাগেনি। একুশে টিভির গাড়ি র্যাংগসের কারখানায় আটকে ছিল তা ছাড়িয়ে দেওয়া, ৪০০ কোটি টাকার গাজীপুরে ওষুধের কারখানায় সমস্যা তার সমাধান। যারা কোটি কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তারা গোলমালও করেন। হঠাৎ কদিন আগে শুনলাম সালাম কারাগারে। সরকারের সঙ্গে যুক্ত কে একজন একুশে টিভি দখল করেছে।

শুরু করেছিলাম চ্যানেল আইয়ের জন্মতিথি নিয়ে। হঠাৎই অন্যদিকে চলে গিয়েছি। শাইখ সিরাজকে আগে জানতাম না, এখনো জানি না। কৃষি বিষয়ে ভালো অনুষ্ঠান করেন। ফরিদুর রেজা সাগরকে বহু আগে থেকে চিনি। এখন ওরা বড় হয়েছে। কিন্তু আমি যখন বড় ছিলাম, তখন ইমদাদুল হক মিলন, বিখ্যাত শিল্পী আফজাল, সাগর ওরা ছোট বোন শুশুর সঙ্গে পড়ত। সাগরকে সেই থেকেই চিনি। ’৯০-এ সাগর যখন আজকের কাগজে কাজ করত তখন ওদের অফিসে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। আগাগোড়াই পাগলের মতো ভালোবাসে। কেউ ভালোবাসলে তাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। তাই আমিও ওকে খুব ভালোবাসি। পয়লা অক্টোবর আশুরার দিন বেশ কিছুক্ষণ চ্যানেল আইয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান দেখেছি। ভালো লাগেনি। যেভাবে লাইন দিয়ে দেশের নামিদামি লোকজন দাঁড়িয়ে ছিলেন আমার কাছে অনেকটাই দৃষ্টিকটু লেগেছে। কোথায় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ, বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলক আ স ম আবদুর রব আর ডানে-বাঁয়ে ছায়ারা। নিশ্চয়ই একটি ইলেকট্রনিক মাধ্যমের গুরুত্ব থাকবে। কিন্তু দেশের মর্যাদাবান এত মানুষ যদি হুমড়ি খেয়ে পড়েন তাহলে তাদের পাওয়ার বাড়ে, মানুষের ক্ষতি হয়। হয়তো আমার সঙ্গে অনেকে একমত হবেন না; কিন্তু এটাই আমার মত। শিল্পী-সাহিত্যিকরা ও ধরনের মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করলে খুশি হতাম।

বছর পঁচিশ আগে এমন এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। খুব সম্ভবত আজকের কাগজের সম্পাদক কর্নেল শাহেদ আহমেদের বাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভদ্রলোক পাকিস্তানে ছিলেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আনুকূল্যে বিপুল সম্পদের মালিক। তার এক ভাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। সেই শহীদ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে ধানমন্ডির বিশাল বাড়িতে পার্টি দিয়েছিলেন। সেখানে যত পানি খরচ হয়েছিল তার দ্বিগুণ-তিন গুণ নিষিদ্ধ পানীয় ব্যবহার হয়েছিল। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক কেউ বাদ ছিলেন না হাজিরা দিতে। তখনো কবি সৈয়দ শামসুল হক, কবি শামসুর রাহমান জীবিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে মন্ত্রী গিয়েছিলেন প্রায় ১৫ জন। আমি সারা জীবনে ঠোঁটে সিগারেট তুলতে পারিনি তাই ওসব পানীয় ছিল আমার জন্য বিষতুল্য। ভারতে অনেক বছর থেকেছি। ব্যক্তিগতভাবে অনেক বড় বড় মানুষের দাওয়াতে গেছি। দু-এক জন মন্ত্রীর বেশি টাটা, বিড়লা, গোয়েনকা, জিৎপাল, স্বাজপাল কারও দাওয়াতে দেখিনি। কিন্তু আমাদের দেশে হালি হালি মন্ত্রী, গণ্ডায় গণ্ডায় বিখ্যাত মানুষ। কেমন যেন সামাজিক অবস্থাটাই বদলে গেছে। সমাজও বড়কে মর্যাদা দেয় না, বড়রাও নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করে না। একসময়ের মহামানবদের এখন বড় বেশি সস্তায় পাওয়া যায়। ঘটনাগুলো কেন যেন হৃদয়ের মর্মমূলে আঘাত হানে, তাই না বলে পারি না।

শাহেদ আহমেদের সেই অনুষ্ঠানে একটা ছোট্ট পুস্তিকা দেওয়া হয়েছিল। অনেক বড় বড় কথা ছিল তাতে। কিন্তু অবাক হয়েছিলাম একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় শাহেদ আহমেদের ছেলের ছোট্ট একটি লেখা পড়ে। তাতে লেখা ছিল, ‘বাবা, তোমরা আমার শহীদ চাচার জন্য কিছুই করনি। তার নামে এটা ওটা যা করেছ সবই তোমাদের সুবিধার জন্য। এমনকি আজকের অনুষ্ঠানও।’ আমি চমত্কৃত হয়েছিলাম নতুন জমানার নতুন সারথির অনুভূতিতে।

সরকার যেভাবে বলছে, দেশের অবস্থা তেমন নয়। কোথাও দুধের নহর বয়ে চলছে না। যা চলছে তা পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পানি। দুই কূল ভাসিয়ে ছাপিয়ে যাচ্ছে। মানুষের কষ্টের শেষ নেই। একেবারে হেলাফেলা করে কেউ কেউ বলছে, সরকারি উদ্যোগে চালের দাম এমন লাগামছাড়া করে মানুষকে অনেকটা পাগল করে দেওয়া হয়েছে। এর পরও প্রায় সবাই নিশ্চুপ একমাত্র কারণ রোহিঙ্গাদের প্রতি সাধারণ মানুষের নিদারুণ ভালোবাসা-মমতা। ঝড়-তুফানে অনেকে দালান-কোঠায় থেকেও কষ্টবোধ করছেন। কিন্তু রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা যে কী কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন অনেকে ভাবতেও পারেন না। টিভির পর্দায় যখনই ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোর মুখ দেখি, তখনই আমার সন্তানদের মুখ ভেসে ওঠে। এ সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে নেই। যারা আছেন তারা যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রীর অপারেশন হয়েছে। দোয়া করি তিনি তাড়াতাড়ি সুস্থ হোন। এখন ১০টি পদ্মা সেতু হলে দেশের যে উন্নতি, যে সুনাম হবে তার চেয়ে অনেক বেশি হবে রোহিঙ্গা সমস্যার সফল সমাধান করতে পারলে। রোহিঙ্গারা যেমন জীবন বাঁচাতে আমাদের দেশে এসেছে, আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। আমি জোর গলায় বলতে পারি, আজ হোক বা কাল হোক তারা সসম্মানে তাদের দেশে যাবে এবং সেখানে হাজার বছর নিরাপদে বাস করবে— এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর রোহিঙ্গা কেন, আমরা যদি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারি, সারা পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষ মনে করবে বাংলাদেশ তাদের দুর্দিনের আশ্রয়। সেই কবে ১৭ সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়েছেন, আজ ৩ অক্টোবর। প্রথম দিকে গতকাল তার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত ছিল, পরে ৫ তারিখ। এখন শুনছি ৭ তারিখ। কেউ কেউ বলছেন আরও দেরি হতে পারে। দূরের মানুষ ঘরের খবর রাখি না। কিন্তু তার দেশে খুব দরকার। এমনটা দরকার এর আগে কখনো ছিল না। রোহিঙ্গাদের যথাযথ দেখভাল হচ্ছে না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যে কূটনৈতিক তত্পরতার দরকার তার অভাব আছে। মুখে যে যাই বলুন, জাতীয় ঐক্য হয়ে গেছে। কিছুই হয়নি। ওটা শুধু কথার কথা। ইস্পাতকঠিন জাতীয় ঐক্য না হলে মারাত্মক ভরাডুবি হবে। সেটা কোনো দল-গোষ্ঠীর নয়, সেটা হবে দেশের। আর আন্তরিকতার সঙ্গে সরকার যদি সবাইকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মতো এক মোহনায় শরিক করতে পারে, তাহলে একবিংশ শতাব্দীতে আমরা বাঙালিরা মানবতার সেবক হিসেবে বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারব এবং সেখানে নেতাদের প্রথম কাতারে থাকবেন জননেত্রী শেখ হাসিনা।       

লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর