মঙ্গলবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাজন-রাকিব, রাসেল-সাগর দর্শকে হাউসফুল

মোস্তফা কামাল

রাজন-রাকিব, রাসেল-সাগর দর্শকে হাউসফুল

আবারও পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা। গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যার উল্লাসনৃত্য। বাধা না দিয়ে তামাশা দেখা। ছবি তোলা। বিকৃত কর্মের এমন দ্রুত আপডেটে মনে হয় বর্বরতা বুঝি পিছু ছাড়ছেই না আমাদের। নইলে কেন ঘুরেফিরে বার বার প্রায় একই দৃশ্য? কাছাকাছি ঘটনা। এক ঘটনার চেয়ে আরেক ঘটনার ভয়াবহতা আরও ব্যাপক। আরও বীভৎস। বগুড়ার কাহালুতে সিরামিক কারখানার ১৮ বছরের শ্রমিক রাসেলকে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছে একেবারেই তামাশাচ্ছলে। ঘটনার হোতা তার সহকর্মী আরেক শ্রমিক রুবেল। তামাশারও কী মাত্রা! ডাক্তাররা জানিয়েছেন, পায়ুপথের বাতাসে নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে মারা যায় রাসেল। এর আগে গত বছর প্রায় এমন তামাশা বা বদমায়েশিতেই রাজধানীর পাশে সোনারগাঁয়ে কমপ্রেসার মেশিনে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে প্রাণনাশ করা হয় শিশু ইয়ামিনের। গত ১৪ ডিসেম্বর এ ঘটনার আগে, ২৪ জুলাই রূপগঞ্জে একটি সুতা কারখানায় এভাবেই হত্যা করা হয় আরেক শিশু সাগরকে। এরও আগে, খুলনায় এ পথেই মারা হয় শিশু রাকিবকে।

এর মধ্যেই যোগ হলো ময়মনসিংহের গৌরীপুরে গাউছিয়া মত্স্য প্রজনন কেন্দ্রের পাম্প চুরির অভিযোগে কিশোর সাগরকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। সাগরের আকুতি তাদের স্পর্শ করেনি। কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখেছে। আর কয়েকজন মোবাইল ফোনে ছবি তুলেছে। সেই ছবি আবার ইন্টারনেটেও ছড়িয়েছে। কী এক অদ্ভুত-অসুস্থ আবেগহীনতায় বসবাস আমাদের! সমাজে, পরিবারে ও ব্যক্তিগত জীবনে আবেগের আকাল পরতে পরতে। বোধের ঘাটতি সবখানেই। সাগরের হত্যাকারী মানবরূপী দানব আক্কাসকে পাকড়াও করা হয়েছে। বিচারের আশা করাই যায়। সেই দৃষ্টান্ত রয়েছে। সিলেটে শিশু রাজন হত্যার বাহাদুর কামরুলকে সৌদি আরব থেকে ধরে এনে বিচারের আওতায় নেওয়ার ঘটনা মাত্র মাস কয়েক আগের। তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে। তাই বিচারহীনতার গড়ে হরিবল অভিযোগ বেমানান। কিন্তু বিচার বা শাস্তির পরও কেন দমছে না অমানুষগুলো? সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন নানান কথা। পরামর্শও বিস্তর। কেন যেন আবেগ, মমতা, অনুভূতির কথা কিছুটা অনুহ্যই থেকে যাচ্ছে। আবেগের কমতির জন্য বিখ্যাত লেখক যাযাবর এজন্য দায়ী করে গেছেন বিজ্ঞানকে। সাড়াজাগানো ‘দৃষ্টিপাত’-এ তিনি আফসোস করে বলেছেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েশ।’ কিন্তু নিজেকে মানুষ দাবি করলে গতির সঙ্গে যতিও জরুরি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপলব্ধি— মনুষ্যত্বই মানুষের মূল ধর্ম। তার ভাষায় : জলের ধর্ম তৃষ্ণা নিবারণ, অগ্নির ধর্ম দহন, আর মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব। প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ ও স্বচ্ছন্দময় করেছে। কর্মব্যস্ততায় গতি দিয়েছে। কর্মসাফল্যও বাড়িয়েছে। কিন্তু আবেগে কি বারণ করেছে? মানুষমাত্রেই আবেগনির্ভর প্রাণী। আবেগই মানুষের অন্যতম চালিকাশক্তি। আবেগহীনতা মানুষকে আর মনুষ্যভুক্ত রাখে না। মানুষের নানা সৃষ্টি ও অর্জনের পেছনে কাজ করেছে আবেগের তাড়না। এখন সেই তাড়নার উল্টোপথ যাত্রায় বিজ্ঞানকে দায়ী করে নিজেকে দোষমুক্ত রাখার চেষ্টা অনেকটা একতরফা হয়ে যায়। অপকর্মে বাধা না দেওয়া বা সায় দেওয়ার একটা প্রবণতা চারদিকে প্রকট। আর তামাশা দেখার নমুনা অহরহ। সাগর-রাজনদের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে তামাশার বায়স্কোপ। মজা দেখার পালা। আবেগ তলানিতে পড়ে গেছে বলেই মানবিক মূল্যবোধ জাগেনি তাদের। কেউ কেউ বলতে চান এরা হারমাদ, উন্মাদ, বিকৃত, মানসিক বিকারগ্রস্ত। মোটেই তা নয়।  উন্মাদ, পাগল, মানসিক বিকারগ্রস্ত হলে তো নিজের পায়ুপথেই বায়ু দিয়ে নিজের আয়ু শেষ করত। তা তো করে না। তাহলে কেন তাদের উন্মাদ-পাগল বলে ছাড় দেওয়ার সাফাই গাওয়া? তাদের কাছে আবেগ অনেকটা বিলুপ্ত। সাগর-রাজনের কান্না স্পর্শ করতে পারেনি তাদের। কত নিষ্ঠুর হলে এমন বর্বরতা করতে পারে? কত উজবুক হলে তাতে কোনো বাধা না দিয়ে মজা দেখতে পারেন কেউ? বারণ না করে ছবি তোলায় ব্যস্ত হতে পারেন? বিজ্ঞান কি তাদের তা দেখতে বা করতে বলেছে? সেই গুহা যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের যা যা অর্জন তার সবই তো বিজ্ঞানেরই দান। বিজ্ঞান আমাদের জানা এবং এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। আবেগেরই বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ মানুষের আবেগ আগে তার পরই বিজ্ঞান। এ অঞ্চলের মানুষের দুষ্কর্মে বাদ না সেধে মজা দেখার বৈশিষ্ট্যের সাক্ষী ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপ্রধান লর্ড রবার্ট ক্লাইভও। ঘটনা ও পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও তথ্য ও বৈশিষ্ট্য বিচারে তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

পলাশী ট্র্যাজেডি নিয়ে লর্ড ক্লাইভের ব্যক্তিগত ডায়েরিতেও পাওয়া গেছে আমাদের মজাবোধের কথা। তিনি লিখেছেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে টেনেহিচঁড়ে নিয়ে যাওয়ার সময়ও মজা দেখেছে অসংখ্য মানুষ। তারা বিনা টিকিটের দর্শক হয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করেছে। এমনকি তার পিঠে ছুরিকাঘাত করার আগে নবাবকে কাঁটাওয়ালা সিংহাসন ও ছেঁড়া জুতার মালা পরিয়ে অপমান করার সময়ও কিছু মানুষ মজা দেখেছে। কাতুকুতুতে ব্যাপক বিনোদিত হয়েছে। নবাবকে অপমান করতে করতে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় মজা দেখা মানুষ একটি করে ঢিল ছুড়লেও ইতিহাস ঘুরে যেত বলে মূল্যায়ন ক্লাইভের। অব্যয়-অক্ষয়ের মতো সেই বৈশিষ্ট্য ও মানসিকতা।         

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট;

বার্তা সম্পাদক : বাংলাভিশন।

 

সর্বশেষ খবর