বুধবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গাদের ঘিরে অনেক সমস্যা

আলম রায়হান

রোহিঙ্গাদের ঘিরে অনেক সমস্যা

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার চরম বর্বরতার শিকার রোহিঙ্গারা। এ পর্যন্ত ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে বাংলাদেশকে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রথম সংকট স্থান সঙ্কুলানের বিষয়টি। কোনো বিবেচনায়ই ১০ লাখ লোকের বসবাসের জন্য স্থান নির্ধারণ করা সহজ কাজ নয়; বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো অতি ঘনবসতির দেশের জন্য। ফলে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা মানুষ তাদের মতো করে স্থান বেছে নেবেই। এর প্রাথমিক প্রভাব হচ্ছে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন।  উখিয়ার কুতুপালং থেকে শুরু করে টেকনাফের মুছলি পর্যন্ত ছোট-বড় শতাধিক পাহাড় এখন রোহিঙ্গাদের দখলে। বনবিভাগের হিসাব মতে, চার হাজার একর পাহাড় কেটে রোহিঙ্গা বসতি স্থাপন করা হয়েছে। আশপাশের সমতল এলাকা ধরলে এর পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে ১০ হাজার একরে। অনেক রোহিঙ্গা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। ফলে একপর্যায়ে বহুসংখ্যক রোহিঙ্গা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা মোটেই অমূলক নয়। স্বল্প মজুরিতে পাওয়া যাবে বলে এদের চাহিদাও আছে। ফলে প্রাথমিকভাবে গৃহকর্মী ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় এরা সহজেই কাজ পেয়ে যাবে। আবার একপর্যায়ে এরাই জড়িয়ে পড়বে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এসব বিবেচনা করেই হয়তো রোহিঙ্গাদের বাসা ভাড়া না দেওয়ার আহ্বান এবং ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের আটক করে নির্ধারিত স্থানে ফিরিয়ে দেওয়ার কসরত করছে প্রশাসন। কিন্তু এ কসরত হাস্যকর। কারণ এভাবে মানুষ আটকানো যায় না। যে রোহিঙ্গারা একটি বর্বর বাহিনীর গুলি ও মাইন উপেক্ষা করে এক দেশ থেকে আরেক দেশে আসতে পেরেছে, তাদের এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাওয়া ঠেকানোর উদ্যোগ ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয় বলেই মনে হচ্ছে। যে রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে দেশ ছেড়েছে, তাদের প্রাণ বাঁচাতে এখন খাদ্যের প্রয়োজনীয়তাই প্রধান। কিন্তু এটি খুবই কঠিন কাজ। দশ লাখ বুভুক্ষু মানুষের খাবারের সংস্থান করা সহজ কাজ নয়; পাশাপাশি কঠিন কাজ হচ্ছে এর ব্যবস্থাপনা। আবার এ নিয়ে অন্য রকম বিবেচনা আছে। তা হচ্ছে এদের জন্য ত্রাণ কত পাওয়া যাবে, কত দিন পাওয়া যাবে? আর খাদ্য সংকটে থাকা বাংলাদেশের পক্ষে ১০ লাখ লোকের বাড়তি খাদ্যের সংস্থান করা নিশ্চয়ই সাধারণ বিষয় নয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৬ কোটি মানুষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খাচ্ছে। কিন্তু প্রাধানমন্ত্রীর এ আবেগ দেশের মানুষ কতটুকু ধারণ করতে পারবে তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে। অভাবের মধ্যে থাকলে খাবার ভাগ করে খাওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়; প্রায় অসম্ভব। যা নির্মোহভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসে প্রায় ৮১ বছর আগে। অন্যের কাছ থেকে পাওয়া সামান্য চিঁড়া নিজে এক মুট খাবার পর দুই উলঙ্গ শিশু পুত্রকে ভাগাভাগি করে খেতে দেওয়ার পর দৃশ্যপট গভীরভাবে প্রণিধানযোগ্য; এটিই বাস্তবতা! কুকুরের সঙ্গে মানুষের ভাগাভাগি করে খাবারের অনেক ছবি আছে। কিন্তু অভাবী মানুষে-মানুষে এমন দৃশ্য কি খুব বেশি দেখা যায়! রোহিঙ্গাদের নিয়ে সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হচ্ছে, সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে ওঠার বিষয়টি। প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরির অপচেষ্টা হবেই। এ ব্যাপারে দীর্ঘ মেয়াদি ষড়যন্ত্রও হতে পারে। মিয়ানমার থেকে যারা এসেছে তাদের মধ্যে যুবকের অনুপাত কম। কিন্তু শিশুর সংখ্যা লক্ষ্য করার মতো, প্রায় ষাট শতাংশ। আবার শিশুদের ৮৫ ভাগই রোগাক্রান্ত। আর ইউনিসেফ বলছে, মিয়ানমার থেকে আসা অন্তত ১৫০০ শিশুকে এ পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে যাদের বাবা-মা বা কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। এ তো কেবল এ পর্যন্ত চিহ্নিত হওয়া পরিসংখ্যান। হিসাবের বাইরে আরও অনাথ শিশু রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, পিতা-মাতা-স্বজনহারা শিশুদের সংখ্যা প্রাপ্ত হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি; কয়েক গুণ। এই শিশুদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ছক আঁকতে পারে জঙ্গি গোষ্ঠী। নিউ জার্সিতে বসবাসরত আবু নাসর ফেসবুকে আমার এক পোস্টে ২২ সেপ্টেম্বর লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের মানবিক ইস্যুটাকে রাজনীতিতে ব্যবহারে তত্পর একটা মহল। ইসলামী গজল সন্ধ্যার নামে ফান্ড রাইজিং চলছে।’

একটু খোঁজখবর নিলেই জানা সহজ, এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের মুসলিম উগ্রবাদীরা নড়েচড়ে বসেছে প্রকাশ্যে। এর বাইরে নিশ্চয়ই বিদেশে একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠী তো অপ্রকাশ্য তত্পরতার ছক আঁটছে। আর কেবল বিদেশে নয়, আমাদের দেশের অভ্যন্তরেও এ ধরনের কিছু হবে না—তা ভাবার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। এরই মধ্যে সাবেক এক জেনারেল দুই লাখ রোহিঙ্গাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মিয়ানমারে প্রেরণের কথা বলেছেন চ্যানেল আই’র তৃতীয় মাত্রায়। কেবল এই বলা নয়! প্রকাশ্যে বলার বাইরেও নিশ্চয়ই আরও তত্পরতা আছে। সবকিছু তো আর বলেকয়ে হয় না। আবার সবকিছুই দৃশ্যমান থাকে না; ষড়যন্ত্র তো নয়ই। আশঙ্কার বিষয় এখানেই। সম্ভবত এ শঙ্কায়ই ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া ভারত বলছে, “রোহিঙ্গারা দেশের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক।” ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, “মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য খুবই বিপজ্জনক এবং সম্ভাব্য হুমকি।” ৪০ হাজার রোহিঙ্গা নিয়ে যখন ভারতের মতো বিশাল দেশের ঘুম হারাম তখন ১০ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে এখনো আমরা দৃশ্যত আবেগে গদগদ; আল্লাহই জানেন রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের কপালে কী আছে! যে কোনো বিচারেই পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে জঙ্গি বানানো সহজ। যেমন সহজ হয়েছে ইরাক-সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে আইএস সৃষ্টি করা। স্বজনের নৃশংস মৃত্যু দেখার ভয়ঙ্কর স্মৃতিতে তাড়িত মানুষদের দিয়ে যে কোনো মাত্রায় ঘটনা ঘটানো অধিকতর সহজ। এদের দ্বারা মহত কাজ করানো সম্ভব; যেমন বাঙালিরা করেছে ’৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে। সেদিন টগবগে যুবক তো বটেই, কোমল কিশোরও হয়ে গেছে দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। এর বিপরীত ধারায় মধ্যপ্রাচ্যে পরাশক্তির ষড়যন্ত্র ও বর্বতায় সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং বহু আত্মঘাতী মানব বোমা।  আমাদের দেশে কি এ পর্যন্ত আত্মঘাতী মানুষের পরিচয় মেলেনি?  কাজেই রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের মানবিকতার সুযোগ গ্রহণ করে বিভিন্ন শক্তি কোনো ছক আঁটছে কিনা তা বলা কিন্তু কঠিন। মানবতার জন্য আমাদের উদারতা যাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে আসতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর