রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

জনসম্পৃক্তি ছাড়া সফলতা আসে না

নূরে আলম সিদ্দিকী

জনসম্পৃক্তি ছাড়া সফলতা আসে না

যে কোনো বিশ্লেষণ, আঙ্গিক এবং যে কোনো বিষয়ে মিয়ানমার থেকে মুসলিম বিতাড়ন একদিকে যেমন বর্বরোচিত, পাশবিক, মানবতাবিরোধী; অন্যদিকে বাংলাদেশ ও তার সরকার, এমনকি আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রতি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের নৈতিক ও আর্থিক সমর্থন এবং অনুদানের ব্যাপারে ধনী-দরিদ্র, অভাবী-বিত্তশালী, এমনকি প্রাচুর্য-ঐশ্বর্যের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে ভোগবিলাসই যাদের মূল লক্ষ্য হিসেবে সমাজে চিহ্নিত হয়েছিল, তারা থেকে শুরু করে যারা দৈনন্দিন জীবনযাপনে কায়িক পরিশ্রমে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত— সবাই একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রোহিঙ্গাদের সাহায্যে বুক উজাড় করে এগিয়ে এসেছেন। গণমানুষের এমন অভূতপূর্ব মহামিলন এবং স্বতঃস্ফূর্ত গণউচ্ছ্বাস, ইতিহাসবিরল গণজাগরণ ৭০-এর নির্বাচন ও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে দৃশ্যমান হয়েছিল। নির্যাতন তাদের স্তব্ধ করতে পারেনি। হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, গৃহদাহ বাংলার উজ্জীবিত চেতনাকে বিন্দুমাত্র নিষ্প্রভ করতে পারেনি। বরং আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো অগ্নি উদগিরণ করে পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে যেমন ছিনিয়ে এনেছিল, তেমনই এ প্রবহমান বাংলার বর্ণ-ধর্ম-গোত্র, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব শ্রেণির প্রান্তিক জনতার উচ্ছ্বসিত আবেগ রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে বঙ্গোপসাগরের তরঙ্গমালার মতোই আছড়ে পড়েছে। আবহমান বাংলার মানুষের হৃদয়ের সহমর্মিতায় নির্যাতিত, নিপীড়িত, গৃহহারা দেশছাড়া মানুষগুলো অবাক ও বিস্মিত হয়ে অবলোকন করেছে— এ বাংলাকে, এ বাংলার মানবতার উদার ও উদ্বেলিত আবেগকে। মানুষ শুধু রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশা অবলোকন করতেই যায়নি, তাদের সঙ্গে ছিল অফুরন্ত সাহায্য সামগ্রী। এনজিও তো বটেই, দেশের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে মসজিদগুলো থেকে বিপুল ত্রাণসামগ্রী নিয়ে মানুষ ছুটে গেছে। খাদ্য-বস্ত্র ছাড়াও তাদের অস্থায়ী আবাস, শৌচাগার নির্মাণের একটি প্রতিযোগিতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এখানে সরকার এবং সরকারের প্রশাসন ও সরকারি দলের প্রাণবন্ত সহযোগিতাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে উদাত্ত ঘোষণা এসেছে, বাংলাদেশ ধনী এবং ঐশ্বর্যমণ্ডিত না হলেও ১৬ কোটি মানুষ ১০ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ক্ষুধার অন্ন ভাগাভাগি করে খাবে, ক্ষুধা নিবারণ করবে। আজকের রাজনৈতিক আঙ্গিকে এর পক্ষে-বিপক্ষে যত কথাই উঠুক না কেন ইতিহাসের নির্মোহ বিচারে ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালির উদারচিত্তের এ সহমর্মিতা, মহানুভবতা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়েই স্থান পাবে— এটা আমি শতভাগ নিশ্চিত।

আমার আগের নিবন্ধে আমি বলেছিলাম, মানবতার প্রশ্নে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় তো দিতে হবেই, কিন্তু সেটা কোনো অবস্থাতেই চূড়ান্ত সমাধান নয়। মিয়ানমারে তাদের নিজস্ব ঠিকানা। পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অধিকারসহ তাদের সেখানে ফেরত পাঠানো অত্যাবশ্যক। আমার নিবন্ধ এবং টকশোতে আমি দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেছিলাম, এটি করতে হলে যেহেতু বাংলাদেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়, তাই মুসলিম বিশ্ব থেকে শুরু করে সারা বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। মিয়ানমারের বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ নয়, অর্থনৈতিক অবরোধসহ জাতিসংঘের ফলপ্রসূ চাপের মাধ্যমে মিয়ানমারের বর্বর সামরিক শক্তিকে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ রাজনৈতিক অধিকারসহ তাদের স্ব স্ব স্থানে পুনর্বাসনে বাধ্য করতে হবে। এ প্রশ্নে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে কফি আনান কমিশনের একটি দিকনির্দেশনা রয়েছে। জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণে ও তার আগে রয়টারকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান যে পাঁচটি সুপারিশ রেখেছে তার আঙ্গিকে গেলেও রোহিঙ্গা সমস্যার একটা সম্মানজনক সমাধান হতে পারত। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে, আশ্চর্যান্বিত হয়ে বেদনাহত চিত্তে লক্ষ্য করলাম, এ প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক বসল বটে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। চীন, রাশিয়া, জাপান নিরাপত্তা পরিষদে নেতিবাচক ভূমিকা গ্রহণের প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের হিংস্র সামরিক জান্তা প্রকারান্তরে উৎসাহিত হলো, যার ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গা বিতাড়ন কার্যক্রম ক্রমাগত চলতেই থাকল। মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ থামল তো না-ই, বরং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বসবাসরত মুসলিম রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার সব উদ্যোগ বাস্তবায়িত করার পাকাপোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো।

প্রাসঙ্গিকভাবে আমি উল্লেখ করতে চাই, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানে বাংলাদেশ সরকার উদার চিত্ত এবং সফলতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে তেমনই নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। চীনকে এ ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের সপক্ষে আনা সম্ভব না হলেও রাশিয়া এবং জাপানকে অনেকটা রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করা সম্ভব হতো বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানের আবেগতাড়িত মানসিকতা যেমন দেশে-বিদেশে প্রশংসিত, ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক মহলকে রোহিঙ্গা প্রশ্নে সরব ও সক্রিয় করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বিশ্বকে অবাক করেছে, বাংলাদেশকেও সম্ভাব্য সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

সংকট সমাধানে কূটনৈতিক তত্পরতার দুর্বলতা এর একমাত্র কারণ। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস ও জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধির কর্তব্যের অবহেলা এক্ষেত্রে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী যখন জাতিসংঘে ভাষণ দেন তখন প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধির অনুপস্থিতি তো বটেই, যে নিদারুণ জনশূন্যতা ভাষণ প্রদানকালে পরিলক্ষিত হয়েছে তা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক এবং তাদের অযোগ্যতা ও কর্তব্যে অবহেলার প্রকট দৃষ্টান্ত। ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েছেই, ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে বাংলাদেশ দূতাবাসের অ্যাম্বাসেডর ও স্থায়ী প্রতিনিধি পরিবর্তনেই খোল-নলচে পাল্টে ফেলার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘে সরকারপ্রধানের ভাষণের সময় পরিষদের উপস্থিতির স্বল্পতা আমার মতো যে কোনো দর্শককেই মর্মাহত ও আশ্চর্যান্বিত করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সব অঙ্গনের মতোই ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে নিযুক্ত আমাদের কূটনীতিকবর্গ স্থির প্রত্যয়ে হয়তো এটিই ভাবছেন যে, শেখ হাসিনার সম্মুখে তার অর্চনা-বন্দনা করলেই দায়িত্ব শেষ এবং পদ ও পদবি নিশ্চিত থাকবে। আন্তর্জাতিকভাবে কূটনৈতিক তত্পরতা তাদের দায়িত্বের আবর্তের মধ্যে পড়ে না। শেখ হাসিনার ভাষণের সময় আমাদের প্রতিবেশী ভারতসহ মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়নি। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এ সত্যটিই স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে যে, মোসাহেবী ও স্তুতি-বন্দনা ছাড়া কূটনৈতিক মহলেরও অন্য কিছু করণীয় নেই।

এবার সম্প্রতি দেশের অভ্যন্তরে একটি অকল্পনীয় ও অভাবিত সংকট তৈরি হয়েছে। দেশের বিচার-ব্যবস্থার সঙ্গে সরকারের একটি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির উদ্ভবে। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি মহামান্য এস কে সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণ বেঞ্চ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ক্ষমতা ও অভিশংসন আইন বাতিল করে যে সাহসী ও ঐতিহাসিক রায়টি দিয়েছেন এবং দেশের সুপ্রিম কোর্ট সংসদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন সে বিষয়ে যে রায়টি দিয়েছেন সেটি জনমনে আদালতের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা সৃষ্টি করলেও শেখ হাসিনা ও তার পারিষদবর্গ সহজভাবে নিতে পারেননি। সংসদে একটি দিবস শুধু এ বিষয়টি নিয়েই আলোচনা হয়েছে। কিছু অতি উৎসাহী সংসদ সদস্য শাসনতন্ত্রে সুপ্রিম কোর্টকে প্রদত্ত অধিকার ও ক্ষমতার কথা বেমালুম বিস্মৃত হয়ে সংসদে অযথা ও অনর্থক আস্ফাালন করেছেন। এসব ঘটনা জাতিকে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন করেছে এ কারণে, সব ক্ষমতার আধার ও সূতিকাগার শেখ হাসিনা সংসদে বসে তার স্বভাবসুলভ হাস্যমুখে এসব অর্বাচীন আলোচনা ও সমালোচনাকে উপভোগ করেছেন। শুধু তাই নয়, মন্ত্রিপরিষদের প্রবীণতম সদস্য আবুল মাল আবদুল মুহিত তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে অযৌক্তিক ও শাসনতন্ত্রবিরোধী বেসামাল বক্তব্য প্রদান করেন।

যাই হোক, শুধু সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরাই নন, দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। সরকার দলের লোকদের প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে প্রদত্ত বক্তব্য দেশবাসীকে বিস্মিত ও মর্মাহত করল। সুযোগের অপেক্ষায় ওতপেতে বসে থাকা মাজাভাঙা বিএনপি সরকারের পদত্যাগ দাবিই করে বসল (দাবিটুকুই সার)। তবে এ ব্যাপারে কোনো আন্দোলনের কর্মসূচি বিএনপি নিল না। বিএনপি নিশ্চিত তাদের চেয়ারপারসনের কার্যালয়, প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স হল এ দুই জায়গা থেকেই গরম গরম ও মুখরোচক কথাবার্তা বলেই তারা তাদের ক্ষমতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবেন। এর জন্য কোনো ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে হবে না। প্রান্তিক জনতার নারীর স্পন্দন, হৃদয়ের অনুরণন উপলব্ধি করার কোনোই প্রয়োজন নেই। প্রান্তিক জনতা নয়, কোনো অজানা শক্তি অলৌকিকভাবে তাদের ক্ষমতার মসনদে বসিয়ে দেবে; এ দিবাস্বপ্ন, এ রোমান্টিক চিন্তা তাদের শুধু আন্দোলন থেকে নিবৃত্তই রাখছে না, শেখ হাসিনাকে আরও দুঃসাহসী মানসিকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি নিজেকে এতটাই অপ্রতিরোধ্য ভাবছেন যে, রাজনৈতিক প্রশ্নে তো নয়ই, এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো জাতীয় সংকটেও তিনি কারও সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজনবোধ করেন না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ। মৌলিক অধিকারবিবর্জিত এ দেশে নাগরিকদের শেষ আশ্রয়স্থল বিচারব্যবস্থা এবং সুপ্রিম কোর্টকে এভাবে বিপন্ন করে তোলার প্রচেষ্টা চালালে দেশের সাংবিধানিক স্তম্ভগুলো দুমড়ে মুচড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়াটিও বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সমাজে মানুষের মুখে মুখে প্রসঙ্গটি আলোচিত হচ্ছে। প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করার জন্য চাপ প্রয়োগের একটি গুঞ্জন শোনা গেছে। প্রধান বিচারপতি এখানেও তার দৃঢ়তা ও স্বাধীনচেতা মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে তিনি এখন ছুটিতে গেছেন। স্বাস্থ্যগত কারণে ছুটিতে গেছেন বলে উল্লেখ করা হলেও জনমনে আশঙ্কা, পদত্যাগ না করলেও তাকে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এটা পরিষ্কার হওয়ার সময় এখনো আসেনি, কিন্তু জনমনের এ আশঙ্কা সত্য হলে দেশের গণতান্ত্রিক ধারা বিধ্বস্ত তো হবেই, একটা সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসবে। যেটির সুযোগ নেবে ওতপেতে থাকা রাজনৈতিক অপশক্তি। শেখ হাসিনার একগুঁয়েমির পাশাপাশি মাজাভাঙা ক্ষমতালিপ্সু, আদর্শ বিবর্জিত, প্রতিহিংসাপরায়ণ বিএনপি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারছে না— ভবিষ্যতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এটাও প্রান্তিক জনতার উদ্বিগ্ন হওয়ার অন্যতম কারণ।

আমি সাহসের ওপর ভর করে বারবার উল্লেখ করেছি, দেশের এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যেখানে বিরোধী সংগঠনসমূহ নির্বিকার, নিস্তব্ধ ও নিস্পৃহ, সেখানে এ গণতান্ত্রিক দেশটির আবহমান ঐতিহ্যের ধারায় বিবেকতাড়িত সব নাগরিককে স্ব স্ব স্থান থেকে সরব হতে হবে, প্রতিবাদী হতে হবে। ছাত্র, সুশীল সমাজ, শিক্ষক, সাংবাদিক সবাই-ই প্রাপ্তি-প্রত্যাশার মোহ থেকে বেরিয়ে এসে সরব হতে পারলে নীরব, নিস্তব্ধ, নিস্পৃহ বাংলাদেশ আবার জাগ্রত হবে। রাজনীতির গুমোট অসহনীয় ও অনিশ্চিত পরিবেশ দীর্ঘায়িত করলে শুধু গণতন্ত্রেরই বারোটা বাজবে না, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নেও একটি অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হবে, ভয়ঙ্কর হবে।

আমার ভাবতে অবাক লাগে, এ দেশের শীর্ষ নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত নেতৃদ্বয় জনগণকে এতই অচ্যুত মনে করেন যে, প্রান্তিক জনতার কোনো ধারই তারা ধারেন না। এত বড় বন্যা ও এ অভূতপূর্ব রোহিঙ্গা সমস্যায় দেশ যখন জর্জরিত তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী সুদূর লন্ডনে বিলাসী ও প্রাচুর্যের জীবন উপভোগ করছেন। দেশে ফেরার কোনো তাগিদ এ মহাদুর্যোগের মুহূর্তেও তার বিবেককে তাড়িত করছে বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ প্রচারণা চালাচ্ছে, মামলার রায়ের আতঙ্কে বেগম খালেদা জিয়া এতটাই দিশাহারা ও শঙ্কিত যে, রায় তার সপক্ষে না এলে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তনই করবেন না। বড় বিচিত্র এ দেশ, সেলুকাস ! দুটি পূর্ণ মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী ও চার বছরের ফার্স্টলেডি— তিনি কোনোদিনই জেলের চৌকাঠ পেরোননি। কারাগারের নির্যাতন-নিগ্রহ সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করা তো দূরে থাক, কারাগারের ফটক চোখের সামনে ভেসে উঠলে ‘দেশনেত্রী’ যেভাবে আঁতকে ওঠেন তা দেশবাসীর সঙ্গে আমাকেও বিস্মিত করে। ‘দেশনেত্রী’র জেল আতঙ্ক তার রাজনৈতিক চরিত্রকেই কেবল বিবর্ণ করে না, দেশে একটা গণতান্ত্রিক গণআন্দোলনের সম্ভাবনাকেও বিনষ্ট করে, বিধ্বস্ত করে। সারাবিশ্বের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এ অমোঘ সত্যটি বিএনপি নেত্রী এবং তার অন্যান্য নেতা-নেত্রী ও কর্মীবাহিনী যত শিগগির অনুধাবন করবেন, জাতির জন্য তা ততটাই কল্যাণকর হবে। ঠিকমতো জাগাতে পারলে এদেশের জনগণ তত শিগগিরই একটা সফল গণআন্দোলনের সাফল্যের স্বর্ণসৈকতে জাতিকে পৌঁছে দিতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়াসহ সব নেতৃবৃন্দকে কেবলই ক্ষমতা দখলের লোভকে অবদমন করতে হবে, প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং আন্দোলনের দীর্ঘ পথপরিক্রমণে প্রান্তিক জনগণকে সংযুক্ত করতে হবে।

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর