শিরোনাম
রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

একজন হজযাত্রীর তিক্ত অভিজ্ঞতা

ড. শেখ আবদুস সালাম

একজন হজযাত্রীর তিক্ত অভিজ্ঞতা

সম্ভবত ৫ অক্টোবর ছিল বাংলাদেশের সর্বশেষ রিটার্ন হজ ফ্লাইট। সম্প্রতি আমি ও আমার স্ত্রী পবিত্র হজব্রত পালন করে দেশে ফিরেছি। দেশে ফেরার পর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনেরা কেউ কেউ দেখা করতে আসছেন, খোঁজখবর নিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ টেলিফোন করে জিজ্ঞাসা করছেন হজ কেমন হলো, হজের সময় সৌদিতে আমরা কেমন ছিলাম, কোনো অসুবিধা হয়েছিল কিনা, থাকা-খাওয়া সব ঠিকঠাক ছিল কিনা ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে এক কথায় বলতে হয় সামগ্রিকভাবে হজ ব্যবস্থাপনা যেমন ছিল আমরাও তেমন ছিলাম। হজের সময় আমাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতেই আমার এ লেখা। 

আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য হজ ফরজ। ইসলামের এ অনুশাসনের আলোকে আমরা ২০১৬ সালে হজ পালনের সিদ্ধান্ত নিই। আমার এক ছোট ভাই ২০১৫ সালে হজব্রত পালন করেছে। তার সঙ্গে আলোচনার এক পর্যায়ে তারই পরামর্শে আমরা খুলনার জনৈক মুয়াল্লেম যিনি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার একটি মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা হারুন সাহেবের মাধ্যমে ২০১৬ সালের প্রথমদিকে হজের টাকা জমা দিই। তিনি তখন মোটামুটি আশ্বস্ত করেছিলেন যে, আমরা ২০১৬ সালেই হজে যেতে পারব। কিন্তু সে বছর লটারিতে আমাদের সিরিয়াল পেছনে থাকায় আমরা যেতে পারিনি। আমার ভাইকে তিনি তখন আশ্বস্ত করেন যে, ২০১৭ সালে হজ প্রস্তুতি শুরু হওয়ার প্রথমদিকেই আমরা হজে যেতে পারব। ২০১৭ সালে জুলাই মাসে হজ মৌসুমের শুরুতে তাদের তত্পরতা দৃশ্যমান না থাকায় আগস্ট মাসে আমি সরাসরি মাওলানা হারুনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করার পর তিনি আমাকে ঢাকার হাশিম এয়ার ট্রাভেলসে পাসপোর্ট জমা দিতে বলেন। পাসপোর্ট জমা নেওয়ার পর এ ট্রাভেল এজেন্সি থেকে আমাকে আমার মুয়াল্লেমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।

আমি এ সময় মাওলানা হারুনকে মাঝেমধ্যেই টেলিফোন করে আমাদের হজে যাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, আমি তার ‘শীর্ষ ভিআইপি’ হাজী। আমার জন্য তিনি মক্কা ও মদিনায় বিশেষ গাড়ি এবং সাহায্যকারী লোকজনের ব্যবস্থা রাখবেন। তিনি আমার গ্রুপের হাজীদের সঙ্গে নিজে মক্কা-মদিনা যাবেন এবং সার্বক্ষণিক আমার খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন— মোটকথা তার ভাষায় আমি হলাম তার ‘আইকন হাজী’ (পরে শুনেছি অন্য প্রায় সব হাজীকেই তিনি একই কথা বলেছেন)। আগস্টের ১৬ তারিখ পর্যন্ত যখন অনেকের ভিসা জটিলতা এবং এজেন্টরা এয়ার টিকিট না নেওয়ার কারণে হজ ফ্লাইট বাতিল হতে লাগল এবং আমাদের ব্যাপারেও তারা কিছুই বলছে না এ পরিস্থিতিতে আমি তাকে টেলিফোন করে একটু শক্ত কথাই বললাম বৈকি। এরপর থেকে তিনি আমার এবং আমার স্ত্রীর ফোন ধরা বন্ধ করে দিলেন। এদিকে আমি হাশিম এয়ারে খবর নিলে তারা জানাল আমাদের ভিসা এসেছে কিন্তু এজেন্ট/মুয়াল্লেম কোনো টিকিট নিচ্ছেন না। আমার ছোট ভাইকে বিষয়টি জানালে সে মাওলানা হারুনের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের জানায়, হারুন আমার ফোন ধরতে লজ্জা এবং ভয় পাচ্ছে। তবে সে জানিয়েছে আগস্ট মাসের ১৯ থেকে ২৬ তারিখের মধ্যে আমাদের ফ্লাইট হবে। মাওলানা হারুন ২০ তারিখের দিকে আমার ফোন ধরে এবং আমাকেও একই কথা জানান। আমি তাকে তখন জিজ্ঞাসা  করি হজ শেষে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় মদিনায় গিয়ে অন্তত আট/নয় দিন থেকে একটু আগে আগে আমাদের দেশে ফিরে আসা সম্ভব কিনা (উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে ২০ সেপ্টেম্বর উচ্চশিক্ষার জন্য আমার মেয়ের দেশের বাইরে যাওয়ার দিন ঠিক হয়)? তিনি এ ব্যাপারে আমাকে শতভাগ আশ্বাস দেন যে, হজ শেষ হলেই তিনি আমাকে মদিনায় পাঠিয়ে দেবেন। আর দেশে ফেরার স্বাভাবিক শিডিউলের আগে এয়ার টিকিটের ফেরার তারিখ পরিবর্তন করে আমাদের দেশে ফেরার জন্য ব্যবস্থা করে দেবেন। সেজন্য হয়তো এয়ার টিকিট বাবদ আমাকে কিছু টাকা বেশি দিতে হবে। আমি তা সাদরে গ্রহণ করি। এর মধ্যে হজযাত্রার ফ্লাইটের তারিখ একবার ২২, একবার ২৪, একবার ২৬, ২৭ সবশেষে ২৮ আগস্ট এভাবে চেঞ্জ হতে থাকে। 

আমি এবং আমার স্ত্রী উভয়ে চাকরিজীবী। এভাবে তারিখ পরিবর্তনের কারণে আমরা সুনির্দিষ্ট দিন ঠিক করে অফিস থেকে ছুটি নিতেও বিড়ম্বনায় পড়ি। আত্মীয়-স্বজনকেও আগেভাগে আমাদের হজে যাওয়ার দিন নির্দিষ্ট করে বলতে ব্যর্থ হই। অবশেষ ২৭ আগস্ট দুপুরের দিকে তিনি আমাদের বোর্ডিং কার্ড দেন এবং ২৮ আগস্ট সকালে সৌদির একটি ফ্লাইটে (অতিরিক্ত) আমাদের জেদ্দায় নিয়ে যান। তিনি এ সময় আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। জেদ্দা এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে মোবাইলের সিম কিনতে চাইলে তা মক্কায় গিয়ে কেনার জন্য তিনি আমাদের পরামর্শ দেন। জেদ্দায় নেমে দেখি জেদ্দা থেকে মক্কায় যেতে আমাদের জন্য কোনো বাস/গাড়ি প্রস্তুত ছিল না। জেদ্দায় এয়ারপোর্টের বাইরে (এসি/ফ্যান ছাড়া) গরমের মধ্যে বসে থেকে ছয়/সাত ঘণ্টা পরে তারা আমাদের জন্য একটি বাস জোগাড় করে। আমরা বাসে উঠি। এ সময় মুয়াল্লেম আমাদের কোনো ধরনের খাবার কিংবা পানীয় পর্যন্ত সরবরাহ বা আমরা নিজেরা কোথায় খাবার কিনে খেতে পারি সে ব্যাপারেও কোনো সহযোগিতা করেননি। যাই হোক আমরা প্রায় ১৮/২০ জন মানুষ (এক গ্রুপের) এভাবে বাসে চড়ে মক্কার উদ্দেশে রওনা হই। 

জেদ্দা থেকে মক্কা এক/দেড় ঘণ্টার পথ। মক্কা শহরে এসে এ বাসে বসিয়েই আমাদের তিন/চার ঘণ্টা এদিক-ওদিক ঘোরানো হয়। আমরা জানতে পারি মুয়াল্লেম আমাদের জন্য নির্ধারিত বাড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না। এক পর্যায়ে প্রায় শেষ রাতের দিকে আমাদের খানসা এলাকায় আল-বদর হসপিটাল অ্যান্ড ক্লিনিক বিল্ডিংসংলগ্ন একটি ভবনে উঠানো হয়। সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে আমাদের মধ্যে কেউ একজন মন্তব্য করলেন যে, এখানে এতক্ষণ পর্যন্ত অন্য এক গ্রুপ হাজী ছিলেন। ইতিমধ্যে তাদের হয়তো অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং ঘর খালি হলে আমাদের উঠানো হয়েছে। জেদ্দায় ছয়/সাত ঘণ্টা বসিয়ে রাখা কিংবা বাড়ি খুঁজে না পাওয়ার অজুহাতে মক্কা শহরে চার/পাঁচ ঘণ্টা বাসে বসিয়ে ঘোরানোর মাজেজা নাকি এটাই। আমাদের এ বাড়িটি ছিল মক্কা শরিফ থেকে পাঁচ/ছয় কি.মি. দূরে। আমাদের বলা হয়, এখানে থেকে হজের ফরমালিটিজ শেষ করে ৪ কিংবা ৫ সেপ্টেম্বর আমাদের হারাম শরিফের কাছে কোনো হোটেলে নিয়ে যাওয়া হবে। আমরা এ সময় এখান থেকেই নিজেদের অর্থে গাড়িতে করে সাধ্যমতো হারাম শরিফে তাওয়াফ, নামাজ আদায় প্রভৃতি কাজ সম্পন্ন করি। ৩ বা ৪ তারিখ হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেলেও এ ভবনে আমাদের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকতে হয়। মুয়াল্লেম সাহেব বাংলাদেশে থাকতে আমাদের কথা দিয়েছিলেন হজসহ অন্য সব আনুষ্ঠানিকতার জন্য তারাই সব ব্যয় বহন করবেন এবং সবসময় তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। মিনা এবং আরাফাতে তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেনও। মুজদালিফায় রাতে অবস্থান করে সকালে পাথর নিক্ষেপ করতে যাওয়ার পথে তিনি উধাও হয়ে যান। আমরা প্রায় সবাই সেদিন পথ ভুলে এদিক-ওদিক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। সেদিন সম্ভবত তাপমাত্রা ছিল ৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আমরা একেকজন পথ হারিয়ে সাত/আট ঘণ্টা হেঁটে সেদিন যে যার মতো করে তাঁবুতে কিংবা হোটেলে ফিরি। সেদিন মুয়াল্লেমের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে ১২/১৩ ঘণ্টা পরে যোগাযোগ হয়। আমাদের কেন ফেলে গেলেন সে প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দেন তিনি কোরবানি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তার ভাষায় এদিন কমবেশি সবাই পথ হারাবে সেটাই নাকি স্বাভাবিক। এজেন্ট/মুয়াল্লেমের অবহেলার কারণে এ ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল আমাদের প্রায় সবারই। 

হজে যাওয়ার আগে তারা কথা দিয়েছিলেন হজের পর তারা উদ্যোগ নিয়ে আমাদের মক্কায় আশপাশের কিছু স্থাপনা দেখাবেন। কিন্তু তার কোনোটাই তারা করেননি। ৮ সেপ্টেম্বর তারা আমাদের হারাম শরিফের খুব কাছে আজইয়াদ আল কামার নামক একটি রেসিডেন্সিয়াল ইউনিটে নিয়ে উঠায়। এখানে একেকটি রুমে চারজনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমাদের আট/নয়জন করে একেকটি রুমে উঠানো হয়। এর ফলে রুমের এসি যথার্থভাবে ফাংশনাল ছিল না। আমার রুমের ফ্যানটিও নষ্ট ছিল। ৮ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত ফ্যানটিও তারা ঠিক করে দেয়নি। জায়গা সংকটের কারণে এবং সীমিত এসিতে রুম ঠাণ্ডা না হওয়ায় আমার মনে হয়েছে এ এজেন্ট/মুয়াল্লেমরা আমাদের যেন কমোডিটি হিসেবে একটি রুমে জাস্ট ডাম্প করেছে। চ্যানেল আই/এটিএনের মক্কা প্রতিনিধি মক্কায় আমাদের রুমের অবস্থা ক্যামেরায় ধারণ করে নিয়ে গেছেন। জানি না তা প্রচার হয়েছে কিনা।

যাই হোক এভাবে তিন/চার দিন কেটে যাওয়ার পর আমি অনেক চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে সেখানে বাংলাদেশ হজ মিশনের কাউন্সিলর ও হজ কনসালকে ইনভল্ব করে আমাদের রিটার্ন টিকিট তাদের কাছ থেকে বের করি এবং ১১ বা ১২ সেপ্টেম্বর সৌদিয়া এয়ারলাইন্সে গিয়ে বাড়তি কিছু অর্থ প্রদান করে ১৮ সেপ্টেম্বর মদিনা থেকে আমাদের ফেরার তারিখ নির্দিষ্ট করে নেই। মুয়াল্লেম/এজেন্টকে তখন থেকেই আমাদের মদিনায় পাঠানোর জন্য তাগিদ দিতে থাকি। আমাদের সব তাগিদ তাদের কাছে কেবলই উপেক্ষিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা ১৪ তারিখ আমাদের মদিনায় পাঠিয়ে দেবে বলে জানায়। মদিনায় রাখার জন্য তারা প্রতিরাত ৪২০ রিয়াল করে প্রদান করার দাবি করে। অথচ দুই দিন আগে আমাদের হজ কাউন্সিলর আমাকে বলেছিলেন আমি চাইলে মদিনায় মিশনের অ্যারেঞ্জমেন্টে থাকতে পারব। কিন্তু ঠিক সেই সময় আমাদের এজেন্ট জনৈক হাসান (খুলনা) হজ কাউন্সিলরের সামনেই আমাকে বলেন, এর দরকার নেই, মদিনায় তাদের বাড়ি খালি পড়ে আছে। আমি যেন বরং সেখানে উঠি।

যাই হোক এভাবে আজ পাঠাচ্ছি, কাল পাঠাচ্ছি করে তারা ১৬ তারিখ আমাদের মদিনা পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এর ফলে আমরা মদিনায় মাত্র একদিন থাকার সুযোগ পাই। ১৭ তারিখ অর্থাৎ একদিন মাত্র মদিনায় থেকে আমরা রসুলের (সা.) কবর জিয়ারত এবং মসজিদে নববীতে নামাজ আদায়ের সুযোগ পাই। ১৭ তারিখ সকালে মক্কা থেকে টেলিফোন করে আমাদের মুয়াল্লেম মাওলানা হারুন আমাকে মদিনায় একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পরামর্শ দেন যাতে আমাদের পাসপোর্ট ১৮ তারিখ ঠিকমতো মদিনা এয়ারপোর্টে পৌঁছে যায় এবং আমরা তা সময়মতো হাতে পাই। কিন্তু মদিনায় ওই ভদ্রলোক তার অফিস আছে বলে আমাদের মদিনাস্থ সৌদি হজ অফিসে যেতে এবং পাসপোর্ট এয়ারপোর্টে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বলেন। আমরা মদিনায়  নিজেদের অর্থ ব্যয় করে এসব কাজ সম্পন্ন করি।

সৌদি হজ ব্যবস্থাপনা অফিসে গিয়ে আমাদের কাজ ছিল সেখানে আমাদের রিটার্ন এয়ার টিকিট দেখালে তারা আমাকে একটি কাগজ দেবে। পরদিন এয়ারপোর্টে এ কাগজ দেখিয়ে আমাদের পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে। মদিনার ওই অফিসে সেদিন তেমন কোনো ভিড়ও ছিল না। কম্পিউটারে আমাদের নাম এবং পাসপোর্ট নম্বর টাইপ করে নির্দিষ্ট ছক বা ফরম্যাট করা কাগজে একটি প্রিন্ট দিয়ে তাতে স্বাক্ষর করে আমাদের হাতে সেই কাগজটি দিয়ে দেবে এই যা। সব বিবেচনায় এ কাজটি করতে বড়জোর দুই থেকে তিন মিনিট সময় লাগার কথা। কিন্তু সৌদি ডেস্ক অফিসার সাহেব এ কাগজটি দিতে কোনো কারণ যেমন : ব্যস্ততা, ভিড় ইত্যাদি ছাড়াই তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগালেন। অবশেষে কাগজটি আমার হাতে দিয়ে তিনি বিড় বিড় করে বলতে শুরু করলেন হাদিয়া, হাদিয়া। আমি তাকে ২০ রিয়ালের একটি নোট হাতে দিলে আলহামদুলিল্লাহ বলে তিনি তা পকেটে ঢুকিয়ে ফেললেন। ২০ রিয়াল ‘হাদিয়া’ দিয়ে আমরা তার অফিস থেকে কাগজ নিয়ে বের হয়ে এলাম এবং পরের দিন ১৮ সেপ্টেম্বর সৌদিয়াযোগে ঢাকায় ফিরে এলাম।

আমাদের এই অভিজ্ঞতা তথা এজেন্ট/মুয়াল্লেমের এ কর্মকাণ্ডের সাক্ষী বাগেরহাট বারের অ্যাডভোকেট গাজী আবদুল লতিফ, শরণখোলা সুন্দরবন হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবদুল খালেক, শিক্ষক তমিজুর রহমান, খুলনা পুলিশ লাইন স্কুলের শিক্ষক মো. ইকবালসহ আরও অনেকে। আমাদের সঙ্গে খুলনা গোয়েন্দা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার (কামরুল ইসলাম) স্ত্রী এবং তার পরিবারের তিনজন সদস্যও ছিলেন। ভালো রাখার ব্যাপারে একই কথা বলে তাদের কাছ থেকে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ করে টাকা নেওয়া হয়েছে কিন্তু রাখা হয়েছে আমাদের মতো একই অবস্থায়। এক পর্যায়ে অস্থির হয়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী আমাকে তার স্বামীর ফোন নম্বরটি দিয়ে অনুরোধ করলেন যে, তিনি বললে তার স্বামী হয়তো ভাববে যে, মেয়ে মানুষ একটু কষ্ট হচ্ছে বলেই বার বার তিনি তার স্বামীকে ফোন করে বিরক্ত করছেন। তিনি সত্যিই যে কষ্টে আছেন তা যেন আমি তার স্বামীকে একটি ফোন করে জানিয়ে দিই যে এজেন্ট/মুয়াল্লেম তাদের কোন অবস্থায় রেখেছেন। এ এজেন্ট/মুয়াল্লেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সোনালী ব্যাংকের প্রাক্তন ম্যানেজার মাহবুবুর রহমান এবং তার স্ত্রীর কাছ থেকেও চার লাখ (প্লাস) করে টাকা নিয়ে তাদের হোটেল হিলটনে রাখা হবে বলে বলেছিলেন। তাদেরও আমাদের সঙ্গে একই অবস্থায় রেখে ২০ দিন পরে হিলটন হোটেলে উঠিয়েছে।

এ অভিজ্ঞতা শুধু আমাদের নয়। মক্কায় অবস্থানকালে ধর্মমন্ত্রীর পরিচিত ময়মনসিংহের এক মহিলা হজযাত্রী আমাদের জানিয়েছেন, তারা কয়েকদিন ধরে মোয়াল্লেম/এজেন্ট কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না। ঠিকমতো তাদের খাবারও সরবরাহ করা হচ্ছে না। তাদের যে রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেই রুমের একদিকে ছয়জন অন্য পুরুষ আর একদিকে তার স্বামী এবং তিনি থাকছেন। মাঝে কোনো পার্টিশন বা পর্দার ব্যবস্থাও নেই। অর্থাৎ পুরুষ-নারী একই রুমে থাকতে হচ্ছে (!) এরকম কাহিনী আরও আছে। এসব আশ্বাসবাজ, নিষ্ঠুর, ওয়াদা ভঙ্গকারী, ধাপ্পাবাজ, অমানুষ এজেন্ট/মুয়াল্লেমদের হাত থেকে ভবিষ্যতে হজে যেতে ইচ্ছুক মানুষদের রক্ষা করার দায়িত্ব কে নেবে?

লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর