রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

অমিত সম্ভাবনার বায়োগ্যাস

শাইখ সিরাজ

অমিত সম্ভাবনার বায়োগ্যাস

পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে জলবায়ুর ওপর। অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে চিরদিনের পরিচিত আবহাওয়া। অসময়ে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিপর্যস্ত করে তুলছে বিশ্ববাসীকে। আর মানুষ এখন বুঝতে পারছে কতটা নির্মম আচরণ করেছে পরিবেশের সঙ্গে, যার কারণে পরিবেশও হয়ে উঠছে নির্মম। এখনই পরিবেশের কথা না ভাবলে ভবিষ্যৎ হবে আরও ভয়াবহ পরিণতির।  ফলত সমগ্র পৃথিবীই এখন সচেতন হয়ে উঠছে। ঝুঁকছে জ্বালানি হিসেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাস খুব জনপ্রিয়। বায়োগ্যাস নিয়ে কাজ করেছি বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষে, ৯০-এর দশকে। আমি বিটিভিতে ডজনখানেক বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের ওপর প্রতিবেদন প্রচার করেছি। ফলে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী উপকৃত হয়েছে। সেই সময়ে গ্রামীণ গৃহস্থালির জ্বালানির বড় অভাব ছিল। গ্যাস আজকের মতো এত সম্প্রসারিত ছিল না। আজ যেমন গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যায়, তখন তাও ছিল না। অবাধে বৃক্ষ নিধন হতো তখন। নব্বই দশকে বৃক্ষ রোপণের বড় প্রচারণা হয়েছিল। সেই সংকটের সময়টাতে যখন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট বিষয়টাকে তুলে ধরলাম তখন বাড়তি আগ্রহ তৈরি হলো যে, এভাবে যদি গ্যাস পাওয়া যায়, তাহলে তো বেশ ভালো। যেমন একটা গৃহস্থ পরিবারে যদি পাঁচটা গরু থাকে সেই গরুর প্রতিদিনকার যে গোবর আসে, সেই গোবর থেকে বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের মাধ্যমে দুই বেলা রান্না, বিদ্যুতায়ন— অনেক কিছুরই সম্ভাবনা দেখা গেল। তখন তো গ্রামবাংলার কৃষকরা কেরোসিন তেলের বাতি জ্বালাত। কেরোসিনও পোড়াতে চাইত না। তাই সন্ধ্যা হলে ঘুমিয়ে পড়ত। এসব বিষয় মাথায় রেখে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যখন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট দেখালাম তখন অনেক মানুষ আগ্রহী হলো। খেয়াল আছে, কুমিল্লা থেকে তখন দুই ফেরি পার হয়ে আসতে হতো, সেই কুমিল্লা থেকে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক রাত ৯টার দিকে আমার বাসায় এসেছিলেন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট বিষয়ে জানতে। আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি দেখায়ছেন গরুর গোবর থেকে গ্যাস হয়, সেটা থেকে পাক-সাক করা যায়, বাতিও জ্বলে!’ উনার কাছে অবিশ্বাস্য ছিল বিষয়টি। তিনি বলছিলেন, ‘এটা কি আপনি আলাউদ্দিনের চেরাগ পাইছেন? আমি তাকে বুঝিয়েছিলাম, রাতে আপনাদের গ্রামগঞ্জে স্তূপাকৃত কচুরিপানা বা আবর্জনা থেকে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। আপনারা বলেন, ভূত-পেত্নী যাচ্ছে। আসলে তা নয়। ওটা মিথেন গ্যাস। রাতের অন্ধকারে কচুরিপানা বা স্তূপ করা ময়লা থেকে জ্বলতে থাকে। মানুষ মনে করে ভূত বা পেত্নী যাচ্ছে। গরুর গোবরটাকে আপনি যদি অন্ধকার একটা কূপের মধ্যে রেখে দেন, ওখানে আপনি যদি ম্যাচবাতি জ্বেলে দেন, দেখবেন যে ওই রকম আলো জ্বলছে। ওটা মিথেন গ্যাসের আলো। সেটাকে আপনি যদি কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে আপনার রান্না করা চুলার মধ্যে আনতে পারেন তাহলে ওটা দিয়েই রান্নাবান্না হয়ে যাবে। তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, এটা তো বিশাল ব্যাপার, তাহলে তো আমাদের রান্নার জন্য গাছ কাটার দরকার নেই।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি তখন এলজিআরডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী। প্রয়াত কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর সঙ্গে তখন এ বিষয়ে আমার একাধিকবার মিটিং হয়। তিনি বাংলাদেশের উপজেলা পর্যায়ে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরির ডেমোস্ট্রেশন নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। অনেকগুলো উপজেলায় বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরি হয়েছিল অবস্থাশালী কৃষকের বাড়িতে। চট্টগ্রামের শালিয়াবহতে বাড়িতে বাড়িতে বায়োগ্যাসের মাধ্যমে রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ব্যবহার হতে দেখেছি। তখন ক্যাম্পেইনটা শক্তিশালী ছিল বলে আজ বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট সারা দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে। এর পেছনে বিসিএসআইআরের অনেক বড় অবদান আছে। এ তো গেল বাড়িতে ছোট্ট আকারে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরির শুরুর ইতিহাস। জ্বালানি সমস্যা এখনো আমাদের বড় একটি সমস্যা। আমরা যখন ভাবছি পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জ্বালানি তৈরির কথা, তখন উন্নত বিশ্ব ক্রমশ সরে আসছে সেই পথ থেকে। জ্বালানির বিকল্প নবায়নযোগ্য পথ হিসেবে খুঁজে নিচ্ছে বায়োগ্যাসকে। ছোট আকারে নয়, রীতিমতো কারখানায় তৈরি হচ্ছে বায়োগ্যাস। সম্ভবত ২০০৫ সালে জাপানের মরিওকায় অবস্থিত কইওয়াই অর্গানিক ফার্মে প্রথম বড় আকারের বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের ওপর প্রতিবেদন ধারণ করেছিলাম। 

উন্নত দেশ জার্মানিতে একবার এক বায়োগ্যাস কারখানায় গিয়েছিলাম। জার্মানির হ্যামেলিনের জেলসেনে দেখেছি বিশাল সব বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট। পিপা ও পাপি নামের দুই বন্ধুর একটা বায়োগ্যাস কারখানা ঘুরে দেখে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি। নিরাপদ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির কারখানা। অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে কিছু জৈব বর্জ্য আর তার সঙ্গে সরাসরি শস্যদানা মিশিয়ে তা থেকে তৈরি করা হচ্ছে বায়োগ্যাস। যা থেকে আসছে বিদ্যুৎ ও জৈব সার।

পাপি ও পিপা এ দুজনই সেই প্রতিষ্ঠানের মালিক, শ্রমিক-কর্মচারী সব। আর কোনো স্থায়ী কর্মী নেই সেখানে।

২০০৬ সালে শুরু এই বায়োগ্যাস ফ্যাক্টরির উদ্যোক্তা পিপা, জানালেন, তিনটি ছোট ইউনিটে কাজ হয়। প্রতিদিন দুবার জৈব বর্জ্য কারখানায় গ্যাস উৎপাদনের জন্য পাঠানো হয়। তিনটি পণ্যের উৎপাদন হয় সেখানে। জৈব বর্জ্য থেকে গ্যাস, গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ। আর উৎপাদন হচ্ছে জৈব সার। বিদ্যুৎ তারা সরবরাহ করছে সরকারের কেন্দ্রীয় গ্রিডে। গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে তিন কিলোমিটার এলাকার বাসাবাড়িতে। আর উৎপাদনের যে উচ্ছিষ্ট তা জৈব সার আকারে যাচ্ছে কৃষকের খেতে। পিপার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, গ্যাস উৎপাদনের জন্য জৈব কাঁচামাল হিসেবে প্রধানত কী ব্যবহার করছে তারা। জানাল, তাদের প্রধান কাঁচামাল বাসিল, অনেকটা গমের মতো। যা ইউরোপ আমেরিকার অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য। কারখানার কাঁচামাল ৬০ জন কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। কাঁচামালের স্তূপগুলো পাহাড়ের মতো। বিশাল সেই কারখানায় অটোমেশিনে কাজ চলছে নীরবে। মূলত ব্যক্তি উদ্যোগে বাণিজ্যিক একটি প্রতিষ্ঠান হলেও এ ধরনের কারখানাই জার্মানির নবায়নযোগ্য বিদ্যুত্শক্তির গুরুত্বপূর্ণ জোগানদার।

বর্জ্য পচিয়ে উৎপাদিত গ্যাস জমা হয় বড় আকারের ডোমে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় বিশাল আকৃতির কোনো স্থায়ী স্থাপনা। আদতে ফুলে থাকা ডোমটি মোটা প্লাস্টিকের। গ্যাসে পরিপূর্ণ হলেই অর্ধ-বৃত্তাকারে ফুলে থাকে। গ্যাস উৎপাদনের পর সেখান থেকেই পরিকল্পিত উপায়ে তা মাটির নিচে স্থাপিত পাইপলাইনের মাধ্যমে বাইরে সরবরাহ করা হয়।

পাপি ও পিপার প্রতিষ্ঠানটিই উন্নত বিশ্বের বিনিয়োগ ও সমকালীন উদ্যোগগুলোর প্রমাণ দিচ্ছে। পিপার সঙ্গে বিস্তারিত কথা হলো সেই উদ্যোগ সম্পর্কে। ৩ হেক্টর জমির ওপর প্ল্যান্ট নির্মাণে খরচ হয়েছে ২০ লাখ ইউরো। ৪০ লাখ ইউরো খরচ হয়েছে পুরোটা শেষ করতে। গ্যাস পাঠানোর জন্য লাইন তৈরিতে আলাদা করে খরচ হয়েছে ৯ লাখ ইউরো। পিপা বলছিল, শুরুতে হাতে ছিল ৬ লাখ ইউরো। বাকি ৪৪ লাখ ইউরো ব্যাংক ঋণ। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, খাদ্যশস্যকে ব্যবহার করে গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে খাদ্যের ওপর কোনো প্রভাব আছে কিনা। পিপা বলেছিল তাদের খাদ্যে কোনো সংকট এখন যেমন নেই, ভবিষ্যতেও সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা নেই।

প্রিয় পাঠক, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট সময়োপযোগী শিল্প উদ্যোগ। যা বহুমুখী লাভজনক। উন্নতবিশ্বের সমকালীন উদ্যোগের এটি একটি দৃষ্টান্ত। প্রচলিত ও সাধারণ লাভজনক কৃষি উদ্যোগের পাশাপাশি অপ্রচলিত ও উৎপাদনমুখী এই উদ্যোগগুলো এখন বেশ সফল হচ্ছে। এই পিপা ও পাপের মতো উদ্যোক্তারা সরকারি ঋণ সহায়তা নিয়ে সরকারি উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যেই অবদান রাখছেন। একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসরণ করার কারণে গোটা আয়োজনটি যেমন পরিবেশবান্ধব, বাণিজ্যিকভাবেও লাভজনক।  বাংলাদেশি শিল্প-উদ্যোক্তারাও আমি বিশ্বাস করি, এ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে এ ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারেন। তবে সব কিছুর আগে মাথায় রাখতে হবে উদ্যোগের সব দিক। সঠিক পরিকল্পনা ও কৌশল থাকলে নিশ্চয়ই এ ধরনের প্রকল্প সফল হবে। বাংলাদেশও আধুনিক ও উন্নত গবেষণার মাধ্যমে বায়োগ্যাসকে রূপান্তরিত করতে পারবে একটি বৃহৎ শিল্পে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

 [email protected]

সর্বশেষ খবর