রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ব্লু হোয়েল, সাইবার হয়রানি ও অন্য প্রসঙ্গ

তপন কুমার ঘোষ

ব্লু হোয়েল, সাইবার হয়রানি ও অন্য প্রসঙ্গ

সম্প্রতি কথিত অনলাইন গেম ‘ব্লু হোয়েল’ (নীল তিমি) নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বজুড়ে। ইন্টারনেটভিত্তিক ব্লু হোয়েল গেমের ফাঁদে পা দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের আত্মহত্যার খবর প্রচার হয়েছে বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে। এ মরণখেলার শিকার মূলত অপরিণত বয়সের স্কুলপড়ুয়ারা। দুর্বলচিত্তের, বিশেষ করে যাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে তাদের এ খেলার মাধ্যমে ধাপে ধাপে প্ররোচিত করে আত্মহত্যা করতে উসকে দেওয়া হয়। আমাদের দেশের পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে এ গেম নিয়ে সতর্ক করে বলা হয়েছে, অনলাইনে ব্লু হোয়েল গেম খেলা বা এ গেমের লিঙ্ক দেওয়া-নেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। সম্প্রতি এ খেলায় আসক্ত হয়ে ঢাকার এক মেধাবী স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করেছে বলে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রথমে খবর প্রচার করা হয়। বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম মনে করা হলেও আত্মহত্যার ঘটনার সঙ্গে ব্লু হোয়েল গেমের কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে পরবর্তীতে জানা যায়। এটা সুখবরই বলতে হবে। এ খবরে সাময়িক স্বস্তি ফিরে এলেও উত্কণ্ঠা এখনো কাটেনি। যারপরনাই অস্বস্তিতে আছেন অভিভাবকরা। এ গেমের অস্তিত্ব বিশ্বে রয়েছে। ইন্টারনেট যে ভৌগোলিক সীমানা মানে না, এটাই বড় আশঙ্কার জায়গা।

বলে রাখা ভালো, এ মরণখেলা নিয়ে বেশি প্রচার হিতেবিপরীত হতে পারে। কিশোর-কিশোরীরা উল্টো এ খেলার প্রতি কৌতূহলী হয়ে উঠতে পারে। অতি সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র কৌতূহলবশত ব্লু হোয়েল খেলতে শুরু করেন। জানাজানি হয়ে যাওয়ায় তিনি এ যাত্রা রক্ষা পেয়েছেন। এ খেলার পরিণতি যে অবধারিত মৃত্যু— এ বিষয়টি হাইলাইট হওয়া দরকার। যুগ ডিজিটাল। ইন্টারনেট প্রযুক্তির এখন জয়জয়কার। জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইন্টারনেটনির্ভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। কিন্তু বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ইন্টারনেটের অপব্যবহার করে নানা ধরনের সাইবার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশেও সাইবার হয়রানির শিকার হয়েছেন অনেকেই। ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে যথেচ্ছাচার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফেসবুকে মিথ্যাচারিতার ছড়াছড়ি। ভুয়া সংবাদ ও ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফেসবুকে পোস্ট করা অনেক তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেই যা খুশি তাই লেখা যায় না। বাকস্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা যে এক নয়, এ কথা কে কাকে বোঝাবে।

প্রতিটি সংবাদ মাধ্যমের একটা নীতিমালা থাকে। নীতিমালার আওতায় সম্পাদনার পর সংবাদ প্রচার করা হয়। কিন্তু ফেসবুকের ক্ষেত্রে এসবের বালাই নেই। ফাইন টিউনিংয়ের কোনো সুযোগ নেই। ফলে যার যা খুশি তাই মন্তব্য করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় মত প্রকাশের ক্ষেত্রে নৈতিকতা অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত।

পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, ফেসবুক-আসক্তি থেকে ধীরে ধীরে সন্তানদের বের করে আনতে হবে। এ জন্য সবার আগে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারে ঝুঁকি আছে। এই ঝুঁকির জায়গাগুলো না জেনেই আমরা অপরিণত বয়সের ছেলেমেয়েদের হাতে ইন্টারনেট সংযোগসহ স্মার্টফোন তুলে দিচ্ছি। সন্তান এটা নিয়ে কী করছে তা খেয়াল করছি না। এ জন্য অভিভাবকদের দোষারোপ করে লাভ নেই। আমাদের অনেকেরই ধারণা নেই ইন্টারনেটের বিপজ্জনক দিকগুলো সম্পর্কে। তাই সন্তানকে আমরা উল্টো বাহবা দিচ্ছি এই বলে যে, এই বয়সে সে কত কিছুই না শিখে ফেলেছে, যা আমরা পারি না। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যৌন হয়রানি ও প্রতারণার ঘটনা অহরহ ঘটছে। যৌন হয়রানির একই কাহিনী প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় জায়গা করে নিচ্ছে। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয়। প্রথমে বন্ধুত্ব, পরে প্রেম। এক সময় বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ। গোপনে ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া। ধর্ষিতাকে অভিযুক্ত করে ফেসবুকে একের পর এক কুরুচিকর মন্তব্য। লজ্জায়-দুঃখে-অপমানে ধর্ষিতার আত্মহনন।

নয়তো সাহস করে থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের। এ যেন একটা প্যাটার্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ঘটনা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যাচ্ছে। সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করা নতুন প্রজন্মের একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ ফেসবুকে জ্ঞানগর্ভ স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাস দেওয়ার পর কতটা লাইক পড়েছে বা কতবার শেয়ার করা হয়েছে তার ওপর সর্বক্ষণ নজর থাকে। না পড়ে বা না বুঝে অনেকে লাইক বা শেয়ার করেন। কাজেই সংখ্যা কোনো বিষয় নয়। ফেসবুক-বন্ধুর দীর্ঘতালিকা জনপ্রিয়তার মাপকাঠি নয়। অনেক ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। বন্ধুদের অনেকেই ফেসবুকে সক্রিয় নন। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ছবি ঘন ঘন পোস্ট করা হলে তা বন্ধুদের বিরক্তির কারণ হতে পারে। ফেসবুক কি শুধুই ব্যক্তিগত ছবি আর ব্যক্তিগত বিষয় পোস্ট করার প্লাটফর্ম? নিজের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সবাইকে জানানো কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ? ব্যক্তিগত জীবন খোলা খাতা নয়। ফেসবুকের সব বন্ধুই কি আপনার কাছের মানুষ? আপনার ব্যক্তিগত বিষয় জানতে উত্সুক? ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার আগে এ বিষয়গুলো মাথায় আনতে হবে। অপরিচিতজনের সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্ব স্থাপনের আগে দুবার ভাবতে হবে। বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ইন্টারনেটের জালে আমরা আটকা পড়ে গিয়েছি। ফেসবুকে ব্যক্তিগত ছবি, তথ্য ও রোজকার কর্মকাণ্ড পোস্টের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসির দফারফা। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ সব কিছু ওয়েবসাইটগুলোর নখদর্পণে। তাই প্রাইভেসির ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। ভেবেচিন্তে পা না ফেললে প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি আছে। কথায় বলে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। বহু চোর পালিয়েছে, কিন্তু বুদ্ধি বাড়ছে কই? একের পর এক ঘটে যাওয়া এসব প্রতারণার ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।

 

          লেখক : সাবেক ডিএমডি, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর