মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন : মিয়ানমারের চাতুরী

আমীর খসরু

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন : মিয়ানমারের চাতুরী

বর্তমানে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের (যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে শরণার্থী বলা হয় না) সংকটে বিপর্যস্ত। সমস্যাটির শুরুও যে গত ২৫ আগস্ট থেকে, তাও নয়। ১৯৭৮ সালে এর সূত্রপাত। যদিও বহু বহু বছর ধরে— যেমন ১৭০০ ও ১৮০০ সালের দিকে কয়েক দফা, ১৯৪০ এবং এর আগেপরে বহুবার বর্মিরা রোহিঙ্গাদের নিয়ে সংকটের সৃষ্টি করেছে এবং এখনো তা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্থায়ী কর্মকৌশল বা পরিকল্পনা তো দূরের কথা, তাত্ক্ষণিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার সক্ষমতাটা পর্যন্ত যে তাদের নেই—তা এখন আবার মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যাচ্ছে। অন্যদিকে, মিয়ানমার ‘অপকৌশল’ বা ‘কূটকৌশল’ আগাগোড়া একই গতিতে, একই ধারায় এবং সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এগিয়ে চলছে। তাদের অপকর্মেরও একটা কর্মপরিকল্পনা আছে। আর বাংলাদেশ খাবি খাচ্ছে প্রতিবার—সিদ্ধান্ত কী হবে তা নিয়ে। এ লেখাটিতে মিয়ানমারের অপকৌশল ও কূটকৌশলের বিপক্ষে বাংলাদেশের সঠিক পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির এসব দিক তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।

১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়ন ও উচ্ছেদের কারণে বাংলাদেশে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। তখনকার সরকার প্রথমে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান চাইলেও, মিয়ানমার তাতে কর্ণপাত করেনি। পরে চীনের মধ্যস্থতায় এবং বাংলাদেশ সরকারের একটি ‘বিশেষ পাল্টা হুমকি’-তে কাজ হয়েছিল। ১৯৭৮ সালের ৭ থেকে ৯ জুলাই ঢাকায় বাংলাদেশ ও বার্মার (মিয়ানমার) মধ্যে আলোচনায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে বলা হয়— “THE LEADERS OF DELEGATIONS, duly authorised by and on behalf of the Government of the Socialist Republic of the Union of Burma and the Government of the People’s Republic of Bangladesh, following their talks held in Dacca on 7th-9th July 1978 HAVE AGREED as follows,”...“The Government of the Socialist Republic of the Union of Burma agrees to the repatriation at the earliest of the lawful residents of Burma who are now sheltered in the camps in Bangladesh on the presentation of Burmese National Registration Cards along with the members of their families …”

এই চুক্তিটির একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, তৎকালীন বার্মা সরকার রোহিঙ্গাদের আইনগতভাবে বৈধ নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করেছিল। এই চুক্তি অনুসারে অল্পকিছু সংখ্যক বাদে অধিকাংশ রোহিঙ্গাকেই বর্মি সরকার ফেরত নিতে বাধ্য হয়।

বর্মিরা সেই স্মৃতি মনে রেখে ১৯৮২ সালে রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের (বিশেষত মুসলমানদের) জন্য নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তন করে অদ্ভুত এক আইনের প্রচলন করে—যাতে রোহিঙ্গাদের বিদেশি নাগরিক অর্থাৎ বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। রাখাইনের রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে প্রথমে আগের সব দালিলিক কাগজপত্র ও পরিচয়পত্র নিয়ে নেওয়া হয়। পরে তিন ধরনের নাগরিকত্বের ব্যবস্থা চালু করা হয়। যাদের দাদা-পরদাদা অর্থাৎ পূর্ব-পুরুষ রাখাইনের বাসিন্দা তারা পূর্ণ নাগরিকত্ব পেয়ে যান। এখানে বলে নেওয়া ভালো যে, এতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাই লাভবান হয়েছেন। ১৮২৩ সালের আগে বা এর ঠিক পরে যেসব পরিবারের বসবাস রাখাইনে, তারা পান সহযোগী নাগরিকত্ব এবং ১৯৪৮ সালের আগে বা পরে যারা, তারা পূর্ণ বা সহযোগী কোনো ধরনের নাগরিকত্বই পাননি। এই শেষোক্তরাই হচ্ছেন রোহিঙ্গা মুসলমান—যদিও বংশপরম্পরায় শত শত বছর ধরে তারা রাখাইনেই বসবাস করছেন। কিন্তু বৌদ্ধ না হওয়ার কারণে তাদের বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। আর বর্মি সরকার যে এই কাজটি সুস্পষ্ট ধারাবাহিক অপকৌশলের অংশ হিসেবেই করেছিল, তা টের পাওয়া যায় অল্পকালেই।

১৯৯১-৯২ সালে বার্মার সরকার পুনরায় রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ওপর অধিকমাত্রায় অত্যাচার-নির্যাতনের কারণে আবারও ২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। কিন্তু এরপরে বার্মার তীব্র অনীহা সত্ত্বেও ওই দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৯২ সালের ২৩ থেকে ২৮ এপ্রিল ঢাকায় বৈঠকের পরে একটি যৌথ বিবৃতি স্বাক্ষরিত হয়—যাকে চুক্তি হিসেবে পরবর্তীকালে গণ্য করা হয়। এই চুক্তিতে ১৯৭৮ সালের চুক্তির সঙ্গে বেশ কয়েকটি পার্থক্য রয়েছে। এক. ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতিতে বার্মার পক্ষ থেকে কৌশলে দুটো গুরুত্বপূর্ণ শব্দ জুড়ে দেওয়া হয়— ১. বার্মার বৈধ নাগরিক এবং ২. বর্মি সমাজের সদস্য। এই শব্দ দুটোর মধ্যে যে কী পার্থক্য তা এখন টের পাওয়া যাচ্ছে।

দুই. বার্মা যৌথ বিবৃতিতে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া কাউকে ফেরত নেবে না বলে স্পষ্টই জানিয়ে দেয়। তিন. যারা যেতে ইচ্ছুক নন, তাদের ফেরত নেওয়া যাবে না বলে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয় ১৯৭৮ সালের চুক্তিতে ছিল না। পুনরায় বলতে হচ্ছে, ১৯৭৮-এর চুক্তির পরে ১৯৮২ সালে মিয়ানমার কেন নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তন করেছে এবং কেনই বা ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতি— যা কিনা পরবর্তীতে চুক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়—এসব বিষয়গুলো আশা করি সবাই বুঝতে পারছেন। কিন্তু বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণটি এখানে যে, বার্মার ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনটিতে কী বলা হয়েছে, কেন বলা হয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য কী— সে সম্পর্কে কি কোনো ধারণা এখনো ঢাকার রয়েছে? এরই প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টিও অনুধাবন করা প্রয়োজন যে, কেন বার্মা এখনো ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতির কথাটি বার বার উচ্চারণ করছে। এটিও মনে রাখা দরকার, শুধু বৈধ নাগরিকদেরই গ্রহণ করা হবে বলে বার্মা যে কথাগুলো বলছে, এর পূর্বাপর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে খাবিখাওয়ার কারণ।

২৫ আগস্ট থেকে এই দফার লাখে লাখে শরণার্থী বাংলাদেশে আসার পর থেকেই বাংলাদেশ বার বার বলে আসছে যে, ১৯৯২ সালের বিবৃতির ভিত্তিতেই মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার দফতরের বাঘা বাঘা কূটনীতিকরা এবং সরকারের নীতিনির্ধারকরা বুঝতেই পারছিলেন না যে, তারা আসলে কী বলছেন। তবে বুঝেছেন, কিন্তু বড্ড দেরিতে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের দফতর অর্থাৎ অং সান সু চির কার্যালয়ের একজন মন্ত্রীর তিন দিনব্যাপী ঢাকা সফরের শেষ দিকে যৌথ বৈঠক শেষেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতি মোতাবেক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ প্রস্তুত। এর ঠিক পরের দিনই অর্থাৎ ৪ অক্টোবর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের অফিস থেকে বলা হলো, ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতি মোতাবেক বৈধ নাগরিকগণই মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবেন এবং এমন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার রাজি। উল্লেখ্য, এই প্রক্রিয়া চালু হলে ৯ লাখের মধ্যে মাত্র ১৪ থেকে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা দেশে ফেরত যেতে পারবেন। ১৯৮২ সালেই মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তনসহ ওই দেশটির অভ্যন্তরীণ বহু বিষয় সরকারের নীতিনির্ধারকদের মস্তিষ্কে রয়েছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।

অবশেষে ভুলটি ভাঙল, যখন ৯ অক্টোবর বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফিং দেওয়া হলো তখন। ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগের সব কথা উল্টে দিয়ে বললেন, মিয়ানমার যে ভিত্তিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চায় অর্থাৎ বৈধ নাগরিকত্বের পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে- তা একটি অপকৌশল; এটা রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেওয়ার ফন্দি ও কফি আনান কমিশন বাস্তবায়ন না করার কৌশল।

আরও দুটো প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হবে—মিয়ানমারের মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়। কিন্তু এই যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের কর্মপরিধি কী হবে, কবে থেকে তা কার্যকর ও কাজ শেষ হবে— সে প্রশ্নে একটি কথাও বলা হয়নি। এখন এ মাসের শেষে বাংলাদেশ এ প্রশ্নে একটি রূপরেখার খসড়া নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার যাবেন, চুক্তি সই করার আশায়। কিন্তু অং সান সু চির দফতর ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, ১৯৯২ সালের যৌথ বিবৃতিই হবে সব কিছুর ভিত্তি। উল্লেখ করা প্রয়োজন, যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের ঘোষণা যেদিন দেওয়া হলো, ঠিক তার পরের দিনই এবং এরপরেও মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলরের অফিস থেকে প্রদত্ত বিবৃতিগুলোতে বার্মা ১৯৯২ সালের ভিত্তিতেই প্রত্যাবাসনে তারা এখনই রাজি বলে জানানো হয়। জাতিসংঘকে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের মধ্যে তো রাখা হয়ইনি, পর্যবেক্ষকের মর্যাদাও দেওয়া হয়নি। জাতিসংঘের কোনো সংস্থাকে মিয়ানমার এখনো ওই দেশে সত্যিকার অর্থে মর্যাদা দেয় না। বিভিন্ন সূত্র বলছে, যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের বিষয়টিও বার্মার পক্ষ থেকে সময়ক্ষেপণের অপকৌশল মাত্র।

তাহলে কি আমাদের ধরেই নিতে হবে যে, বাংলাদেশ মিয়ানমারের অপকৌশলের খপ্পরে বা ফন্দির ফাঁদে আটকা পড়েছে? রোহিঙ্গারা কি শেষ পর্যন্ত দেশহীন একটি জাতি হিসেবেই চিরকাল অন্য দেশে থেকে যাবে? কামনা করি, প্রত্যাশা রয়েছে এমনটি নিশ্চয়ই হবে না।            

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর