মঙ্গলবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সবার দাবি অর্থবহ নির্বাচন

রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী

সবার দাবি অর্থবহ নির্বাচন

বাংলাদেশের সামনে আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার চ্যালেঞ্জ বিরাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। আগামী নির্বাচনকে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হলে তাতে জনসমর্থন আছে এমন সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির বিষয়টিও জরুরি। সরকারি দল ও তাদের জোটভুক্ত দলগুলো ছাড়া অন্যসব দল সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার চায়। এ প্রশ্নে সাধারণ মানুষের ঐকমত্যও রয়েছে। বিএনপি বর্তমান সরকারি দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তারা না হয় আওয়ামী লীগের অবস্থানবিরোধী কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব দিতেই পারে। শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচন না চাইতেই পারে। অন্য সব রাজনৈতিক দল! সব বিরোধী রাজনৈতিক দলই (একমাত্র সরকারপক্ষীয় ১৪ দল বাদে) তো শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ‘প্রায়-অসম্ভব’ বলে মন্তব্য করে আসছে। আর অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা সবাই ‘শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে’ সেই এক ঢাক পিটিয়েই যাচ্ছে তো পিটিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন প্রথমে সুশীল সমাজ, প্রতিনিধি ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কয়েকটি আলোচনা বৈঠক করেছে, এর পরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসতে শুরু করেছে। যারাই কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছে তাদের বেশির ভাগই কিন্তু বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু ও পুরোপুরি নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তার কারণটা সবারই বোধগম্য হওয়ার কথা। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের সেই বিখ্যাত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও ১৯৭০ সালের নির্বাচন সর্বাপেক্ষা নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছিল (বলা যায়, ৯৫ শতাংশই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ)। আর বাংলাদেশ আমলে ১৯৯১, ১৯৯৬ (দ্বিতীয় নির্বাচন) ও ২০০১ সালের নির্বাচন সর্বাধিক নিরপেক্ষ (বলা চলে, প্রায় ৯০ শতাংশ সুষ্ঠু) হয়েছিল। কারণ, এই তিনবারই কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল। সেই সরকারগুলোর কর্তাব্যক্তিদের কেউই ওইসব নির্বাচনে সরাসরি ‘বেনিফিশিয়ারি’ হওয়ার সুযোগ পাননি, নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার মূল কারণ ছিল সেটি। এ ছাড়া বাংলাদেশ আমলে অনুষ্ঠিত অন্য প্রতিটি সংসদ নির্বাচনই কমবেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অর্থাৎ যথাযথ হয়নি। কারণ ছিল নির্বাচনকালীন সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপ। এ কারণেই বিএনপি কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়েছিল, যে কারণে তারা গত নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এবার বিএনপি নির্বাচন-সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো— ১৯৫৪ সালে সেই নির্বাচনে (যেখানে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক-মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত ‘যুক্তফ্রন্ট’ নজিরবিহীন জনপ্রিয়তায় জিতেছিল) যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ২১ দফা ইশতেহারের ২০ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল— ‘আইনসভা বা মন্ত্রিসভার মেয়াদ কোনো অবস্থাতেই বর্ধিত করা হবে না। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ছয় মাস আগেই মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে।’ বস্তুত, সেই প্রস্তাবটিই প্রমাণ দেয় যে, নির্বাচন সুষ্ঠুকরণের লক্ষ্যে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ ও আইনসভার সদস্যদের মেয়াদ-সমাপণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। আর আজ, জাতীয় সংসদ বহাল-তবিয়তে রেখে, সরকার ব্যবস্থা অটুট রেখে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে চায়, বিরোধী দলগুলোকে সেই নির্বাচনে আসতে বাধ্য করতে চায়। এই দলটি কী ভুলে গেছে, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিই ছিল আওয়ামী লীগ আর ২০ নম্বর দফাটি তারাই প্রণয়ন করেছিল! চলতি অক্টোবরের মধ্যভাগে নির্বাচন কমিশন প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে আলোচনা-বৈঠকে ডেকেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো ‘শালিস মানি, তবে তালগাছটা আমার’ সেই নীতিতে ‘ইস্পাত-দৃঢ়’ রূঢ় অবস্থান নিয়ে বসে আছে, তার সঙ্গে কী আলোচনা করবে নির্বাচন কমিশন! বিএনপি কোনো অবস্থাতেই নির্বাচন-সহায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যেতে চাইবে না। কারণ, শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচনে গেলে সেই নির্বাচন হবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আরেকটি সংস্করণ। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ-প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে বলে যাচ্ছেন— “উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় তার সরকারের আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকা ‘আবশ্যিকভাবে’ দরকার”। তার কথার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে তার দলের অন্যসব নেতা। এরকম পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যথার্থ অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারে! আসলে সবার আগে দরকার— সরকারি দলের সেই আন্তরিকতা, যাতে সে মেনে নিতে পারে, প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে সার্বিক ব্যবস্থাপনা করা এবং সে কাজে সৎ-পন্থা নেওয়া। সেটা করতে হলে তাদের অনুরোধ করব তারা যেন আমাদের জাতীয় নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ২০ নম্বর দফাটি একটু পড়ে দেখেন এবং সেটি অনুসরণ করেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টের একজন বড় নেতা ছিলেন, তারও তাতে সম্মতি ছিল নিঃসন্দেহে। কেন শেখ সাহেব সেই যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার অন্যতম প্রণেতা হিসেবে ২০ নম্বর দফাটি যুক্ত করেছিলেন সেটা ঝানু-রাজনীতিক শেখ হাসিনা কি একটু ব্যাখ্যা করে দেখবেন, অনুগ্রহ করে?

নির্বাচন কমিশন সংলাপের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের উচিত হবে বিএনপিসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচন সুষ্ঠুকরণের লক্ষ্যে আবশ্যকীয় কাজগুলোর ব্যাপারে আলোচনা বৈঠকে বসা। তা না হলে সব দলের বা নিরপেক্ষ সব প্রার্থীর জন্য ‘লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি হবে না, হতে পারে না। নির্বাচন কমিশন যেন একটা বাজে-রেকর্ড করার মতো ১৫ ফেব্রুয়ারি বা ৫ জানুয়ারি মার্কা কোনো নির্বাচন পরিচালনা করে ‘ইতিহাসে-কুখ্যাত’ হয়ে না থাকে—দেশবাসীর একান্ত কামনা।

লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক।

 

সর্বশেষ খবর