বুধবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

নীল তিমির নষ্ট প্রেম

হাসান আল বান্না

নীল তিমির নষ্ট প্রেম

বলা হয়, প্রচারেই প্রসার। সম্প্রতি ব্লু-হোয়েল ইন্টারনেট সোশ্যাল মিডিয়াভিত্তিক খেলাটি বেশ

আলোচিত হচ্ছে।  অনেকে বলছেন, এটি নিয়ে যত আলোচনা হবে ততই এর প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়বে। প্রাকৃতিকভাবেই তরুণদের নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বেশি। তবে ঘটনার আরেক দিকও আছে, সঠিকভাবে জানা বা ধারণা না থাকলে তরুণ কিশোররা সতর্ক হবে কীভাবে? বলে রাখি— এমন বিষয়ে আগ্রহ না থাকাই ভালো যেখানে নিজের ক্ষতি নিশ্চিত, বিনিময়ে কোনো উপকার নেই। যেখানে ব্লু-হোয়েল খেলাটিতে বলা হচ্ছে জেনেশুনে আত্মহত্যা করা, সেখানে আগ্রহ থাকবে কেন?

গেমটি আবিষ্কার করেছে ‘ফিলিপ বুদেকি’। সে বলছে, যাদের এ সমাজে কোনো দাম নেই, হতাশ এবং নিজের প্রতি কোনো ভরসা নেই তাকে সে আত্মহত্যার মধ্যদিয়ে এ পৃথিবী  থেকে বিতাড়িত করতে চায়। সত্যি যদি কেউ এমন থাকে তাহলে তাকে গেম খেলে আত্মহত্যা করতে হবে কেন? তার তো চিকিৎসা দরকার। দেশে কি মনোরোগ চিকিৎসকের অভাব যে তার গেম খেলে মরতে হবে? সে সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে আমাদের মাঝে, আমরা সবাই মিলে এগিয়ে যাব নতুন ভবিষ্যতের দিকে। জীবনের প্রতিটি ধাপই এক একটি শিক্ষা, এখানে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

মনোবিজ্ঞানীদের ধরণা, পরিবারে পরস্পর যোগাযোগ না থাকার কারণেই ইন্টারনেট ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। আগে যেমন বলা হতো পাশের ফ্ল্যাটে কারা বসবাস করছে তা আরেক ফ্ল্যাটের মানুষ বলতে পারবে না। এখন আরেক ধাপ এগিয়ে বলা হয়, পাশের রুমে নিজের ভাই বা বোন কী করছে তা বলার ক্ষমতা অন্য ভাইবোনের নেই। সবাই যার যার মতো মোবাইল বা ল্যাপটপে বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারুণ্যের সময় যে ছেলে বা মেয়েটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং হীনমন্যতায় ভোগে এবং মনে হতাশা এবং আত্মসম্মানের ঘাটতি রয়েছে তাকেই এ গেমগুলো টার্গেট করে। কারণ যারা এ ব্লু-হোয়েলের মতো গেমগুলো তৈরি করে তারা জানে ওই হতাশাগ্রস্ত ছেলেমেয়েগুলোর মস্তিষ্ককে কীভাবে দখল করতে হয়। মানুষের উৎসাহ, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা, যে লক্ষ্যের দিকে টেনে নিয়ে যায়, তার যে অন্তর্গত খোঁজ তা কীভাবে দখল করতে হয় তা সে জানে। তাই পরিবারে পরস্পর যোগাযোগ এবং খোলামেলা কথা বলা, বাবা-মা তার ছেলেমেয়েকে বুঝিয়ে বলা কোথায় যাচ্ছে, একটু মাথায় হাত রাখা একটু বুকে টেনে নেওয়া— এগুলো অনেক বড় ভূমিকা রাখে এ ভয়াবহ খারাপ দিকগুলো থেকে রক্ষা পেতে।

বিষয়টি কি এমন, ব্লু-হোয়েল গেমটাই শুধু ক্ষতিকারক? এমন অনেক খেলা ইন্টারনেটে আছে যা মস্তিষ্কে এবং শরীরে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ব্লু-হোয়েল আলোচনায় এসেছে কারণ এর প্রভাব দৃশ্যমান এবং দ্রুত। আমরা ছোট বাচ্চাদের মোবাইলে কেক কাটার নামে হাতে ছুরি তুলে দিচ্ছি। কিশোররা কম্পিউটার মোবাইলে বন্দুক-ট্যাঙ্ক-হেলিকপ্টার দিয়ে মানুষ খুন করছে সমানে। ছোট থেকেই হয়ে উঠছে সহিংস। শিখছে কার্টুনে মুখ ভেঙানো খেলা। পাখি শিকারের নামে বন্দুক চালাচ্ছে। এ ছাদ থেকে লাফ দিয়ে ওই ছাদে পড়ছে। আমাদের বাবা-মা নিজেদের একটু বিশ্রামের জন্য এসব হাতিয়ার তুলে দিচ্ছে বাচ্চাদের হাতে।

দয়া করে কেউ আগ্রহ থেকে ভুল করেও ব্লু-হোয়েলের মতো খেলায় হাত লাগাবেন না। এটা শুধু একটি ব্ল্যাকমেইল গেম ছাড়া আর কিছুই নয়। এরা প্রথম থেকেই আকর্ষণীয় নানা বিষয়ের মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণকারীর নানা প্রয়োজনীয় তথ্য নেয়। ধাপ যত এগোয় ততই অংশগ্রহণকারীকে একান্ত সব তথ্য আর ছবি দিতে হয়, যা অংশগ্রহণকারীর মাথাতেই আসে না। এক সময় যখন অংশগ্রহণকারী খেলা থেকে বের হয়ে আসতে চায় তখন ওই তথ্য আর ছবিগুলো দিয়েই ব্ল্যাকমেইল করা হয়। যার শেষ পরিণতি হয় আত্মহত্যা। বিশ্বে প্রায় হাজারখানেক প্রাণ চলে গেছে এ খেলার আগ্রহ থেকেই।

এখন কথা হলো, ইন্টারনেটের খারাপ দিক থেকে মুক্তি পেতে আমরা শুধু বাবা-মাকেই দোষ দিয়ে যাচ্ছি। এ বয়সে শিশু-কিশোর তরুণরা কি শুধু বাবা-মার কাছেই থাকে? তারা স্কুলেও যায় বিকালে খেলতেও যায়, মসজিদে যায়, বন্ধুদের সঙ্গেও আড্ডা দেয়। শুধু বাবা-মার খেয়াল রাখায় কি আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে? টেককেয়ার করতে হবে সবাইকেই। স্কুলের শিক্ষক থেকে মসজিদের ইমামকে পর্যন্ত খেয়াল রাখতে হবে। ১৮ বছরের কম বয়সে ছেলেমেয়ে যদি স্মার্টফোন বা এনড্রয়েড ফোন ব্যবহার করে তাকে নিষেধ করতে সমস্যা কোথায়? টেকনোলজির ব্যবহার অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সেটারও একটি বয়স আছে। আগে টেকনোলজি বুঝতে হয়, তার ব্যবহার জানতে হয়। না শিখেই কেউ প্লেন চালাতে পারে না। আর এ জন্যই আমাদের কিশোর-তরুণরা প্রযুক্তির ভালো দিক না দেখে খারাপ দিকটাই বেশি বেছে নিচ্ছে।

আমরা সন্তানকে যেসব শিক্ষা দিই, হাঁটতে শিক্ষাই, খাবার কীভাবে খেতে হয় শেখাই, কাপড় কীভাবে পরতে হয়, কীভাবে কথা বলতে হয় তাও শিক্ষা দিই।  তাহলে ইন্টারনেট ছাড়া যেহেতু বর্তমান বিশ্ব চিন্তাই করা যায় না সেটা কি আমরা নিজের সন্তানকে শেখাচ্ছি? এখানে সমাজই বা কি ভূমিকা রাখছে?

যে সন্তানটি প্রেম শিখছে পর্নোগ্রাফি দেখে, সামাজিকতা শিখছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে, খেলাধুলা বুঝতে শিখছে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে।  তার কাছে ভবিষ্যৎ কী আশা করতে পারে, তা কি এখনো ভাবার সময় আসেনি?

লেখক : প্রযোজক, নিউজ টোয়েন্টিফোর টেলিভিশন।

[email protected]

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর