রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দূর হচ্ছে না কেন ঢাকার জলাবদ্ধতা

সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় রাজধানী ঢাকা। সমস্যা ভিন্ন হলেও চট্টগ্রাম সিটির অবস্থা একই। রাজধানীর এ সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন। মিডিয়াতে তীব্র সমালোচনা হয় কিন্তু সংকট কখনই নিরসন হয় না। কেন এ ঔদাসীন্য, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন আমাদের প্রতিনিধি জিন্নাতুন নূর ও জয়শ্রী ভাদুড়ী।

 

প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না

—অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী

ঢাকার খাল দখল এবং উদ্ধার বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

খাল দিয়ে বেষ্টিত ছিল ঢাকা। ঢাকাতে আগে ৬৫টি খাল ছিল। কমলাপুর, ধোলাইখাল, সেগুনবাগিচাসহ অন্যান্য খাল দিয়ে নৌকা চলত। ধানমন্ডি রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত আসত নৌকা। কিন্তু আস্তে আস্তে এ খালগুলো দখল হতে শুরু করল। কিছু খাল প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান দখল করেছে আর কিছু খাল দখল করেছে সরকার। ধোলাইখাল সরকার দখল করেছে। খালগুলো  পুনরুদ্ধার করতে সরকারকে জোরদার পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রভাবশালী দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের কাজের জন্য তার দখল করা জায়গা উচ্ছেদ না করে রেখে দিলে খাল উদ্ধার হবে না। শক্ত হাতে সরকারকে এসব উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

 

ওয়াসার বক্স কালভার্টগুলোর নকশা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমালোচনা আছে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

ওয়াসার বক্স কালভার্টগুলোর নকশা ঠিক হয়নি। এগুলোতে ময়লা জমে পানি যাওয়ার পথ বন্ধ হয়েছে। এগুলো পরিষ্কার করাও কঠিন। ময়লা এখন শক্ত লোহার মতো হয়ে গেছে। এ জন্য আন্ডার গ্রাউন্ড ডিজাইন সিস্টেম দরকার। যাতে পানি দ্রুত নেমে যেতে পারে।

 

বৃষ্টির পানি চলে যাওয়ার জন্য ফ্লাড জোন চিহ্নিত করা হয়েছিল। তার বাস্তবায়নে সরকারের উদ্যোগ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? 

সরকার নিজে যে সিদ্ধান্ত নেয় তা নিজেরাই মানে না। বৃষ্টির পানি জমা হয়ে নদীতে যাবে। এ জন্য ফ্লাড জোন চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু এগুলো দাগ দিয়ে আলাদা করা হলেও সরকার তা মানছে না। সরকার নিজেদের সিদ্ধান্তেও অটল থাকতে পারে না। এটাও রাজধানীর জলাবদ্ধতার জন্য অনেকাংশে দায়ী।

 

রাজধানীর অধিকাংশ ড্রেনই ভাঙাচোরা। পানি নিষ্কাশনের পাম্পগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। এই ড্রেন ও পাম্পের বর্তমান অবস্থা এবং কার্যকারিতা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

রাজধানীর ড্রেনগুলো সংস্কার খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। এগুলো ময়লা জমে পুরো বদ্ধ হয়ে পড়েছে। পানি যাওয়ার অবস্থা এগুলোর নেই। রাজধানীর রাস্তায় জমে থাকা পানি প্রাথমিকভাবে নিঃসরিত হয় ড্রেন দিয়ে। তাই ড্রেনগুলো সংস্কারে বিভিন্ন সংস্থার ঠেলাঠেলি বন্ধ করে দ্রুত কাজে হাত দিতে হবে। আর রাজধানীর পানি নিষ্কাশনে যে পাম্পগুলো আছে তা প্রায়ই অকার্যকর থাকে। এগুলো দ্রুত সংস্কার করে নতুনভাবে কাজ শুরু করতে হবে।

 

মানুষের সচেতনতা বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

মানুষ অনেকাংশে দায়ী ড্রেন বদ্ধ হয়ে পড়ার কারণে। রাস্তায় যে ডাব বিক্রি হয় তা ফেলে দেওয়া হয় ড্রেনের মধ্যে। এই ডাব তো আর পচে যায় না। ড্রেনের মধ্যে থেকে জলাবদ্ধতা তৈরি করে। এভাবে পলিথিন সবজি, ফলের খোসায় বন্ধ হয়ে যায় ড্রেন। ফলে বৃষ্টি হলে ড্রেন দিয়ে পানি যেতে না পেরে পানি উপচে রাস্তায় চলে আসে।

 

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে অনেক সভা, সেমিনার, সুপারিশ আপনারা করেন। কিন্তু এর বাস্তবায়ন সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে অজস্র সেমিনার এবং সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসবের কোনো বাস্তবায়ন নেই। বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন কিন্তু তারা প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক মহলের পাল্লায় পড়ে এ সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেন না। শুধু খাতাকলমে থেকে যায়। এ বিষয়ে একটা গল্প মনে পড়ে গেল। একবার হাই কোর্ট থেকে নদীর সীমানা নির্ধারণের জন্য সরকারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তখন সীমানা নির্ধারণ করতে বেছে নেওয়া হলো শীতকাল। যখন নদী শুকিয়ে নিচে নেমে গেছে। তখন শীতকালের পানির সীমানায় খুঁটি পুঁতে দেখানো হলো নদী এ পর্যন্ত। আর উপর থেকে বিস্তীর্ণ এলাকা হয়ে গেল ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এভাবেই দখল হয়ে যাচ্ছে দেশের নদী-নালা, খাল-বিল।

 

 

জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ সমন্বয়হীনতা

—স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন

ঢাকায় জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ কী?

ঢাকার জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ হচ্ছে সমন্বয়হীনতা। আমি মনে করি, সমন্বয়হীনতার কারণেই বার বার এ দুরবস্থা তৈরি হচ্ছে। পুরোপুরি সমন্বয় না থাকায় ওয়াসা, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর এবং সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও যারা বড় বড় উড়ালসেতু তৈরির সঙ্গে জড়িত, তাদের কারও সঙ্গে কারও কোনো সমন্বয় নেই।  তারা ঢাকায়  স্বাধীনভাবে এবং নিজেদের খেয়ালখুশি মতো কাজ করছেন এবং নিজেদের ‘সুপ্রিম অথরিটি’ বলে মনে করছেন। এ সমন্বয়হীনতা দূর করতে পারলে ঢাকা শহরে এক বছরের মধ্যেই জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব হবে। ঢাকার দুই নির্বাচিত মেয়র শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করে করণীয় ঠিক করছেন। এটি ইতিবাচক পদক্ষেপ কিন্তু এ বিষয়ে শুধু বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই হবে না, মেয়রদের বুঝতে হবে যে, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এ সমস্যার  যে সমাধান, তার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। 

 

জলাবদ্ধতা কি ঢাকাবাসীর জন্য নতুন সমস্যা? না আগেও ছিল?

ঢাকায় বৃষ্টির পানি আগেও ছিল, এখনো আছে। এমন নয় যে, রাস্তাঘাট আর দালানকোঠার জন্য বৃষ্টি কম বা বেশি হয়েছে। এমন বৃষ্টি এর আগেও ঢাকা শহরে হয়েছে। তবে বৃষ্টির পানি সরে যাওয়ার জন্য আমাদের ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকায় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও আছে। এ শহরে কিন্তু একটানা ১৫-২০ দিন পানি জমে থাকে না। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত রাজধানীর উন্মুক্ত জায়গার পরিমাণ অনেকাংশে কমে গেছে। কারণ শহরে আগের চেয়ে মানুষের বসবাস বেড়েছে। সঙ্গত কারণেই এই মেগাসিটির মাটির পরিমাণও কমেছে। এ কারণে আগে পাঁচ কাঠা পরিমাণের একটি জায়গা যে পরিমাণ বৃষ্টির পানি ধারণ করত, এখন তা আর করতে পারে না। অথচ পর্যাপ্ত লেক ও জলাশয় থাকায় আগে এই পাঁচ কাঠা জায়গা দিয়েই বৃষ্টির পানি বের হয়ে যেতে পারত। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, বর্ষা এলে  ঢাকার রাস্তাগুলো ড্রেনে পরিণত হয়। এ সমস্যা দূর করতে হলে ঢাকার স্যুয়ারেজ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে পর্যাপ্ত সংখ্যক জলাশয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। অথচ ঢাকা ওয়াসা নগরীতে যত্রতত্র বক্স-কালভার্ট তৈরি করে বৃষ্টির পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এ কালভার্টগুলো যদি বিজ্ঞানসম্মতভাবে তৈরি করা হতো এবং এগুলোতে জমে থাকা ময়লা যদি নিয়মিত পরিষ্কার করা হতো তবে ঢাকার রাস্তায় এমন জলাবদ্ধতা তৈরি হতো না। আর নিয়মিত পরিষ্কার না করায় কালভার্টগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতাও কমে  গেছে।

 

জলাবদ্ধতা দূর করার উপায় কী?

বর্তমানে জলাবদ্ধতা তৈরির পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে, পানি সরে যাওয়ার জন্য যে রাস্তা আছে তা ক্রমশ ছোট হয়ে এসেছে। আর দিনের পর দিন পানি নিষ্কাশনের রাস্তাগুলো ছোট করায় সড়কে জমে থাকা বৃষ্টির পানি সরতে দুই থেকে আট ঘণ্টা সময় লাগছে। আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলেই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা এবং নেতৃত্ব। একই সঙ্গে জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রয়োজন যথাযথ ব্যবস্থাপনা। যেহেতু ঢাকার চারপাশে বাঁধ আছে, তাই জলাবদ্ধতা দূর করতে আমাদের ‘পাম্প আউট’ বা জল নিষ্কাশন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে আমাদের জল নিষ্কাশন পদ্ধতিকে আরও কার্যকর করতে হবে। ঢাকার ‘ধোলাইখাল’কে আগের খালের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। লেকগুলোর তত্ত্বাবধান এমনভাবে করতে হবে যেন সেখানে ছোট নৌকা চলাচল করতে পারে। এ ছাড়াও লেক-কালভার্টগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। এগুলো দীর্ঘমেয়াদে নগর পরিকল্পনায় থাকবে কিনা সে সিদ্ধান্তও নিতে হবে।

 

কর্তৃপক্ষের দায়সারা অবস্থা দেখে আমি হতাশ

—স্থপতি ইকবাল হাবিব

 

রাজধানীর জলজট নিরসনে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

আমাদের দেশে আশ্বাস আছে কিন্তু বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেই। আমরা হাজারো সুপারিশ করি তারাও কথা দেন কিন্তু কাজ কিছুই হয় না। এ ধরনের দায়সারা আচরণে আমি পুরোপুরি হতাশ।  নিজের পায়ে যদি কাদা লাগে আমরা কি দাঁড়িয়ে থেকে দেখি নাকি পরিষ্কার করার উপায় খুঁজি? যত দ্রুত সম্ভব পানি ঢেলে পরিষ্কার করি। কিন্তু আমাদের এই নগরীতে সমস্যা সমাধানের কোনো ইচ্ছা কর্তৃপক্ষের নেই। এখানে শুধু করছি, করব বলে অঙ্গীকার করা হয় কিন্তু কাজ হয় না। তাই নগরের জলজট, যানজটসহ হাজারো সমস্যার কোনো সমাধান হয় না।

 

রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা ওয়াসার কাছ থেকে সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সমন্বয় সভায় তিন মন্ত্রী আশ্বাস দিলেন, আইন প্রণয়ন করে ওয়াসার কাছ থেকে সরিয়ে ড্রেনেজের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের কাছে দেওয়া হবে। তিন মাসের মধ্যে সমন্বিত প্রক্রিয়ায় সব কাজ শেষ করে এ দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। কিন্তু মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও কাজ কিছুই হয়নি। যা         অবস্থা তা-ই আছে। সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড বা মন্ত্রীর আশ্বাস কোনোটিতেই কাজ হয় না।

রাজধানীর জলজট নিরসনে খাল উদ্ধার বিষয়ে আপনি এর আগে বিভিন্ন সুপারিশ করেছেন। তার বাস্তবায়ন সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? 

এখন যে বৃষ্টি হচ্ছে তা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বৃষ্টি হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বৃষ্টির পানি যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে তা অস্বাভাবিক। ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত হলে এ পরিস্থিতি কখনই তৈরি হতো না। ড্রেনে ময়লা জমে লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছে। দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা বন্ধ থাকায় পানি যেতে পারে না। কিন্তু এসব সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। আর ড্রেনের পানি যাবেই বা কোথায়। খালগুলোতে নারিকেলের খোসা আর পলিথিন দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অধিকাংশ খালে ময়লা জমে শক্ত হয়ে তা পানি যেতে বাধা সৃষ্টি করছে। কিন্তু এসব খাল উদ্ধারে কোনো তৎপরতা নেই। ঢাকা শহরে খাল কতগুলো ছিল। আর এখন কয়টি আছে সেই হিসাব দেখলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। যে খালগুলো আছে সেগুলোও মৃতপ্রায়। মুগদা এলাকায় গত রবিবার মদিনাবাগ খালের কাদায় পড়ে শিশু হৃদয় নিখোঁজ হয়। ছয় দিন পর কাদা সরিয়ে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এই মৃত্যুর দায় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। সেগুনবাগিচা এবং শান্তিনগর খালের মাথায় কাদা জমে পানি যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এ ময়লা পরিষ্কার করার কোনো উদ্যোগ নেই। আর কত দিন এই দায়সারা অবস্থায় চলবে। আমরা অনেক সুপারিশ করেছি। অনেক বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু যাদের করার তারা কিছুই করে না। শুধু এক সংস্থা আরেক সংস্থার ঘাড়ে দোষ চাপায়। এসব পরিস্থিতি দেখে খুব অসহায় বোধ করি। এ ধরনের নাগরিক ভোগান্তি আমাকে হতাশ করে দেয়।

সর্বশেষ খবর