রবিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

পরিবেশ দূষণ ও আমাদের দায়

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

পরিবেশ দূষণ ও আমাদের দায়

পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এ ব্যাপারটি সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা আছে। কিন্তু নেই সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ এবং অভিজ্ঞতা যা কাজে লাগিয়ে বাস্তবায়ন করা যায় বসবাসযোগ্য পরিবেশ। ১৯৭০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত শুধু এ বছরটি অর্থাৎ ২০১৬ এবং ২০১৭ সাল বাংলাদেশ সরকারের বন এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ অধিদফতর বিশেষ করে শব্দদূষণ সম্পর্কে প্রচণ্ডভাবে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। একজন নাক, কান ও গলা রোগের চিকিৎসক হিসেবে খুবই আনন্দিত একটু হলেও রোগীর চাপ কমবে। আরও খুশি হতাম যদি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সেল ফোনের অপব্যবহার রোধে একক সচেতনতার আয়োজন করত। শুধু মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর বললে ভুল করা হবে, সোশ্যাল মিডিয়া অর্থাৎ প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াও এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। যদিও এ বছরের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘আসুন সবাই শপথ করি, শব্দদূষণ মুক্ত পরিবেশ গড়ি’ কিন্তু সেটা শুধু শব্দদূষণের জন্যই বলা হয়েছে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ অধিদফতর বা দফতর সবারই সারা বছরের জন্য পরিবেশে ভারসাম্যতা রক্ষার জন্য স্লোগানটা আরেকটু শব্দ পরিবর্তন করে যদি আমরা নিজেদের অন্তরে লালন করি সেটা হবে ‘আসুন সবাই শপথ করি, দূষণ মুক্ত পরিবেশ গড়ি’। পরিবেশ দূষণের জন্য শুধু যে শব্দদূষণ দায়ী তা নয়, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ ইত্যাদি সব কিছুই পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। প্রতিকারের জন্য যদিও তাদের ভিন্ন ভিন্ন সেক্টর রয়েছে।

আমার মনে হয় জাতীয়ভাবে পরিবেশ রক্ষার জন্য এবং পানি সুরক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত, সচেতন হওয়া উচিত। পানির বেলায় আমি নিশ্চিতভাবে বলব যে, পানির অপচয় রোধেও বিরাট বড় শপথ হওয়া উচিত। প্রকৃতি বা স্রষ্টা যে দুটো জিনিস মানুষকে দিয়েছেন পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে যা কখনো ক্রয় করতে হয় না সেটা হলো বেঁচে থাকার জন্য বায়ু এবং পানি। বায়ু বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি, বাতাসের অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন এবং অন্যান্য ধূলিকণা, বালুকণা আকরিক সবগুলাকে। একটি পরিপূর্ণ বৃক্ষ বছরে ১৪ কেজি অক্সিজেন নির্গত করে এবং ২০ কেজি কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। পানি বলতে ভূগর্ভস্থ এবং ভূপৃষ্ঠস্থ সব পানিকে আমরা ব্যবহার করি।

বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ, প্রযুক্তি আশীর্বাদ না অভিশাপ সে বিতর্কে গেলে আমরা সব সময় বলব বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মানব সভ্যতার অগ্রগতির জন্য এক অনন্য-ধারা কিন্তু বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অপব্যবহার পৃথিবীকে যে কোনো সময় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। যেমন যোগাযোগের কথাই যদি আমরা ধরি, সে কোথায় কবুতরের পায়ে চিঠি বেঁধে পাঠানো থেকে শুরু করে রানারের ডাক বিভাগ, তারপর কুরিয়ার সার্ভিস, তারপর টেলিযোগাযোগ, তারপরে টেলিযোগাযোগের যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন অর্থাৎ ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ইমপালসকে ব্যবহার করে আজ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, সবচেয়ে দরিদ্রতম দেশ থেকে সবচেয়ে ধনী দেশে আমরা অনায়াসে কথা বলতে পারি, যার নাম মোবাইল ফোন এবং সত্যিকার অর্থে মোবাইল।

বলছিলাম শব্দদূষণের কথা। আমরা সবাই জানি, শব্দ একপ্রকার শক্তি। যা যে কোনো পদার্থের অথবা যে কোনো কিছুর মেকানিক্যাল ভাইব্রেশনের জন্য তৈরি হয়। অর্থাৎ যান্ত্রিক কম্পন। গাড়িকে স্টার্ট দিলে শব্দ হবে, গাড়ির হর্ন বাজালে যেহেতু ডায়াফ্রামের ভিতর কম্পন সৃষ্টি হয়ে শব্দ হবে। আমরা যারা কথা বলি তাদের যখন ভোকাল কর্ডের ভিতর কম্পনের সৃষ্টি হয় তখনই শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে ইত্যাদি।

শব্দ একটি শক্তি যা শ্রুতি যন্ত্রের বহিঃকর্ণের ভিতরে যে ক্যানেল আছে তার মাধ্যমে কানের পর্দা পর্যন্ত পরিবাহিত হয়। পর্দায় ধাক্কা খাওয়ার পরে পর্দা এবং অন্তকর্ণের মাঝে, মধ্যকর্ণে বায়ুসহ ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র মাংস পেশিসহ যে তিনটি অস্থি রয়েছে তাদের মধ্য কম্পনের সৃষ্টি হয়। যে কম্পন অন্তকর্ণের ফ্লুইড বা পানি জাতীয় পদার্থকে ধাক্কা দিলে সেখানে মাইক্রো ভোল্টেজ ইলেকট্রিসিটির উৎপন্ন হয়, যা স্নায়ু কোষ দ্বারা প্রবাহিত হয়ে মস্তিষ্কের যে জায়গায় শ্রুতি কেন্দ্র স্থাপিত আছে সেখান পর্যন্ত প্রবাহিত হয় এবং সেখানে তার বিশ্লেষণ হওয়ার পর আমরা তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি। এবং সে তথ্যের বিপরীতে কী তথ্য প্রদান করতে হবে তাও আমরা আরেকটি স্নায়ুকেন্দ্রের মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি। মানুষ যখন শুনতে পায় তখন সে কাউকে কিছু শোনাতে আগ্রহী হয় এবং শুনতে পাওয়া শোনাতে আগ্রহী হওয়া—এ হলো যোগাযোগ।

অস্বাভাবিক মাত্রার তীব্র শব্দ শ্রবণশক্তির ওপর খারাপ প্রভাব ফেললেই তাকে শব্দদূষণ বলা হয়। আকস্মিক তীব্র শব্দ অথবা অতিরিক্ত শব্দ কোলাহলপূর্ণ অবস্থানের কারণে তাত্ক্ষণিক কিংবা ধীরে ধীরে অন্তকরণে ক্ষতির কারণে মানুষ আংশিক বা সম্পূর্ণ বধির হয়ে যেতে পারে। শব্দদূষণের কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে, হৃত্স্পন্দনের পরিবর্তন হতে পারে অর্থাৎ হার্টরেট দ্রুত বেড়ে যেতে পারে অথবা আচমকা হার্টরেট কমে গিয়ে হার্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মানুষ ক্লান্তি বোধ করতে পারে। অত্যন্ত নিভৃতমনে কোনো কাজ মনোযোগ দিয়ে করতে পারে না। মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। বিরক্তি হতে পারে, ঘুম না আসতে পারে এবং যখনই ঘুম আসবে না, বিরক্তি হবে মানুষ তার কাজে পরিপূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবে না কাজের যে আউটপুট অর্থাৎ ফলাফল তা কমে যেতে বাধ্য হবে। এবং রাষ্ট্রীয় উন্নতির বিঘ্ন ঘটবে। তাহলে শব্দ দূষণজনিত জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশাল এক অন্তরায়। শব্দদূষণের জন্য মানুষ মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক রাইসূল আলম মণ্ডল এবার এই শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিশাল এক কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে WBB-এর মাধ্যমে আটটি বিভাগীয় শহরে শব্দদূষণের মাত্রা এবং বিশেষ করে কোনো পয়েন্টে কত বেশি শব্দ তৈরি হচ্ছে, কোনটা মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকারক, কানের জন্য অগ্রহণযোগ্য সেটা নির্ণয় করে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এবং গবেষণাটি বৈজ্ঞানিক সম্মত হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ আমার নেই।

পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একেকটি প্রশিক্ষণের স্থান নির্ধারণ করে অর্থাৎ আটটি বিভাগে প্রতিটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সংখ্যা ৬০-৭০ এর মধ্যে নির্ধারণ করে যাদের মূল অংশগ্রহণকারী হবেন বিআরটিএ, ট্রাফিক সার্জেন্ট, পরিবেশ অধিদফতর, শিল্প এবং শিল্পপতিদের প্রতিনিধিবৃন্দ, শিল্পে কর্মরত প্রতিনিধিবৃন্দ। যাদের ওপরে বর্ণিত বিষয়ে তো শিক্ষা দেওয়াই হবে এবং ২০০৬ সালে তৈরিকৃত শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা সম্বন্ধেও প্রশিক্ষণে ধারণা দেওয়া হবে। এরকমভাবে যদি দুটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাহলে দেখা যাবে ১০০০ থেকে ১২০০ কর্মকর্তা অথবা সচেতন নাগরিক সে শব্দদূষণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভে সক্ষম হবেন। গাড়ি চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রাথমিকভাবে ঢাকা এবং চট্টগ্রামে যথাক্রমে দুটি করে প্রশিক্ষণ কর্মশালার ব্যবস্থা করা হবে। গাড়ি চালকদের মধ্যে তৃতীয় অর্থাৎ যানবাহন চালকদের জন্য শব্দদূষণ বিধিমালা এবং শব্দের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে প্রত্যেকটি বিভাগীয় শহরে বিশেষ করে জনসংখ্যার অনুপাতে যেমন ঢাকা বিভাগে এবং ঢাকা মহানগরে ১২টি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা মহানগরের জন্য তিনটি করে নয়টি, সিলেট, বরিশাল ও রংপুর সিটি করপোরেশনের জন্য একটি করে তিনটি সর্বমোট ২৪টি কর্মশালার ব্যবস্থা করা হচ্ছে যেখানে অ্যাম্বুলেন্সের চালকসহ সব ধরনের প্রায় ৪০০০ চালককে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। সর্বশেষ শব্দদূষণের প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের আইন যথেষ্ট নয়। আইন প্রয়োগও যথেষ্ট নয়। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনসমূহ এবং সংবাদ মাধ্যমে নিয়োজিত ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে যারা শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন। ঢাকাসহ অন্য বড় শহরগুলোতে শব্দদূষণ একটি মারাত্মক সমস্যা। এখনই প্রয়োজন একে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানষিক স্বাস্থ্য বিকাশ নিশ্চিত করা ও সামাজিক অস্থিরতা দূর করা। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সরকারি প্রশাসন, বেসরকারি সামাজিক সংগঠন এবং প্রচার মাধ্যমগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা।

সভ্য সমাজ বিনির্মাণ, বুদ্ধিদীপ্ত ভদ্র ও বিকশিত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরির স্বার্থে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আজ অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে সবার বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, শব্দদূষণে যে দুটি প্রজন্ম প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার একটি হলো শিশু আরেকটি হলো বয়স্ক। অর্থাৎ যারা এই সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত। সবচেয়ে বেশি যত্ন পাওয়া উচিত। যেই শিশু জাতির ভবিষ্যৎ তারা যদি শৈশবেই মানসিক অস্থিরতায় ভোগে তাহলে সমাজ বিনির্মাণে তাদের কোনো ভূমিকাই থাকবে না। আবার আজ যারা প্রবীণ প্রজন্ম, বয়স্ক প্রজন্ম যারা আমাদের এই সমাজটাকে আমাদের বসবাসের উপযোগী করে তৈরি করেছিলেন তাদের প্রতিও আমরা অবহেলা প্রদর্শন করব এটাই প্রতীয়মাণ হবে। সুতরাং এই দুই প্রজন্মকে শ্রদ্ধা দেখানো মানেই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ। একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য আমাদের কয়লা, প্রাকৃতিক তেল ও গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। জোর দিতে হবে দূষণমুক্ত শক্তি উৎপাদনের ওপর সৌর, বায়ু পারমাণবিক এবং পানি থেকে উৎপাদিত হতে পারে। দিনের বেলায় সৌরশক্তির ব্যবহার এবং রাতের বেলা জৈব জ্বালানি ব্যবহার করে যাতে বিদ্যুত্শক্তি ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায়, সে জন্য উন্নয়নমূলক গবেষণায় ব্যয় বাড়াতে হবে।

 

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর