সোমবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আত্মশুদ্ধির আলোচনা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

আত্মশুদ্ধির আলোচনা

প্রশান্ত আত্মা ছাড়া আল্লাহর কাছে কোনো আমলই গ্রহণযোগ্য নয়। সুস্থ কলব ছাড়া সেদিন কোনো কিছুই কাজে আসবে না। তাই কলবের সুস্থতা অর্জন এবং তা বজায় রাখার সাধনায় ব্রতী হতে হবে আমাদের। মাটির এই দেহের সুস্থতার জন্য কত চেষ্টা-প্রচেষ্টা আমাদের। কিছু হলেই ডাক্তারখানায়, হাসপাতালে ছোটাছুটি করি। এই টেস্ট, সেই টেস্ট করে ওষুধের পর ওষুধ খাই সুস্থ হওয়ার জন্য। আচ্ছা ভাই, আমরা কি কখনো আত্মার কথা ভেবেছি? আমাদের কলব কতটুকু সুস্থ আছে তলিয়ে দেখেছি? অসুস্থ কলব সুস্থ করার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছি কি আমরা? কোরআনের বৈজ্ঞানিক মেশিনে এক্স-রে করে দেখেছি কি আমাদের হৃদয়ে কত ময়লা জমেছে? কখনো কি শরণাপন্ন হয়েছি কোনো আত্মার চিকিৎসকের কাছে? ‘ওয়ালা তুখযিনা ইয়াওমা ইউবআসুন। ইয়াওমা লা ইয়ানফাও মালু ওয়ালা বানুন। ইল্লা মান আতাল্লাহি বিকালবিন সালিম। ওগো পরওয়ার দেগার আমার! কেয়ামতের দিন তুমি আমাকে অপমানিত কর না। যেদিন সম্পদ ও সন্তান, প্রাচুর্য ও প্রতিপত্তি কোনো কিছুই উপকারে আসবে না। একমাত্র উপকারে আসবে প্রশান্ত আত্মা-সুস্থ কলব। যে ব্যক্তি সুস্থ কলব নিয়ে তোমার সামনে দাঁড়াবে শুধু সেই মুক্তি পাবে’ (সূরা শোয়ারা : ৮৭৮-৮৯)।

মুসলিম মিল্লাতের পিতা সাইয়েদেনা ইবরাহিম (আ.) কেঁদে কেঁদে এ দোয়াই করেছেন জীবনভর। শুধু তাই নয়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সুস্থ কলবওয়ালা হওয়ার জন্য, কলবের সুস্থতা বজায় রাখার জন্য নিরন্তন প্রচেষ্টা করেছেন। যে প্রচেষ্টার নাম ‘জিহাদে আকবার’ দিয়েছেন আমাদের পেয়ারা নবী (সা.)। একবার তিনি (সা.) জিহাদ থেকে ফিরে সৈনিকদের বলছেন, ‘আমার সাহাবিরা শোন! এতক্ষণ আমরা ছোট জিহাদে ছিলাম। এখন আমাদের বড় জিহাদে নামতে হবে। এটা হলো নফসের সঙ্গে লড়াই করে কলবের সুস্থতা বজায় রাখার লড়াই। জেনে রাখ, এটাই জিহাদে আকবর বা বড় জিহাদ।’

কলব সুস্থ করার দুটি পদ্ধতি রয়েছে। আল্লামা ইয়ার খান (রহ.) তার ‘দালায়েলুস সুলুক’ গ্রন্থে সংক্ষেপে এ দুটি পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, শরীরের মতো কলবও অসুস্থ হয়। কলবের অসুস্থতা হলো কুফরি চিন্তা-ভাবনা করা, মিথ্যা কথা বলা, হিংসা করা, বিদ্বেষভাব, অহংকার, রিয়া, আত্মগরিমা ইত্যাদি। এসব ধ্বংসাত্মক রোগ থেকে নিজেকে বাঁচাতে হলে একজন আত্মার চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। একমাত্র আধ্যাত্মিক চিকিৎসকই পারবেন আত্মার এসব ব্যাধি সারিয়ে তুলে আপনাকে কলবে সালিম তথা সুস্থ কলবওয়ালা মানুষ হিসেবে আল্লাহর সামনে দাঁড় করাতে।

অসুস্থ কলবকে সুস্থ করার পর দুটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় আছে। এ কলব যেন ফের রোগাক্রান্ত না হয় এবং ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে না পড়ে। এ জন্য প্রয়োজন কলবকে শক্তিশালী করে তোলা। আর শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজন সুষম খাদ্য। কলবের জন্য সুষম খাদ্য একটিই। আল্লাহ বলেন, ‘আলা বিজিকরিল্লাহি তাতমাইন্নুল কুলুব। মনোযোগ দিয়ে শোন! একমাত্র আল্লাহর জিকিরেই কলবের প্রশান্তি ও সুস্থতা রয়েছে।’ কলবের সুস্থতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সুস্থ কলব ছাড়া আখেরাতে আল্লাহর কাছে আর কিছুই পেশ করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, দুনিয়ার জীবনে সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য, সুখী মানুষ হতে হলে সুস্থ কলবের অধিকারী হতে হবে। বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থ মিশকাতুল মাসাবি থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানবদেহে একটি মাংসের টুকরো আছে। এটি সুস্থ থাকলে তার শরীর-মন সব সুস্থ থাকবে। আর এটি অসুস্থ হয়ে গেলে সবই অসুস্থ অসুন্দর হয়ে যাবে। সুন্দর জীবন অসুন্দরের থাবায় মলিন হয়ে পড়বে।’ এরপর রসুল (সা.) ওই মাংসের টুকরোটির পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আলা ওয়াহিয়াল কলব। জেনে রাখো! সেটা হলো কলব।’ 

এ হাদিসে বলা হয়েছে, কলব তথা আত্মা পরিশুদ্ধ থাকলে সব সুন্দর হয়ে ওঠে। তাই তো আল্লাহতায়ালা সুন্দর কলবগুলোকেই তাকওয়ার জন্য, জান্নাতের জন্য নির্বাচন করেন। আল্লাহ বলেন, ‘উলা ইকাল্লাজি নামতাহানাল্লাহু কুলুবুহুম লিত্তাকওয়া। সুস্থ আত্মাওয়ালাদের কলবই আল্লাহতায়ালা তাকওয়ার জন্য নির্বাচন করেন।’ আর যাদের আত্মা অসুস্থ, কুৎসিত রোগে আক্রান্ত, তাদের কলবের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘বাল রানা আলা কুলুবিহিম—যেন তাদের কলবে-আত্মায় মরীচিকা পড়েছে।’ ‘লাহুম কুলুবুললা ইয়াফকহুনা বিহা—তাদের কলব দিয়ে তারা কিছুই বোঝে না।’ একপর্যায় এ ধরনের কলবওয়ালা তাদের নিষ্ঠুরতা ও গাফিলতির কারণে জাহান্নামের উপযুক্ত হয়ে পড়ে।  আমরা দেখছি কত সুন্দর-পরিপাটি হয়ে ওমুক সাহেব হেঁটে যাচ্ছেন আসলে সে তো এক কলব-মরা মানুষ। তার ব্যাপারেই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘খাতামাল্লাহু আলা কুলুবিহিম, ওয়ালা সাময়িহিম, ওয়ালা আবসারিম, গিশাওয়াহ। এ ধরনের মানুষের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছি। ফলে তারা শুনেও শোনে না, দেখেও দেখে না। ওয়ালাহুম আজাবুন আজিম। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব।’ 

হে আমার দরদি পাঠক ভাই-বোন! চোখ বন্ধ করে একটু ভাবুন, আমাদের আত্মা জীবিত না মৃত? সুস্থ না অসুস্থ? এ আত্মা নিয়ে কি দাঁড়াতে পারব আল্লাহর সামনে? মনে রাখবেন, সেদিন কিন্তু সম্পদের বাহাদুরি, আমলের জারিজুড়ি কোনো কিছুই কাজে আসবে না। ‘ইল্লা মান আতাল্লাহি বি কালবিন সালিম—শুধুমাত্র সুস্থ ও প্রশান্ত আত্মা সেদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর খোশ নসিব অর্জন করবে। হে আল্লাহ আমাদের পরিশুদ্ধ হওয়ার তৌফিক দিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর